ঢাকা, সোমবার, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২৬ মে ২০২৫, ২৮ জিলকদ ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

টেলিযোগাযোগ সেবা খাত সুশৃঙ্খল করতে কার্যকর নীতিমালা চায় আইওএফ

স্পেশাল করেসপেন্ডন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১:৩৮, মে ২৬, ২০২৫
টেলিযোগাযোগ সেবা খাত সুশৃঙ্খল করতে কার্যকর নীতিমালা চায় আইওএফ

ঢাকা: আইজিডাব্লিউ তথা সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ পরিষেবা খাতকে আরও সুশৃঙ্খল ও গতিশীল করে তোলার জন্য একটি কার্যকর ও বাস্তবমুখী নীতিমালা প্রণয়ণের আহ্বান জানিয়েছে আইজিডাব্লিউ অপারেটররা।

রোববার (২৫ মে) রাজধানীর মহাখালীতে রাওয়া কমপ্লেক্সে আন্তর্জাতিক ভয়েস কল পরিচালনায় আইজিডব্লিউ এর ভূমিকা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা শীর্ষক সেমিনারে তারা এ আহ্বান জানান।

আইজিডাব্লিউ অপারেটরস ফোরাম (আইওএফ) এই সেমিনারের আয়োজন করে।

আইজিডাব্লিউ অপারেটরস ফোরাম (আইওএফ) সভাপতি আসিফ সিরাজ রব্বানী, সহ-সভাপতি মোঃ আব্দুস সালাম, মীর টেলিকম লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোঃ আব্দুল হান্নান, নভোটেল লিমিটেডের পরিচালক মোঃ হাসিবুর রশিদ, বাংলা টেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোঃ খুরশীদ আলম, টিআরএনবি সভাপতি সমীর কুমার দে, সাধারণ সম্পাদক মাসুদুজ্জামান রবিন বক্তব্য রাখেন।

সেমিনারে বলা হয়, বিটিআরসির প্রস্তাবিত খসড়া ‘টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ও লাইসেন্সিং ব্যবস্তা সংস্কার নীতিমালা’ বিদ্যমান বহুস্তর ভিত্তিক বিভিন্ন লাইসেন্সের পরিবর্তে তিন স্তরের লাইসেন্স কাঠামোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়াও কিছু কিছু সেবার ক্ষেত্রে লাইসেন্সের পরিবর্তে শুধুমাত্র তালিকাভুক্তির প্রস্তাবনা করা হয়। প্রস্তাবনায় একটি লাইসেন্সের মাধ্যমে বিদ্যমান আইজিডাব্লিউ, আইআইজি, আইটিসি, সবমেরিন ক্যাবল লাইসেন্সের আওতাধীন সেবাসমূহকে একত্রিত করা হয়েছে। এছাড়াও মোবাইল ও ফিক্সড সেবার জন্য পুথক লাইসেন্সের প্রস্তাব করা হয়।

প্রস্তাবিত খসড়ার নানা অসঙ্গিতি তুলে ধরে সেমিনারে বলা হয়, এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে টেলিকম খাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। পাশাপাশি দীর্ঘ দিন ব্যবসা করে আসা লাইসেন্সধারী কোম্পানিগুলো বিলুপ্ত হবে এবং এই খাতের হাজার হাজার ইঞ্জিনিয়ার ও কর্মীরা বেকার হয়ে পড়বে।

আইওএফ সভাপতি আসিফ সিরাজ রব্বানী বলেন, আমরা শুরু থেকে অর্থাৎ ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত সরকারকে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব দিয়েছি। ওটিটি প্লাটফর্মের কারণে আমাদের ট্রাফিক কমে এসেছে। এখন আমরা প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব দিচ্ছি। একসময় যেখানে ট্রাফিক ছিল একশ’ মিলিয়ন, সেখান থেকে ১০-১২ মিলিয়নে এসেছে। এখন নতুন করে পলিসি করার কিছু নেই। এতে করে টিকে থাকারও একটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। যাতে আমরা টিকে থাকি সে ব্যাপারটাও দেখতে হবে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক এসএমএস থেকে শুরু থেকে সরকার কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পায়নি। বিটিআরসির অনুমোদনের মাধ্যমে এই সেবা চালু করতে পারি। চালু করা হলে বছরে ২০০ কোটি টাকা রাজস্ব দিতে পারবো।

সেমিনারে বলা হয়, যে প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে তাতে কোনো মার্কেট স্ট্যাডি করা হয়নি। গুণগত সেবার মানটি কেমন হবে তাও আজানা। আমরা যারা ব্যবসা করছি তারা টিকতে পারবো না। ফলে বিদেশিদের হাতে ব্যবসা চলে যাবে। প্রস্তাবিত সংস্কার বাস্তবায়িত হলে আমাদের লাইসেন্স বিলুপ্ত হবে এবং কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে যাবে এবং ইঞ্জিনিয়াররা বেকার হয়ে যাবে। বিদেশি মালিকানা থাকার কারণে দেশের অর্থ বাইরে চলে যাবে। এতে মানি লন্ডারিংয়ের সুযোগ নিতে পারে। এছাড়া মোবাইল অপারেটরদের হাতে চলে গেলে একটি বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। বিদেশিদের হাতে গোপন তথ্য চলে যাবে।

আন্তর্জাতিক কল এবং এসএসএসের ইতিহাস তুলে ধরে জানানো হয়, ১৯৯৫ সালে বিশ্বজুড়ে চালু হওয়া ভিওআইপি প্রযুক্তি যেমন নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে, তেমনি এদেশে তার অপব্যবহারও শুরু হয়। অনেক অপারেটর গোপনে আন্তর্জাতিক কল পরিচালনা করতে থাকে, যার ফলে সরকার হারায় বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। ২০০৬-০৭ সালে এই অপব্যবহারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইন্টারন্যাশনাল লং ডিস্টেন্স টেলিকমিউনিকেশন সার্ভিস (আইএলডিটিএস) পলিসি প্রণয়ন করে একটি নতুন যুগের সূচনা করে। এর মাধ্যমে কলরেট নির্ধারণ, রেভিনিউ শেয়ারিং এবং অবৈধ কল বন্ধের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ভয়েস ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হয়। এর ফলশ্রুতিতে আইজিডব্লিউ, আইসিএক্স, আইআইজি এবং এনটিটিএনের মাধ্যমে একটি কাঠামোগত ও সংগঠিত সিস্টেম গড়ে ওঠে, যা তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।

কিন্তু ২০১০ সালে আইএলডিটিএস পলিসিতে পরিবর্তন এনে ২০১২ সালে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় অতিরিক্ত লাইসেন্স ইস্যুর মাধ্যমে বাজারে চরম অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। নির্ধারিত রেটের চেয়ে কম দামে কল টার্মিনেট করে সরকারের প্রায় ৯০০ কোটি টাকার রাজস্ব বাকি রেখে ছয়টি প্রতিষ্ঠান ব্যবসা গুটিয়ে চলে যায়, যার ধাক্কা পড়ে সামগ্রিক টেলিকম খাতে।

এরই ফলস্রুতিতে ২০১৫ সালে আইজিডব্লিউ অপারেটরস ফোরাম (আইওএফ) গঠিত হয় এবং আইওএস মডেলের মাধ্যমে একটি কেন্দ্রীভূত ও সংগঠিত কল ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা চালু হয়। এতে সামগ্রিক সিস্টেমে স্বচ্ছতা আসে এবং ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকার অধিক রাজস্ব সরকার পায়।

আইজিডব্লিউ খাত শুধু রাজস্ব আয় নয়, বরং দক্ষ জনশক্তি তৈরিতেও অবদান রাখছে যা, দেশের তরুণদের জন্য ভবিষ্যৎ গড়ার পথ খুলে দিয়েছে।

তবে সম্ভাবনার পাশাপাশি রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। যেমন ওটিটি প্ল্যাটফর্মের দাপট; হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ম্যাসেঞ্জার, ইমোর মতো প্ল্যাটফর্মের কারণে আন্তর্জাতিক ভয়েস কলের পরিমাণ বিপুলভাবে কমে গেছে। অবৈধ আন্তর্জাতিক কলের ব্যবহারে সরকার এখনো রাজস্ব হারাচ্ছে।

নীতিগত অস্পষ্টতা, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের রাজনৈতিক পক্ষপাত ও কিছু দলীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান অগ্রাধিকার পাওয়ায়, বাজারে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে, যা প্রকৃত টেলিকম ব্যবসায়ীদের টিকে থাকা কঠিন করে তুলেছিল।

তবে নানা প্রতিবন্ধকতা পাশাপাশি রয়েছে অনেক সম্ভাবনা। আইএলডিটিএস নীতিমালায়, আন্তর্জাতিক এসএমএস পরিষেবা আইজিডব্লিউ’র মাধ্যমে পরিচালিত হবার কথা থাকলেও, তা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। আইএলডিটিএস পলিসির ব্যত্যয় করে মোবাইল অপারেটরদের মাধ্যমে এসএমএস পরিষেবা পরিচালিত হওয়ায় প্রতি মাসে ৩০ লক্ষাধিক ডলার বৈদেশিক আয় সরকারের হাতছাড়া হচ্ছে।

আজ আমাদের সামনে সুযোগ হয়েছে একটি কার্যকর ও বাস্তবমুখী নীতিমালার মাধ্যমে আইজিডাব্লিউ তথা সামগ্রিক ভাবে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ পরিষেবা খাতকে আরও সুশৃঙ্খল ও গতিশীল করে তোলার।

সেমিনারে বলা হয়, আমরা সবাই মিলে সময়োপযোগী, প্রযুক্তিনির্ভর এবং অংশীদারিত্বপূর্ণ নীতিমালা গ্রহণে সরকারকে সহায়তা করি যেন, আইজিডাব্লিউ-সহ সার্বিক টেলিকম খাত আবারও দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান উৎসে পরিণত হতে পারে। এমন নীতিমালা হওয়া উচিৎ, যেখানে দেশীয় উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করবে, হাজারো তরুণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং দেশের টাকা দেশেই থেকে সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

এমআইএইচ/এমএম 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।