বিশ্বজুড়ে বাড়ছে এক অদেখা সমস্যা। এই সমস্যা মানুষকে বেশি অসুস্থ করে দিচ্ছে, জীবনের আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে এবং সমাজের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক দুর্বল করে দিচ্ছে।
যখন কেউ পর্যাপ্ত সামাজিক যোগাযোগের সুযোগ পায় না, সম্পর্কের ভেতরে একা বোধ করে বা আশেপাশের মানুষদের সঙ্গে টানাপোড়েনপূর্ণ সম্পর্কের মুখোমুখি হয়—তখনই এই বিচ্ছিন্নতা গভীর হয়। এটি একটি ক্রমবর্ধমান জনস্বাস্থ্য সংকট, যা অনেক সময় গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নানা রূপে দেখা দেয়।
সবচেয়ে পরিচিত সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ধরন হলো একাকিত্ব। আজকের দিনে বিশ্বের প্রতি ছয়জনের একজন মানুষ নিজেকে একা মনে করে। এই হার তরুণ-তরুণী ও দরিদ্র দেশগুলোর মানুষের মধ্যে আরও বেশি। কিন্তু একাকিত্ব বা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া শুধু মন খারাপের বিষয় নয়—এটা জীবনসংহারীও হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে একাকিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত কারণে প্রতি বছর গড়ে আট লাখ ৭১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এখন স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, সামাজিক সুস্থতা, অর্থাৎ অর্থবহ মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলা ও টিকিয়ে রাখার ক্ষমতা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের মতোই জীবনের জন্য অপরিহার্য। তবুও বছরের পর বছর ধরে বিষয়টি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও নীতিনির্ধারকদের কাছে উপেক্ষিতই থেকে গেছে।
ডব্লিউএইচও’র সোশ্যাল কানেকশন কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশের এক মাস পর বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষদ তাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সামাজিক সংযোগ বা যোগাযোগ বিষয়ক একটি রেজল্যুশন গ্রহণ করেছে। এই প্রতিবেদন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই স্বাস্থ্যঝুঁকির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
এতে শক্ত নেতৃত্ব এবং দ্রুত কাজ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন প্রমাণভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এই সমস্যার মোকাবিলা করার এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে মজবুত করার স্পষ্ট পথ দেখিয়েছে, যা সমাজ ও ব্যক্তি দুয়েরই উন্নতির জন্য অত্যাবশ্যক।
মানুষ প্রকৃতিগতভাবে অন্য মানুষের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্যই তৈরি। ছোটবেলা থেকেই আমাদের মস্তিষ্ক, আবেগ এবং সুস্থ জীবনের সম্ভাবনা সম্পর্কের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। কিন্তু একাকিত্ব বা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা জীবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। এটি হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, ডিমেনশিয়া এবং অকাল মৃত্যুসহ নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তা ছাড়া, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা পড়াশোনা ও কর্মজীবনে খারাপ প্রভাব ফেলে। এতে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি টাকার আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি হয়।
ভালো খবর হলো, এই সমস্যার সমাধান রয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন জাতীয় নীতি থেকে শুরু করে স্থানীয় কমিউনিটি প্রোগ্রাম, সচেতনতা অভিযান এবং ব্যক্তিগত সহায়তার কৌশলের মতো কার্যকর পদক্ষেপের খসড়া তুলে ধরেছে। এতে সফল অনেক উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। যেমন—দক্ষিণ আফ্রিকায় নিম্ন আয়ের বৃদ্ধদের জন্য পিয়ার-টু-পিয়ার সাপোর্ট; দক্ষিণ কোরিয়ায় বৃদ্ধদের জন্য সংগীত, গল্প, বাগানচর্চা ও স্বসহায়তা গ্রুপের মতো কার্যক্রম সোশ্যাল প্রেসক্রিপশন হিসেবে দেওয়া ইত্যাদি।
এটি শুধু ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ও সুস্থতার বিষয় নয়, বরং এটি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, জাতীয় স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক ঐক্যের একটি মূল ভিত্তিও বটে। যেসব সমাজ বিশ্বস্ততা ও যোগাযোগকে উৎসাহিত করে, সেগুলো বেশি উদ্ভাবনী, নিরাপদ এবং সংকট মোকাবিলায় বেশি সক্ষম হয়।
কোভিড-১৯ মহামারি এই সত্যটিকে স্পষ্টভাবে সামনে এনেছে। যখন লকডাউনের কারণে সবাইকে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হয়েছিল, তখন মানুষের যোগাযোগের প্রয়োজন কতটা অপরিহার্য, তা সবাই বুঝতে পেরেছে, আর এর অভাবের ক্ষতিও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওই কমিটি পাঁচটি মূল স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে একটি বিশ্বব্যাপী রোডম্যাপ প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে রয়েছে নীতি, গবেষণা, হস্তক্ষেপ, পরিমাপ এবং অংশগ্রহণ। এতে প্রধানত যা করার কথা বলা হয়েছে, তা হলো, দেশের নীতি তৈরি করা যাতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ অন্তর্ভুক্ত হয়; কার্যকর পদ্ধতি বুঝতে গবেষণায় অর্থ দেওয়া; সংস্কৃতিগতভাবে মানানসই ও সাশ্রয়ী কার্যক্রম বাড়ানো; সমস্যা বুঝতে ও অগ্রগতি মাপতে ভালো তথ্য সংগ্রহ করা; এবং মনোভাব বদলানো ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা কমানোর জন্য একটি বিশ্বব্যাপী উদ্যোগ গড়ে তোলা।
এই আন্দোলনে অবশ্যই তাদের কণ্ঠস্বরও থাকা প্রয়োজন, যারা একাকিত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা সইছেন, কারণ তারা জানেন প্রকৃত সমাধান কী রকম হওয়া উচিত। এখন বিশ্বনেতাদের পক্ষে নীরব থাকা আর সম্ভব নয়। একটি দিন দেরি হওয়ার মানেই সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাওয়া, অপ্রয়োজনীয় কষ্ট আর প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু। যদি আমরা সাহসী, ঐক্যবদ্ধ ও মানবিকভাবে ব্যাপকভাবে কাজ করি, তাহলে আমরা সুস্থ, আরও বেশি যোগাযোগপূর্ণ ও সহনশীল সমাজ গড়ে তুলতে পারব। সামাজিক স্বাস্থ্য কোনো বিলাসিতা নয়, এটি মানুষের মৌলিক চাহিদা। এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সময় এটি রাজনৈতিক অগ্রাধিকার হয়ে উঠেছে।
Ø তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক
Ø বিবেক মূর্তি, ডব্লিউএইচও কমিশন অন সোশ্যাল কানেকশনের সহ-সভাপতি
Ø চিদো এমপেম্বা, ডব্লিউএইচও কমিশন অন সোশ্যাল কানেকশনের সহ-সভাপতি
আরএইচ/এমজেএফ