ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৯ জুলাই ২০২৫, ০৩ সফর ১৪৪৭

ফিচার

লেক অ্যানেসি: আল্পসের কোলে হারানো এক প্রেমিকার দেখা

মুমিন আনসারি, ফ্রান্স করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:৪০, জুলাই ২৮, ২০২৫
লেক অ্যানেসি: আল্পসের কোলে হারানো এক প্রেমিকার দেখা দক্ষিণ ফ্রান্সের প্রসিদ্ধ স্বচ্ছ পানির লেক অ্যানেসি | সংগৃহীত ছবি

লেক অ্যানেসি। দক্ষিণ ফ্রান্সের প্রসিদ্ধ স্বচ্ছ পানির লেক।

চারপাশে আল্পস পর্বতের ঢালে ঘেরা একটি প্রাকৃতিক দূর্গ। পরিষ্কার ও ঠান্ডা পানির লেক হিসেবে পুরো ইউরোপজুড়েই রয়েছে এর খ্য্যাতি। পাশেই যেন লেকের শ্রেষ্ঠত্বকে আগলে রাখতে মেঘের কোলে মাথা ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দী প্রাচীন আল্পস পর্বতের একাংশ। পরিবেশ বিপর্যয়ের যুগে এই পর্বত অতি মমতায় আগলে রেখেছে এই লেককে। স্থানীয় ফরাসিরা একে ‘লেক দা’অ্যানেসি’ নামেই ডাকে।

দিনটা ছিল শনিবার। প্যারিসে সূর্য ওঠার আগেই জীবনযুদ্ধ শুরু হয়। তবে ব্যতিক্রম শনিবারে, কেউ সকালে ঘুম থেকে জাগে না খুব একটা। পুরো সপ্তাহের ক্লান্তি দূর করার জন্য সাপ্তাহিক ছুটির দিনটি বড়ই চুপচাপ আর শান্তভাবে শুরু হয়। তবে, আমাদের ফ্রান্স-বাংলাদেশ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের (এফবিজেএ) সদস্যদের চোখে ঘুম টুটে গেছে। কেননা আজকেই স্বপ্নের সেই অ্যানেসি লেক দেখতে যাওয়ার দিন।

প্যারিস থেকে অ্যানেসি শহরে দূরত্ব প্রায় ৬১০ কিলোমিটার। ট্রেন ও বিমানযোগে যাওয়া সম্ভব হলেও আমরা বেছে নিলাম এক অ্যাডভেঞ্চারাস পথ। আমরা যাব সড়কপথে ড্রাইভ করে। দুটো গাড়ির বন্দোবস্ত হলো। চালাবেন অ্যাসোসিয়েশনের দুজন সম্মানিত সদস্য। যাওয়ার পথে দুই-চারবার আমরা কফিশপ দেখে থামব আর গাড়ির ফুয়েল নেব।



আমরা প্রথমে লিওন শহরে পৌঁছালাম। ওখানেই রাত্রিযাপন করলাম। পরদিন সকালেই রওয়ানা হলাম লেক অ্যানেসির দিকে। ভোরের আলো ফুটতেই অ্যানেসি শহর ধীরে ধীরে জেগে ওঠে। পর্যটকের পদচারণায় ও কোলাহলে মুগ্ধ চারপাশ। স্নিগ্ধ বাতাস, পাহাড় ছুঁয়ে আসা ঠান্ডা হাওয়া আর তার মাঝখানে বিস্তীর্ণ নীল জলরাশির—লেক অ্যানেসি। অবশেষে আমাদের মোলাকাত হলো।

দেশে কক্সবাজারে আমার বাড়ি। সমুদ্রের ঢেউয়ে মাথা রেখে আমার বেড়ে ওঠা। সেখানে বেড়ানোর পর পৃথিবীর কোনো জলাধারকে এত মায়াবী ও আকর্ষণীয় মনে হয়নি। কিন্তু অ্যানেসি লেক দেখার পর আমার এই ধারণা পালটে গেছে। যেন কয়েকযুগ পর দেখা হলো হারানো কোনো প্রেমিকার সঙ্গে, যার প্রেমে আপাদমস্তক ডুবিয়ে অবলীলায় ভেসে থাকা যায় জীবনভর।

আগেই জানিয়েছি, ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্বে আল্পস পাহাড়ের কোলঘেঁষে এই হ্রদের অবস্থান। স্থানীয়রা বলেন, “এখানকার জল এত স্বচ্ছ যে, পাথর গুনে দেখা যায়”। সত্যিই তাই। হ্রদের কিনার ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে দেখা যায় জলের নিচে ভেসে থাকা কাঁকড় আর নুড়ি পাথর। গ্রীষ্মকালে হ্রদের রং বদলে যায়। কখনো ফিরোজা, কখনো হালকা সবুজ। পাড়জুড়ে সারি সারি নৌকা, কায়াক আর প্যাডেল বোট। পানিতে ভেসে বেড়ায় হাঁসের পাল।

এখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে সাঁতার, ফিশিং আর ওয়াটার স্পোর্টস। লেকের ধারে বালুমাখা মাঠে হ্যান্ডবল খেলছে কেউ, কেউ উদোম শরীরে সানস্ক্রিন মাখছে, কেউবা উপুড় হয়ে তোয়ালের ওপর শুয়ে নিচ্ছে সানবাথ।

হ্রদের চারদিকে রয়েছে প্রায় ৪০ কিলোমিটার লম্বা সাইকেল ট্র্যাক। সকালে বা বিকেলে শত শত মানুষ সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ান। একদিকে মাথাভর্তি মেঘ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আল্পস, অন্যদিকে তারই গোড়ায় পরিষ্কার পানির হ্রদ আর মাঝখানে সুবিশাল সবুজ অরণ্য। এমন দৃশ্য আর প্রকৃতির অপরূপ মিশেল ইউরোপের অন্য কোথাও সহজে মেলে না।

শুধু প্রকৃতি নয়, অ্যানেসি শহর নিজেই যেন এক খোলা গল্পের বই। ছোট ছোট খাল আর রঙিন বাড়িঘর দেখে মনে হয়, যেন ভেনিস শহরের কোনো অংশ এখানে উঠে এসেছে। শহরটাকে তাই অনেকে ভালোবেসে ডাকে ‘সাভোয়ার ভেনিস’। পুরোনো পাথরের সেতু, সাদা, গোলাপি আর হলুদ রঙের বাড়ি, জানালায় ঝোলানো ফুলের ঝাড়—সব মিলিয়ে যেন পোস্টকার্ডের মতো ছবি।

প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক ভিড় করেন এখানে। তবে লেক অ্যানেসির সৌন্দর্য সবচেয়ে বেশি ধরা দেয় খুব সকালে কিংবা সন্ধ্যায়। সূর্যোদয়ে কিংবা সূর্যের বাড়ি ফেরার সময় প্রতিফলিত আলোতে লেকের জলরাশি সোনালি হয়ে ওঠে। আশপাশটা ভরে ওঠে ক্রিস্টাল আলোয়। পানির আন্দোলনের সঙ্গে আলোগুলো নাচতে থাকে পুরো শহরজুড়ে। এ এক অবিশ্বাস্য ও অদ্ভুত রকমের সৌন্দর্য।

লেকের একপাশে রয়েছে লেক দা’অ্যানেসি ক্যাসেল—মধ্যযুগীয় এক দুর্গ। দুর্গের চূড়া থেকে দেখা যায় পুরো হ্রদ। শীতের মৌসুমে দূরে সাদা বরফে ঢাকা আল্পস, নিচে নীল জল আর শহরের ঘরবাড়ি। অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত শীতকালে হ্রদের চারপাশে পড়ে হালকা তুষার। তখন পানি থাকে একেবারে শান্ত, পরিবেশ থাকে ধীরগতির। আর গ্রীষ্মকালে হয় উৎসবের মতো ব্যস্ততা। লেক ঘিরে পুরো শহর ফিরে পায় জীবন, হয়ে ‍ওঠে প্রাণবন্ত।



পর্যটকদের জন্য আছে অসংখ্য ক্যাফে ও রেস্টুরেন্ট। হ্রদের ধারে বসে ফরাসি পেস্ট্রি আর কফি হাতে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয় স্থানীয়রা। যদি হাতে থাকে কোনো বই, তবে আর কথা নেই। একটা দিন পার করে দেওয়ার জন্য স্থানীয়দের অন্য কিছুর প্রয়োজন নেই। ফরাসিদের কাছে লেক অ্যানেসি শুধু একটা হ্রদ নয়, বরং তাদের জীবনের এক বিরাট অংশ।

প্যারিস থেকে ট্রেন ধরে এখানে আসতে সময় লাগে সাড়ে তিন ঘণ্টা। আর সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে গাড়িতে আসতে মাত্র চল্লিশ মিনিট সময় লাগে। জানা যায়, জেনেভায় চাকরি করে এমন অনেক চাকরিজীবী অ্যানেসি শহরে বসবাস করে। এখানে জীবন যাপন খরচ তুলনামূলক কম হওয়ায় তারা বসবাসের জন্য ফ্রান্সকে পছন্দ করেছেন।

পরিশেষে যারা প্রকৃতি ভালোবাসেন, শান্তি খুঁজছেন কিংবা শুধু নতুন কিছু দেখতে চান, তাদের জন্য লেক দা’অ্যানেসি হতে পারে নিঃসন্দেহে এক বিশেষ ঠিকানা। এখানে সময় যেন ধীরে চলে, মানুষ যেন একটু বেশি হাসে, আর প্রকৃতি যেন ঠিক নিজের ছন্দে বাঁচে।

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।