ঢাকা, বুধবার, ১ শ্রাবণ ১৪৩২, ১৬ জুলাই ২০২৫, ২০ মহররম ১৪৪৭

ফিচার

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার

বিপ্লব কুমার পাল ও স্বপন দাস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:৪২, আগস্ট ১৫, ২০১১
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার

আঠারো শতকের শেষের দিকে (১৭৬০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ) বাংলায় সন্ন্যাসী ও ফকির বা মুসলিম ও হিন্দু তাপসরা ব্রিটিশ শাসনবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। সেই আন্দোলনকে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বলা হয়।

ঐতিহাসিক এ আন্দোলন ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নামেও পরিচিত। কেউ কেউ একে বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা বলেও মনে করেন।

অন্তত তিনটি আলাদা ঘটনাকে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নামে অভিহিত করা হয়। হিন্দু সন্ন্যাসী ও মুসলিম মাদারী এবং ধার্মিক ফকিরদের এক বৃহৎ গোষ্ঠী পবিত্র স্থান দর্শনের উদ্দেশ্যে উত্তর ভারত থেকে বাংলার বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করতেন। যাওয়ার পথে এসব সন্ন্যাসী গোত্রপ্রধান, জমিদার বা ভূস্বামীদের কাছ থেকে ধর্মীয় অনুদান গ্রহণ করতেন। সমৃদ্ধির সময়ে গোত্রপ্রধান, জমিদাররাও এসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদার ও অনুগত ছিলেন। কিন্তু ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি ক্ষমতা লাভ করে তখন থেকে করের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পায়। ফলে স্থানীয় ভূস্বামী ও গোত্রপ্রধানরা সন্ন্যাসীদের অনুদান আর ইংরেজদের কর প্রদানে অসমর্থ হয়ে পড়ে। এর ওপর ফসলহানি ও দুর্ভিক্ষে প্রায় কোটি মানুষ প্রাণ হারায়।

এসব আন্দোলনের সূতিকাগার বলা হয় নাটোরকে। অর্ধবঙ্গেশ্বরী মহারানি ভবানীর সহযোগিতায় নাটোর রাজবাড়ির সিংহদ্বারের কাছে যুক্তিতলা ছিল ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনকারী সন্ন্যাসীদের আস্তানা। গ্রেপ্তার এড়াতে সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে বিপ্লবীরা এখানে (যুক্তিতলায়) একত্র হয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনার জন্য নানা যুক্তি-পরামর্শ করতেন।

নাটোরের তারানাথ রায় ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী। বড়লাটের আগমনে রাজশাহীর পুলিশ লাইনে তিনি কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে কালো পতাকা তুলেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশরা তাঁকে দ্বীপান্তর দেয়। সেখানে তাকে নির্যাতন করে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়।

বিপ্লবী তারানাথকে হত্যার খবর পেয়ে তাঁর ভাই প্রকৌশলী হারানাথ রায় রাজশাহী টেনিস গ্রাউন্ডে এক ইংরেজ কর্মকর্তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। তাঁকেও ব্রিটিশরা জেলখানায় নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে।

১৭৭১ সালে দেড়শজন ফকিরকে হত্যা করা হয় দৃশ্যত বিনা কারণে। এটি ছিল অনেকগুলো কারণের একটি, যা ক্ষোভের সৃষ্টি করে। এ ক্ষোভ পরবর্তীকালে রূপ নেয় সংঘাতে, বিশেষত বাংলাদেশের নাটোর ও রংপুর অঞ্চলে।

অন্য দুটি আন্দোলন ছিল হিন্দু সন্ন্যাসীদের একটি অংশ দসনমি নাগা সন্ন্যাসীদের, যারা তীর্থ ভ্রমণের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় অর্থ ধার দিতেন এবং ফেরার সময় সেই অর্থ উত্তোলন করে নিতে যেতেন। কিন্তু ব্যাপারটিকে ভালো চোখে দেখত না ব্রিটিশরা। ব্রিটিশদের কাছে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সন্ন্যাসীরা ছিল লুটেরা। এদেরকে কোম্পানির প্রাপ্য অর্থে ভাগ বসানো বন্ধ করতে এবং এমনকি সম্ভব হলে বাংলায় প্রবেশ ঠেকাতে তারা ছিল সদা তৎপর। তাদের কাছে ভ্রাম্যমাণ মানুষের এই বিশাল ¯্রােত সম্ভাব্য হুমকি বলে মনে হতো।

আঠারো শতকের শেষের তিন দশকজুড়ে যখনই কোম্পানির সৈন্যরা সন্ন্যাসী এবং ফকিরদের অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বাংলায় প্রবেশে বাধা দিয়েছে, তখনই ভয়ানক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। এসব সংঘর্ষে সব সময়ই যে কোম্পানির সৈন্যরা বিজয়ী ছিল তা নয়। বেশির ভাগ সংঘর্ষের তথ্য নথিভুক্ত করা হয়েছে দুর্ভিক্ষের পরবর্তী বছরগুলোতে। কিন্তু সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ১৮০২ সাল পর্যন্ত, যদিও তুলনামূলকভাবে কিছুটা অনিয়মিতভাবে। এমনকি উন্নততর প্রশিক্ষণ সুবিধা ও সৈন্যসম্ভার থাকা সত্ত্বেও কোম্পানি ভ্রাম্যমাণ সন্ন্যাসীদের সঙ্ঘবদ্ধ আক্রমণ প্রতিহত করতে সমর্থ ছিল না।

নাটোর শহরে বসবাসরত তারানাথ রায়ের ছেলে কৃষ্ণকমল রায় জানান, সে সময় নাটোর সদরের হাপুনিয়া গ্রামের কিশোরী মোহন লাহিড়ী, পাটুলের কালী মৈত্র, নাটোর শহরের উপরবারের জ্ঞান চক্রবর্তী, তারকানাথ দাস ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁদেরও জেলখানায় হত্যা করা হয়। এছাড়া নাটোর সদরের বাসুদেবপুর গ্রামের কানু সান্ন্যাল ছিলেন ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের একজন অকুতোভয় বিপ্লবী।
 
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রানি ভবানীর অবদান আর বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের ইতিহাস স্বর্ণময়। নাটোর রাজবাড়ী তার জীবন্ত প্রমাণ। যুক্তিতলা তার নীরব সাক্ষী। তবে বেদখল হয়ে যাচ্ছে যুক্তিতলার জায়গা। কেউ দেখার নেই, কেউ দেখে না।

নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানেন না নাটোরের বিপ্লবীদের কথা। ব্রিটিশদের তাড়াতে এ দেশের বীর সন্তানেরা জীবন দিয়েছেন, দ্বীপান্তর নিয়েছেন; অনেককেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। বহু বিপ্লবীর ঘরবাড়িও গুঁড়িয়ে দিয়েছে বেনিয়া শাসকরা। সেসব স্মৃতিচিহ্নের অনেকগুলোই আজ বিলুপ্ত। যেটুকু আছে তাও সংরক্ষণের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।

বাংলাদেশ সময় ২০৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।