ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ শ্রাবণ ১৪৩২, ২২ জুলাই ২০২৫, ২৬ মহররম ১৪৪৭

ফিচার

এহসানের মুড মিটার

শেরিফ আল সায়ার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:৫৯, জানুয়ারি ৭, ২০১৩
এহসানের মুড মিটার

বাংলাদেশের তরুণেরা গবেষণায় এগিয়ে। এ কথা তো সবারই জানা।

তবে সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশ এখনও গবেষণায় পিছিয়ে। বিশ্বকে যারা গবেষণায় তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন, তাদের ‍অধিকাংশই থাকেন নিভৃত প্রবাসে।

অথচ দেশে থেকেও অনেক তরুণ সুযোগের অভাবে গবেষণায় মন দিতে পারেন না। এটি দুঃখজনক। কিছুদিন আগে এহসান হক নামে এক তরুণ গবেষকের সঙ্গে পরিচয় হলো। তার উদ্ভাবন নিয়ে আগ্রহ জন্মায় কথা বলার পর। তিনি হুট করেই বলে বসেন, আপনার হাসি মেপে দিচ্ছি।

এতো অবাক করা কথা! যন্ত্র নাকি মানুষের হাসি মাপতে পারবে! এটা কি করে সম্ভব। এহসান হেসে ওঠেন। বলেন, মানুষের বানানো যন্ত্র সবই পারে। মাংসপেশির নড়াচড়া, ভ্রু কোঁচকানো বা একটু ঠোঁট চেপে ধরার প্রবণতা যন্ত্রকে ফাঁকি দিতে পারবে না।
 
চটজলদি আমি দাঁড়িয়ে গেলাম ৬ ফুট লম্বা এক স্ক্রিনের সামনে। একটু মুচকি হেসে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গেই মিটার মেপে জানিয়ে দিল আমি মাত্র ৫০ ভাগ সুখী।

অদ্ভুত! আর এ অদ্ভুত কাজটি করেছেন বিখ্যাত এমআইটির মিডিয়া ল্যাবে কাজ করা বয়সে দুই তরুণ। তাদের হাতেই তৈরি মানুষের মেজাজ পরিমাপের যন্ত্র ‘এমআইটি মুড মিটার’। এ দুই তরুণের একজন হলেন বাংলাদেশের এহসান হক।

তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা জরুরি। এহসান হক বাংলাদেশেই বেড়ে ওঠেছেন। ঢাকার উদয়ন স্কুল থেকে এসএসসি। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি। উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে পেনসিলভ্যানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং স্নাতক। এরপর ইউনিভার্সিটি অব মেমফিস থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন।

এভাবে এহসান ছুটে গেছেন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়? কেন? তিনি মুচকি হেসে বললেন, আমি নতুন জায়গা, নতুন মানুষ পছন্দ করি। এ জন্যই জায়গা বদলানো। এ জন্যই পিএইচডির জন্য চলে গেছি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে।

গবেষণার মূল বিষয় মানুষের মুখের নড়াচড়া ও কণ্ঠ বিশ্লেষণ করে যন্ত্রকে মানুষের আবেগ শনাক্ত করতে সহায়তা করা। তবে তার আগে ২০০৯ সালে ওয়াল্ট ডিজনির গবেষণাগারে প্রথম স্বয়ংক্রিয় রোবট—যা দেখতে, শুনতে এবং নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। এমন রোবট তৈরিতে সরাসরি কাজ করেছেন বাংলাদেশের তরুণ এহসান।

এমআইটির শিক্ষার্থী জ্যাভিয়ের হার্নান্দেজ এবং এহসান হক সম্মিলিতভাবে মুড মিটারের কাজটি শুরু করেন। এমআইটির ১৫০তম জন্মদিনে এ প্রকল্প প্রদর্শিত হয়। এ মুহূর্তে এমআইটি ক্যাম্পাসের ৪টি গুরুত্বপূর্ন জায়গার স্থাপিত ৪টি ক্যামেরার মাধ্যমে মানুষের মুখের ভঙ্গী বিশ্লেষণ করে ওই স্থানে মানুষ কত বেশি আনন্দিত তার একটি তাৎক্ষণিক রিপোর্ট দিচ্ছে এহসানের তৈরি প্রকল্প।

শুরুর গবেষণা:

এ গবেষণার শুরুতেই নানামুখি প্রতিবন্ধকতা ছিল। আনন্দ আর হতাশার অনেক নমুনা প্রয়োজন। কোথায় পাবো এত নমুনা? এর আগে যত ধরনের গবেষণা হয়েছে তার অধিকাংশই ছিল অভিনয় করা নমুনা দিয়ে।

যেমন গবেষণার সঙ্গে অসম্পৃক্ত মানুষদের ক্যামেরার সামনে নিয়ে এসে অনুরোধ করে বলছি, তুমি দয়া করে একটু আনন্দের ভাব দেখাও তো এবং এরপরে ভাব করো, যেমন তুমি খুব হতাশ।

কিন্তু এ ধরনের গবেষণায় অভিনয় করিয়ে যে তথ্য পাওয়া যাবে তা সত্যি না। আমাদের দরকার রিয়েল টাইম ডাটা। কম্পিউটার অ্যালগোরিদম অভিনয় কর‍া নমুনাকে শনাক্ত করতে পারছে। কিন্তু বাস্তবে মানুষের অনুভূতিকে প্রথমদিকে কম্পিউটার অ্যালগোরিদম শনাক্ত করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।

কম্পিউটার অ্যালগোরিদমের জন্য প্রয়োজন স্বতফুর্ত অভিব্যক্তি। এ জন্য আমাকে একটি ফাঁদ পাততে হলো। তাদের আমি বিভিন্ন উপায়ে হাসানোর এবং হতাশ হওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম।

আমি নমুনা পেলাম। শুরু হলো বিশ্লেষণ। দু ধরনের হাসির নমুনা। একটি হলো আসলেই হাসির ঘটনা। আরেকটি ছিল হতাশার মাঝে থেকেও হাসি।

শুরুতে বলা হয়নি, আমি কিন্তু হাসির নমুনাগুলোকে ভিডিও করেছি। কারণ স্থিরচিত্র বিশ্লেষণ করে লাভ নেই। তাই গোটা ভিডিওগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ শুরু করলাম। কম্পিউটার সায়েন্সের অন্যমত একটি বিষয় হচ্ছে ‘মেশিন লার্নিং’।

এ জন্য প্রয়োজন গাণিতিক সমীকরণের সমাধান। সমীকরণে দেখতে পেলাম, স্থিরচিত্রে হাসিগুলোর মাঝে তেমন পার্থক্য নেই। তবে দুই হাসির অগ্রগতি বেশ ভিন্ন। আনন্দের স্বতস্ফুর্ত হাসি ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে তীব্র হয়, আর হতাশার হাসি সৃষ্টি হয় দ্রুত আর মিলিয়েও যায় বেশ দ্রুত।

এরপর অনেক ভেবে মেশিন লার্নিংয়ের ওপর অ্যালগোরিদম করে নিলাম। দেখলাম শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি সময় দু ধরনের হাসিকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম হচ্ছে কম্পিউটার।

এসব কাজে যখন আমি মগ্ন তখন হুট করেই আমার অধ্যাপক এসে বললেন, তোমার এ মিটার মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দাও। সবার জন্য উন্মুক্ত করেই এল নতুন বিস্ময়। মানুষ মানুষের হাসি যতটুকু না বুঝতে পারছে তার চেয়ে বেশি বুঝতে পারছে আমার মেশিন। জটিল এবং অবাক তথ্য!

মুড মিটারের লাভ কি?

এটা মানুষের কি উপকারে আসবে এমন প্রশ্নের জবাবে এহসান বাংলানিউজকে বলেন, গবেষণায় তো মানুষের উপকারের কথাও ভাবতে হবে। অটিজমে আক্রান্ত মানুষের অভিব্যক্তি বোঝা সত্যিই কঠিন। তবে তাদের অনভূতিও বুঝতে আমাদের মুড মিটার এখন পুরোপুরি প্রস্তুত।

এ ছাড়াও আর্টিফিশাল ইন্টালিজেন্সিতে এ আবিষ্কার অন্যরকম মাত্রা যোগ করতে পারবে। এ গবেষণায় প্রমাণ হয়, মানুষের অনুভূতি বুঝবে সক্ষম এ যন্ত্রটি। এটাই তো গবেষণায় যুগান্তকারী ঘটনা।

শেষদিকে খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন দেশে ফিরছেন কবে? এহসান হক বলে ফেলেন, ফিরতে তো হবেই। তবে আরও কাজ করা জরুরি। আমি যে ধরনের কাজ করতে চাই সে সব কাজ বাংলাদেশে করা কঠিন। তবে দেশে ফিরব। মনটা তো দেশেই পড়ে আছে।

বাংলাদেশ সময় ১৬৩২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০১৩
সম্পাদনা: সাব্বিন হাসান, বিভাগীয় সম্পাদক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।