ঢাকা, মঙ্গলবার, ৬ শ্রাবণ ১৪৩২, ২২ জুলাই ২০২৫, ২৬ মহররম ১৪৪৭

ফিচার

বাংলানিউজকে বোমাং রাজকন্যা

নামটা খচখচ করে কেটে দেবে

আসিফ আজিজ ও মীর সানজিদা আলম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:৩৭, এপ্রিল ২০, ২০১৩
নামটা খচখচ করে কেটে দেবে

বান্দরবান থেকে ফিরে: ডনাই প্রু নেলী। বোমাং রাজপরিবারের সর্বশেষ (১৬তম) রাজা ক্য সাইন প্রু চৌধুরীর (কেএস প্রু) কন্যা।

সম্প্রতি এই ভাগ্য বিড়ম্বিত রাজকন্যার সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের।

টানা তিন ঘণ্টার কথোপকথনে উঠে আসে বোমাং রাজ পরিবারের তিনশ’ বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির জানা-অজানা নানা দিক। আসে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ, আঞ্চলিক রাজনীতির চালচিত্র। ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি আর সমষ্টিগত স্বার্থ চিন্তার অনেক সুচিন্তিত বিশ্লেষণও উঠে আসে রাজকন্যার সহজ-সরল-সাবলীল বক্তব্যে। বাদ যায় না উত্তরাধিকার নিয়ে পারিবারিক জটিলতাজনিত হতাশা-হাহাকার-আক্ষেপ। অপ্রাপ্তি আর ভাগ্য বিড়ম্বনার বেদনা কখনো জলের ধারা হয়ে নামে বোমাং রাজজন্যার চোখে। পরক্ষণেই অশ্রুর বেগজয়ী চোখে ফুটে ওঠে রাজপরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখার দৃঢ় প্রত্যয়। ফাঁকে ফাঁকে রাজপরিবারের জনহিতৈষী কাজের নাতিদীর্ঘ ফিরিশতিও তুলে ধরেন তিনি।

বাংলানিউজের পক্ষে তার সাক্ষাৎকারটি নেন নিউজরুম এডিটর আসিফ আজিজ ও মীর সানজিদা আলম। ছবি  তোলেন স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট নূর এ আলম

পাঠকদের সুবিধার জন্য দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটির দ্বিতীয় পর্ব ছাপা হলো শনিবার।     

বাংলানিউজ: বোমাং সার্কেলের শাসনকালে তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে রাজপরিবারের ভূমিকা ....

নেলী: আমাদের চৌদ্দতম রাজা মংশৈ প্রু দাদুর ভূমিকাটা ছিলো চমৎকার। পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী তাকে বলেছিল- তুমি আমাদের হয়ে কাজ করো। তাদের তিনি রিফিউজ করতে পারছিলেন না। আবার দেশ তো দেশ।

বাংলানিউজ: মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিতর্কিত রাজার কথাও আমরা জানি। এ প্রসঙ্গে আপনার বক্তব্য কি?

নেলী: সে সময় তো অনেকে পাকিস্তান পক্ষে জড়িয়েও গেছেন। যেমন চাকমা রাজা দেবাশিষ, তার বাবা বিতর্কিত হয়ে গেছেন। যদিও তিনি মানুষের জন্য কাজ করেছেন। কিন্তু মানবতার জন্য, নিজের সম্প্রদায়কে বাঁচানোর জন্য তাকে এমন কিছু কাজ করতে হয়েছে যেগুলোর জন্য তাকে বিতর্কিত হতে হয়েছে। তার লাশ পর্যন্ত দেশে আনা যায় নি।

আমার জানা মতে, সে সময় বান্দরবানে অনেকে বিতর্কিত হয়েছিলেন। রাজাকার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন।

কিন্তু তখন তো জোর ছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর। তাদের কথা না শুনে এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের তো উপায় ছিল না। আমার দাদুর স্বাধীনতা যুদ্ধে যতোখানি ভূমিকা রাখা উচিত ছিল, ততোখানি হয়তো রাখতে পারেননি- কিন্তু, বিতর্কিত হন নি তিনি। যদিও তাকে অনেক কৌশল করে চলতে হয়েছে।

বাংলানিউজ: স্বাধীনতার পর আপনাদের পরিবারে রাজনীতির প্রভাবটা কেমন ছিলো? আপনার বাবার মৃত্যুর পর রাজপরিবারের এখন কি অবস্থা?

নেলী: বোমাং সার্কেলের চিফ নিয়োগ দেয় কিন্তু সরকার। প্রথমে ফ্যামিলি,  তারপর সরকার স্বীকৃতি দেবে। সবকিছু বিবেচনা করে ১৯৯৬ সালে সরকার আমার বাবাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

যদিও আমার বাবা একটু সময় নিচ্ছিলেন। মাঝ থেকে আমার মামা অংশৈপ্রু চৌধুরী ঢুকে গেলেন। দুই পরিবার অনেকটা আলাদা হয়ে গেল। একদল বিএনপি,  অপরদল আওয়ামী লীগ। আমার মামা বিএনপি করতেন। তারপর কেস শুরু হলো। উনি কেস ঠুকে দিলেন ঠিক বাবার অভিষেকের আগে। কেস চলতে থাকলো।

দু’তিন বছর পর দেখলাম বাংলাদেশের প্রশাসন, রজার ইস্যুটাকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ে নিলো। আমাদের উত্তরাধিকারের মামলা পরিণত হলো আওয়ামী লীগ ও বিএনপির লড়াইয়ে। আমাদের মধ্যে বিভাজন বাড়লো।

বাংলানিউজ: বান্দরবানের আঞ্চলিক রাজনীতিকে কিভাবে দেখেন?

নেলী: বান্দরবানের রাজনীতি খুবই নোংরা। ভালো মানুষ কেউ খোঁজে না। শুধু টাকা বৈভব নিয়ে সবাই চলে। টাকার কারণে যাকে কেউ চেনে না,  সে সামনের চেয়ারে এসে বসতে পারে। অনেক কমিটিতে আমি আছি। কিন্তু যদি কোনো কারণে আমি কোনো প্রোগ্রামে না যেতে পারি তাহলে আমার নামটা খচ খচ করে কেটে দেবে। কারণ আমি কোনো পলিটিক্যাল ফিগার না।

বাংলানিউজ: আপনার নিজের রাজনীতি করার ইচ্ছা নেই?

নেলী: না, তেমন কোনো ইচ্ছা নেই। আওয়ামী লীগ, বিএনপি থেকে আমাকে ডাকে। কিন্তু আমি যাব না। আমি এখন যেভাবে আছি, যা আছি, ভালো আছি। অন্তত মানুষ আমাকে গালি তো দেয় না। কোন কিছুই ইলেকশনের জন্য করি না। কারণ, আমিতো নির্বাচনে দাঁড়াবো না । আমি আমার মতো চলছি।

বোমাং ‍রাজপরিবারের ইতিহাস সংক্ষেপ
১৭২৭ সালে বোমাংগ্রী (মহাসেনাপতি) কাংহ্লাপ্রু তার অনুসারীদের নিয়ে সাঙ্গুনদীর তীরবর্তী বান্দরবানে বসতি গড়ে তোলেন। ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে শাসন পরিচালনা করেন পাঁচজন বোমাংগ্রী। ১৯০০ সালে বোমাংগ্রী সানাইঞোর আমলে ‘চিটাগাং হিলট্রাক্টস রেগুলেশন ১৯০০’ প্রণয়নের মাধ্যমে ডেপুটি কমিশনারের পাশাপাশি সার্কেল চিফ, মৌজা হেডম্যান, কারবারি, রোয়াজা ইত্যাদি পদ সৃষ্টি করে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব সার্কেল চিফকে দেওয়া হয়।

বান্দরবান ও রাঙামাটির কিছু অংশ নিয়ে বোমাং সার্কেল,  রাঙামাটিতে চাকমা সার্কেল এবং খাগড়াছড়ি জেলায় মং সার্কেল গঠন করা হয়। তখন থেকে সার্কেল চিফরা রাজা হিসেবে পরিচিত। রাজারা নিজ এলাকার মানুষের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সম্মানিত ব্যক্তি।

২০১৩ সাল পর্যন্ত বোমাং সার্কেলে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৬ জন রাজা। সর্বশেষ রাজা ছিলেন সদ্যপ্রয়াত ক্য সাইন প্রু চৌধুরী। রাজা অং শৈ প্রু চৌধুরী মারা যাওয়ার পর ২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাজকীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে রাজা ক্য সাইন প্রু চৌধুরী বান্দরবান বোমাং সার্কেলের ১৬তম রাজা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গত ৬ ফেব্রুয়ারি নিজ বাসভবনে ১৬তম এ রাজা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

বোমাং সার্কেল এখন ১৭তম রাজার অভিষেকের অপেক্ষায়। ১৬তম রাজা ক্য সাইন প্রু চৌধুরীর (কেএস প্রু) কন্যা ডনাই প্রু নেলীর চাচাত ভাই ইঞ্জিনিয়ার উ চ প্রু-র রাজা হিসাবে অভিষেক অনুষ্ঠিত হবে  আগামী ২৪ এপ্রিল।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৩
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।