ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ শ্রাবণ ১৪৩২, ২২ জুলাই ২০২৫, ২৬ মহররম ১৪৪৭

ফিচার

পরিবেশ রক্ষায় গবেষণা করতে চাই: আব্দুল্লাহ আল লোমান

সাদিয়া ফাতেমা কবীর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:০৯, মার্চ ২৩, ২০১৩
পরিবেশ রক্ষায় গবেষণা করতে চাই: আব্দুল্লাহ আল লোমান

স্কুল জীবনে ক্লাসের প্রথম হওয়া ছেলেটিকে আমরা সবাই মিলে ‘আঁতেল’ নামে ডাকতাম। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা আর হাতে সবসময় বই নিয়েই এদের জগৎ।

তবে আব্দুল্লাহ আল লোমানের ক্ষেত্রে দৃশ্যপট একেবারেই অন্যরকম। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো এই ছেলেটি স্কুল জীবনে কোনও পরীক্ষায় কখনও প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি।

কিন্তু বন্ধুমহলে তার পরিচিতি আঁতেলের চেয়ে আড্ডাবাজ হিসেবেই বেশি জনপ্রিয়।

ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন ইঞ্জিনিয়ার হবেন । ছোটবেলার সেই স্বপ্ন বুকে নিয়েই জামালপুরের সরিষাবাড়ি আর ইউ টি হাই স্কুল থেকে এসএসসিতে সর্বোচ্চ জিপিএ নিয়ে ভর্তি হন নটরডেম কলেজে। এইচএসসিতেও তার দখলে ছিল সর্বোচ্চ জিপিএ। অতঃপর বুয়েটে ভর্তি হন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। ক্যামিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় থেকেই একটু একটু করে স্বপ্নের গণ্ডিটাকে বাড়িয়ে তুলছিলেন।

আড্ডাপ্রিয় স্বপ্নবাজ ছেলেটি সেই স্বপ্নের পথ ধরেই চতুর্থ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার আগেই বিশ্বসেরা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফল ছাড়া ডাক পাবেন এমনটা আশা করলেও নিশ্চিত ছিলেন না।

কিন্তু ভাগ্য তার সুপ্রসন্ন। সেই সুপ্রসন্নতার হাত ধরেই বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব অ্যাক্রনে পিএইচডি করছেন। তার কাছে জানতে পারি পিএইচডি’র গবেষণার বিষয়ে।

পিএইচডি গবেষণার সময়ে তিনি ‘অ্যারাবিটল’ নামে সম্পূর্ণ নতুন অ্যালকোহল সুগারের পিউরিফিকেশন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে ক্যামিকৌশলে যোগ করেছেন নতুন মাত্রা।

এই পিউরিফিকেশন পদ্ধতির উদ্ভাবক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাটেন্ট অফিসে তার নামে একটি প্যাটেন্ট ও অ্যাপ্লিকেশন হয়েছে। প্যাটেন্টের কাজ চলছে এখনও। সম্প্রতি তার সাথে কথা হল গবেষণা সহ বিভিন্ন বিষয়ে।

আপনার গবেষণার বিষয়টি সম্পর্কে কিছুটা শুনেছি। এখন আপনার কাছে জানতে চাই কিভাবে আপনি এই গবেষণার সাথে যুক্ত হলেন?

আমি যুক্তরাষ্ট্রে আসি ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে। এখানে আমি পিএইচডি’র সুপারভাইজার হিসেবে পাই অধ্যাপক লু কুয়াং ঝু কে।

আমাদের ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরিতে সেসময় কিছু  গবেষণা প্রজেক্টের সঙ্গে অধ্যাপক লু’র মাধ্যমেই পরিচিত হই। অনেকগুলো প্রজেক্টই ভালো লেগেছিল কিন্তু আমি কাজ করতে আগ্রহী হই বায়োফুয়েল সম্পর্কিত প্রজেক্টে।
যেহেতু বায়োফুয়েলের কথা চলেই এলো তাই একটু বলে নেই বায়োফুয়েল শক্তির একটি অন্যতম পরিবেশবান্ধব রূপ। কিন্তু বায়োফুয়েল উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি অনেকক্ষেত্রেই বেশ ব্যয়বহুল তাই পরিবেশবান্ধব হওয়া সত্ত্বেও এটি বাজারজাতকরণ সম্ভব হচ্ছেনা।

ব্যয়বহুল হওয়ার অনেকগুলো কারণের মাঝে একটি হল এটি যখন উৎপাদিত হয় তখন বায়োফুয়েলের সাথে সহ উৎপাদান হিসেবে প্রচুর পরিমাণে অবিশুদ্ধ গ্লিসারল উৎপন্ন হয় যা গ্লিসারিন হিসেবে বাজারজাতকরণ অনেকবেশী খরচসাপেক্ষ।

একারণে এই  অবিশুদ্ধ গ্লিসারল গুলোকে বিশুদ্ধ করে কাজে লাগানো সম্ভব হয় না। বর্জ্য হিসেবেই নিষ্কাশিত হয়ে যায় গ্লিসারলের এই বিপুল ভাণ্ডার।

কিন্তু এই গ্লিসারলকে যদি কোনভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হয় তবে বায়োফুয়েল নামক এই পরিবেশবান্ধব শক্তির উৎপাদন হতে পারে অনেক বেশি সুলভে। মূলত এরকম চিন্তা থেকেই গবেষণার কাজটি শুরু করেছিলাম।    

কিন্তু আমি যতদূর শুনেছি আপনি অ্যারাবিটল নামক একটি সম্পূর্ণ নতুন অ্যালকোহল সুগারের পিউরিফিকেশন পদ্ধতির উদ্ভাবক। তাহলে সেটি কি এই অবিশুদ্ধ গ্লিসারল নিয়ে কাজ করতে গিয়েই উদ্ভাবিত ?

হ্যা। সেই সময়টাতে আমাদের ল্যাবরেটরিতে অবিশুদ্ধ গ্লিসারলগুলোকে কাজে লাগানোর জন্যই এগুলোকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে ফারমেন্টেশন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে নতুন কোনও প্রোডাক্ট উৎপাদনের চেষ্টা করা হচ্ছিল।

তখন আমি এই প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত হই। আমরা মূলত অবিশুদ্ধ গ্লিসারল ফারমেন্টেশন করেই অ্যারাবিটল উৎপন্ন করি। ফারমেন্টেশনের কাজটুকু আমি এবং আমার ল্যাবমেট যৌথভাবে করলেও এর বিশুদ্ধিকরণ বা পিউরিফিকেশন পদ্ধতিটি আমার উদ্ভাবন ছিল।

আপনার কাছেই জানলাম এটি সুগারের সাবস্টিটিউট অর্থাৎ অ্যালকোহল সুগার। বাজারের স্বাভাবিক চিনির সাথে তুলনায় এটি কতটা এবং কেন অনন্য?

অ্যারাবিটল হল একটি পাঁচ কার্বন বিশিষ্ট সুগার সাবস্টিটিউট। আমি আগেও বলেছি এটি সম্পূর্ণ নতুন একটি প্রডাক্ট যা আগে কখনই তৈরি করা হয়নি। স্বাভাবিক চিনির তুলনায় এতে শতকরা ৬০ ভাগ ক্যালরি কম থাকে।
যার ফলে এটি ডায়াবেটিক ফুডগুলোতে ব্যবহার করা সম্ভব। যেসব ক্ষেত্রে ক্যালরি নিষিদ্ধ সেসব ক্ষেত্রে এটি এগিয়ে। মিষ্টি স্বাভাবিক চিনির তুলনায় ২.৪ গুণ বেশি। এছাড়াও ক্যাভিটি হওয়া থেকে দাঁতকে বাঁচাতে পারে।
আমরা যখন চিনি বা চিনি দিয়ে কোনো খাবার খাই তখন আমাদের মুখের ভেতর অবস্থিত ব্যাকটেরিয়াগুলো গ্লুকোজের সান্নিধ্যে তাঁদের মেটাবোলিজম বাড়িয়ে দেয়।

মেটাবলিজমের একটি ধাপেই এই ব্যাকটেরিয়াগুলো কিছু এসিড নিঃসরণ করে যা দাঁতের ক্যাভিটির জন্য দায়ী। অ্যারাবিটল এই ব্যাক্টেরিয়াগুলোর বৃদ্ধি থামিয়ে দিয়ে দাঁতকে ক্যাভিটি থেকে দূরে রাখে।

সেই সাথে মাউথফ্রেশ্নারের মত কাজ করতে পারে। এছাড়াও অ্যারাবিটল দিয়ে বায়োডিগ্রেডেবল পলিমার বানানো সম্ভব। এই বায়োডিগ্রেডেবল পলিমার দ্বারা উৎকৃষ্টমানের সার্জিকাল অ্যাপ্লায়েন্স তৈরি করা সম্ভব। শুধু এটুকুই নয় বায়োফুয়েলের সহ উৎপাদ হিসেবে প্রাপ্ত অবিশুদ্ধ গ্লিসারল থেকে যদি এটি তৈরি করা হয় তবে বায়োফুয়েল উৎপাদনের খরচ কমে যাবে ২০ শতাংশ পর্যন্ত।    

আপনি বললেন অ্যারাবিটল উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে আপনি কাজ করেছিলেন যৌথভাবে কিন্তু পরবর্তীতে আপনার ল্যাবমেট নয় বরং আপনার নামেই প্যাটেন্ট ফাইল হয়। কেন?

আসলে প্যাটেন্টটি আমার নামে ফাইল হবার পেছনে মূল কারণ আমি প্রোডাক্টটির বিশুদ্ধিকরণ বা পিউরিফিকেশন পদ্ধতি নিয়ে কাজ করেছিলাম।

যেকোনো প্রোডাক্টের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে উদ্ভাবনের পর সেটির বিশুদ্ধিকরনের সফলতার উপর। অ্যারাবিটলের ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়।

এছাড়া পুরো প্রক্রিয়াটিতে ফারমেন্টেশনের অংশটুকুকে যদি ২০ ভাগ বলা যায় তবে বিশুদ্ধিকরণ বা পিউরিফিকেশনের অংশটুকু বাকী ৮০ ভাগ।

আমি ফারমেন্টেশন বা প্রোডাকশনে যৌথভাবে কাজ করেছিলাম সেইসাথে পিউরিফিকেশনের কাজটুকু করি একাই। সেকারনেই এরকম হয়েছিল।

আপনি যে ধরনের গবেষণা করছেন বাংলাদেশে এধরনের গবেষণা কি হয়? না হলে কেন হচ্ছে না বলে আপনি মনে করেন?

বাংলাদেশে আসলে এধরনের গবেষণা সেভাবে হয় না বা এখন পর্যন্ত হচ্ছে না। কেন হচ্ছেনা সেটা বলতে গেলে আসলে বেশ কিছু বিষয় সামনে চলে আসে।

আমাদের দেশে কলকারখানাগুলোতে বর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যাপারটা সেরকমভাবে গুরুত্ব পায়না যেমনটা এখানে পায়। এখানে যেহেতু বর্জ্য নিষ্কাশনে অনেক বেশি সতর্কতা মেনে চলতে হয় তাই কারখানাগুলোর উদ্দেশ্যই থাকে বর্জ্যগুলোকে যথাসম্ভব কাজে লাগানো। একারণে এধরনের গবেষণাগুলো এখানে হচ্ছে।

বাংলাদেশে এরকম গবেষণার সুযোগ রয়েছে কি?

অবশ্যই সুযোগ আছে। আমাদের দেশে কলকারখানার বর্জ্যগুলো দেশের পরিবেশের সার্বিক শুদ্ধতা বিনষ্টের জন্য ব্যাপকাংশে দায়ী। তাই এধরনের গবেষণা এবং গবেষণার প্রতিফলন বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরী।

এরকম গবেষণার জন্য কি কি প্রয়োজন? এরকম গবেষণা করতে হলে কি ক্যামিকৌশলে উচ্চতর ডিগ্রী লাগবে?

সব থেকে আগে প্রয়োজন আগ্রহ এবং ইচ্ছার। আর  প্রয়োজনের মধ্যে কয়েকটা ফারমেন্টার এবং কিছু মোটামুটি নাগালের মধ্যে থাকা মুল্যমানের যন্ত্র দিয়েই গবেষণার শুরুটা করা সম্ভব।

পরবর্তীতে এটিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আর গবেষণা করতে উচ্চতর ডিগ্রী অবশ্যই সহায়ক। তবে তা আবশ্যক নয়। শুধুমাত্র ক্যামিকৌশলে পড়ুয়ারাই নন বরং কেমিস্ট, বায়োকেমিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্টদের যে কেউ এই গবেষণায় আসতে পারেন।

তবে সবকিছুরপরও আবার বলব গবেষণার ক্ষেত্রে সবথেকে বেশি প্রয়োজন ধৈর্য, আগ্রহ ও ইচ্ছে।    

এখন কি বিষয়ে কাজ করছেন?

বর্তমানে আমি সয়াবিন নিয়ে কাজ করছি। সয়াবিন থেকে তেল নিষ্কাশনের পর এর যে সলিড অংশটুকু থাকে সেটা ফেলে দেওয়া হয়। আবার অনেকে খুব নগণ্য মুল্যে বিক্রি করে দেয়।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি খুবই মুল্যবান একটি যৌগ পদার্থ। এতে ৫০ ভাগের বেশি প্রোটিন রয়েছে।

যদি এই প্রোটিনটুকু যথাযথভাবে পৃথক করা সম্ভব হয় তবে এটি একটি উচ্চমানের প্রোটিন সাপ্লিমেন্টেশন হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। আমার এখনকার গবেষণা এই বিষয়টি নিয়েই।  

বাংলাদেশে ফেরার ইচ্ছে আছে?

ফিরে আসার ইচ্ছে আমার শুরু থেকেই ছিল, এখনও আছে। সবসময়ই দেশের জন্য কিছু করার আকাঙ্ক্ষা আমার মাঝে কাজ করে ।

তাই পিএইচডি শেষ করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে কিছুদিন বিদেশ থাকলেও বাংলাদেশই হবে আমার প্রকৃত ঠিকানা বলেই আমি আশা রাখি।

বুঝতে শেখার পর থেকেই দেশের জন্য কিছু করার একটা তাগিদ ভেতর থেকে অনুভব করি। দেশের সার্বিক পরিবেশ রক্ষায় এধরনের গবেষণা ও তার প্রতিফলনের কোনও বিকল্পই নেই বলেই  দেশে ফিরে মূলত এধরণের গবেষণা নিয়েই কাজ শুরু করতে চাই। ।

পরবর্তীতে কাজের পরিসর বিভিন্নদিক থেকেই বড় করার ইচ্ছেও মাথায় আছে। দেখা যাক কদ্দুর কি করতে পারি। মোটকথা স্বপ্ন দেখতে ভাললাগে তাই স্বপ্ন দেখি। কতটা কি করতে পারব তা সময়ই বলে দেবে তাই সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাই।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৩
সম্পাদনা: শেরিফ আল সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।