আধুনিক যুগে থেকেও প্রাচীন জীবনচর্চ ঘোচাতে পারেনি গাজীপুরের ‘সান্ধার’ সম্প্রদায়। ভাগ্যবিড়ম্বিত এ সম্প্রদায় বঞ্চিত হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের সব সুফল থেকে।
দুই শতাব্দীর অনিশ্চিত জীবনব্যবস্থার শৃঙ্খল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে না পেরে যাযাবর এই জনগোষ্ঠী নিত্যদিন চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
গাজীপুরের পুবাইল এলাকা দিয়ে প্রবাহিত চিলাই নদীর কাকালিয়া ফেরিঘাটে নোঙর করে থাকা অর্ধশতাধিক ক্ষুদ্রাকৃতির ভাসমান নৌকায় সমাজের পিছিয়ে পড়া এ সম্প্রদায়ের কয়েক শ পরিবারের বসবাস মনে করিয়ে দেয় আদিম যুগের মানুষের জীবনব্যবস্থাকে।
একসময়ের স্রোতস্বিনী চিলাই নদীর প্রবাহ সময়ের বিবর্তনে সংকুচিত হয়ে এসেছে। এর প্রভাবে সংকুচিত হয়ে এসেছে নদী ও প্রকৃতিকেন্দ্রিক এই জনগোষ্ঠীর বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত জীবনযাত্রা।
এই নদীতে বসবাসের স্বাস্থ্যকর কোনো পরিবেশও এখন আর নেই, রয়েছে শিল্প-কারখানার বদৌলতে দূষিত পানিতে নানা দুরারোগ্য ব্যাধিতে প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি। তারপরও থেমে নেই তাদের সংগ্রামী জীবনের পথচলা।
পুবাইলের কাকাতলীর চিলাই ফেরিঘাটে সান্ধার সম্প্রদায়ের দুঃসহ জীবনচিত্র দেখে বিস্ময় মানতে হয়। নদীর পানিতে ভাসমান সান্ধারদের সর্দার তারা মিয়া (৬৫) আক্ষেপ করে বলেন, ‘বহুত বার ল্যাখে নেছে। কিন্তু কোনো কাম ত অয় নাই। আমাগো কষ্ট কষ্টই থাইক্যা গেল। ’
জানা যায়, দুশো বছরেরও আগে সান্ধাররা আস্তানা গাড়েন কাকালিয়া ঘাটে। তখন নদীর ঐশ্বর্য থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল মূলত নদীপথে। ফেরি করে নানা সামগ্রী বেঁচে স্বল্প উপার্জনে চলত এদের জীবন। এখন সান্ধারদের নারীরা হাতের চুড়ি, কাচের বাসন-কোসন, মেয়েদের মাথার ক্লিপ-ফিতা ইত্যাদি গ্রামগঞ্জে বিক্রি করেন। পুরুষদের বেশির ভাগ সময় কাটে বেকার শুয়ে-বসে। এদের কেউ কেউ তালা-চাবি, ঘড়ি, ছাতা মেরামত করেন। গত কয়েক বছর সান্ধারদের অনেকে স্থানীয় গার্মেন্টে চাকরি নিয়েছে। আধুনিক জীবনব্যবস্থার সাথে পাল্লা দিয়ে এ সান্ধারপল্লীর অনেককে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেও দেখা যায়।
নৌ-বহরে বসবাস করা এই জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা অনেকটা ‘দিন আনে দিন খাই’ অবস্থা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের কারণে এসব পরিবারে রোগবালাই লেগেই থাকে। বিশেষ করে ডায়রিয়া, টাইফয়েড, জ্বরসহ নানা ছোঁয়াচে রোগের প্রকোপ থাকে প্রায় সারা বছর। এসব রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে সান্ধারদের নেই তেমন স্বাস্থ্যসচেতনতা কিংবা চিকিৎসা নেবার সক্ষমতা। এই জনগোষ্ঠী বঞ্চিত রয়েছেন ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবাসহ মৌলিক নাগরিক সুবিধা থেকে।
ছোট ছোট নৌকায় বাস করা জীবনসংগ্রামে ক্লান্ত বেশ কজন নারী জানান, নদীর পানিতে ভাসমান জীবনযাপন করলেও তারা দেশের নাগরিক- ভোটারও হয়েছেন। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে করা ছবিযুক্ত ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন এসব পরিবারের অনেকে। বর্তমানে সান্ধারপল্লীতে প্রায় দুই শতাধিক ভোটার রয়েছেন। জাতীয় নির্বাচনসহ অন্যান্য স্থানীয় নির্বাচনের সময় এ জনগোষ্ঠীর কদর অনেকটা বেড়ে যায়। কিছু নগদ সাহায্যও মেলে। কিন্তু নির্বাচনের পরে ভুলেও এ পথ মাড়ান না সেসব প্রার্থী কিংবা নেতারা। আগে শিক্ষালাভের সুযোগ ছিল না এ সম্প্রদায়ের। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা পরিবর্তন আসছে। এদের কারো কারো ছেলেমেয়েরা যাচ্ছেন স্কুলে। সান্ধারপল্লীর আলতাফের ছেলে ওয়াসিম এসএসসি পাস করে এ জনগোষ্ঠীর ‘অশিক্ষিত’ থাকার দুর্নাম ঘুচিয়েছেন অনেকটাই। ইতোমধ্যে এ জনগোষ্ঠীর প্রতি নজর পড়েছে এনজিও প্রতিষ্ঠানের। এগিয়ে আসছে এদের জীবনমান উন্নয়নে। ভাসমান এ পল্লীর শিশুদের বিনামূল্যে লেখাপড়ার সুযোগ করে দিতে একটি এনজিও স্কুল খুলেছে। গত দু বছরে এ স্কুল থেকে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে উচ্চ বিদ্যালয়েও ভর্তি হয়েছে। স্কুলটির শিক্ষিকা ছালমা আক্তার জানান, বর্তমানে ৩২ জন শিক্ষার্থী রয়েছে তার স্কুলে। এদের অনেকে ভালো ফলাফলও করছে।
ক্ষুধা, দারিদ্র্য সর্বোপরি প্রতিনিয়ত অনিশ্চিত জীবনের হাতছানি সত্ত্বেও পূর্বপুরুষদের এ আবাসস্থল ছেড়ে অন্যত্র যাবার কথা চিন্তা করে না সান্ধার জনগোষ্ঠী।
ashrafulislam09@gmail.com
বাংলাদেশ সময় ১৯৫৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১১


