ইসরায়েলের হামলার জবাবে ইরান পাল্টা হামলা চালাচ্ছে। শুরুতে ড্রোন দিয়ে হামলা চালালেও এখন ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা অব্যাহত রেখেছে তেহরান।
এখন সেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কার্যকারিতাকে বাস্তবে পরীক্ষায় নামতে হয়েছে। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এরইমধ্যে নিশ্চিত করেছে যে একাধিক স্থানে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে।
এর আগে ইরান সাধারণত ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটিকেই লক্ষ্যবস্তু বানাত। তবে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলা ইরানের সামরিক শৃঙ্খলার বড় ক্ষতি করেছে। ফলে এবার ইরানের প্রতিক্রিয়া আরও বড় পরিসরে হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিসের লং ওয়ার জার্নালের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক জো ট্রুজম্যান বলেন, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অকার্যকর করতে হলে, একসঙ্গে অনেক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া সবচেয়ে কার্যকর কৌশল হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, এই হামলার কৌশল মোকাবিলায় ইসরায়েলের হাতে খুব কম সময় থাকবে। এরমধ্যেই ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন শনাক্ত করা, তথ্য বিশ্লেষণ করা এবং প্রতিক্রিয়া জানানো শেষ করতে হবে।
ইরানের হামলা ঠেকাতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে, তা নিয়ে বিস্তারিত জানা যাক।
ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও সেটির বড় চ্যালেঞ্জ কী?
ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা বেশ শক্তিশালী ও বহুস্তরীয়। এতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী প্রযুক্তি, যা বিভিন্ন দূরত্ব ও উচ্চতায় আসা আক্রমণ প্রতিরোধে সক্ষম।
তবে ইরানসহ অন্যান্য শত্রু পক্ষের বড় পরিসরের আক্রমণের মুখে এসব ব্যবস্থার কার্যকারিতা এখন কঠিন পরীক্ষার মুখে।
ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে— আয়রন ডোম: স্বল্পপাল্লার রকেট প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়। এটি লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করে মাঝ আকাশে ধ্বংস করে দেয়।
ডেভিড’স স্লিং: মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে ব্যবহৃত হয়। এর পাল্লা প্রায় ৩০০ কিলোমিটার (১৮৫ মাইল)।
অ্যারো ২ ও ৩: দূরপাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। অ্যারো ২ বায়ুমণ্ডলে প্রায় ৫০ কিমি উচ্চতায় ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে পারে, আর অ্যারো ৩ মহাকাশেও হামলা প্রতিহত করতে পারে। এর পাল্লা প্রায় দুই হাজার ৪০০ কিলোমিটার।
আয়রন বিম: শক্তিশালী লেজার প্রযুক্তি, যা ড্রোন, রকেট ও ট্যাংকবিরোধী ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসে ব্যবহৃত হয়। ২০২৩ সালে হামাসের হামলার পর এটি প্রথমবার মাঠে মোতায়েন করা হয়।
ইসরায়েলের জন্য চ্যালেঞ্জ কী?
ইরানের অত্যন্ত দ্রুতগতির ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মহাকাশসীমা বরাবর উড়তে পারে এবং কয়েক কিছুক্ষণের মধ্যেই ইসরায়েলে পৌঁছাতে সক্ষম। এসব ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ করার জন্য অনেক ব্যয়বহুল ও সীমিতসংখ্যক ইন্টারসেপ্টরের প্রয়োজন হয়, যা সবসময় যথেষ্ট থাকে না।
২০২৩ সালের অক্টোবরের দিকে দক্ষিণ ইসরায়েলে একটি সামরিক ঘাঁটির কাছে প্রায় ৩০টি ইরানি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে, যেগুলো থামানো সম্ভব হয়নি। এতে ইসরায়েলের ইন্টারসেপ্টরের ঘাটতি দেখা যায়।
ড্রোন সাধারণত নিচু উচ্চতায় ও ধীরগতিতে উড়ে, তাই এগুলো রাডারে ধরা কঠিন। ইসরায়েল এসব ড্রোন ধ্বংসে যুদ্ধবিমান অথবা আয়রন ডোম ব্যবহার করে, তবে সবসময় তা কার্যকর হয় না।
বিশ্লেষকদের মতে, বড় মাত্রার আক্রমণে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা একসাথে সব দিক সামলাতে নাও পারতে পারে। তাই এই মুহূর্তে দেশটির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—পর্যাপ্ত ইন্টারসেপ্টর সরবরাহ বজায় রাখা ও ড্রোনসহ সব ধরনের হামলার দ্রুত প্রতিরোধ নিশ্চিত করা।
ইসরায়েলের মিত্রদের ভূমিকা কী?
ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষায় তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সহায়তা দিচ্ছে। সর্বশেষ হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইসরায়েল বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকিয়ে দিয়েছে।
ইরান গত অক্টোবরে ইসরায়েলের দিকে প্রায় ১৮০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পর, যুক্তরাষ্ট্র থাড (টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স) প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাঠায়।
এটি একটি মোবাইল সারফেস-টু-এয়ার ইন্টারসেপ্টর, যা এক হাজার ৮০০ মাইল দূর থেকে শত্রুপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করতে পারে এবং পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কিংবা মহাকাশে ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সক্ষম।
চলতি বছরের শুরুর দিকে ট্রাম্প প্রশাসন আরও একটি থাড ইউনিট ইসরায়েলে পাঠায় বলে জানান তেল আবিবের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের সামরিক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ইহোশুয়া কালিস্কি।
এ ছাড়া মার্কিন নৌবাহিনী কার্ল ভিনসন নামের একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার আরব সাগরে মোতায়েন করে রেখেছে। এতে রয়েছে ৬০টির বেশি যুদ্ধবিমান, যার মধ্যে রয়েছে উন্নত প্রযুক্তির এফ-৩৫ স্টেলথ ফাইটার।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আরও অনেক আক্রমণাত্মক ও প্রতিরক্ষা বিমান মোতায়েন রয়েছে, যেগুলো গত বছর ইরানের হামলা থেকে ইসরায়েলকে রক্ষা করতে ব্যবহৃত হয়েছিল।
ইসরায়েলের প্রতিবেশী জর্দান জানায়, তাদের আকাশসীমায় প্রবেশকারী শত্রুপক্ষের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র তারা বাধা দেয়। এতে শুধু জর্দান নিজেই নয়, ইসরায়েলের জন্যও এটি একটি অতিরিক্ত সুরক্ষা স্তর হিসেবে কাজ করে।
ইরানের হাতে কী কী অস্ত্র রয়েছে?
ইরান তাদের সামরিক অস্ত্রভাণ্ডার এবং সক্ষমতার তথ্য সবসময়ই গোপন রাখে, তাই তারা ঠিক কতটা বড় ও শক্তিশালী আঘাত হানতে পারে, সেটা নির্ভুলভাবে বলা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষক জো ট্রুজম্যান মনে করেন, ইরান তার আঞ্চলিক মিত্র গোষ্ঠীগুলোর (প্রক্সি মিলিশিয়া) সহায়তা নিতে পারে—যেমন লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইরাক ও ইয়েমেনের গোষ্ঠীগুলো।
শুক্রবার ইয়েমেন থেকে একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হলে ইসরায়েলে সাইরেন বেজে ওঠে, যদিও সেটি গিয়ে পড়ে পশ্চিম তীরের এক জনবসতিহীন এলাকায়।
ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ টম কারাকো ও তেল আবিবের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের সামরিক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ইয়েহোশুয়া কালিস্কি জানিয়েছেন, শুক্রবার ইসরায়েলের হামলায় ইরানের অনেক অস্ত্রব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে বলেই তারা মনে করেন।
কালিস্কি বলেন, এই হামলার পর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনীকে আবার সংগঠিত করতে সময় লাগবে। আমাদের হাতে বহু স্তরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে, তাই আমি খুব একটা উদ্বিগ্ন নই।
আরএইচ