ঢাকা, বুধবার, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৩ জুলাই ২০২৫, ২৭ মহররম ১৪৪৭

ফিচার

‘নীলচাঁদের’ সাতকাহন

জোয়েল কর্মকার, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:০০, আগস্ট ৩০, ২০১২
‘নীলচাঁদের’ সাতকাহন

ঢাকা: পূর্ণিমা একটি নিয়মিত মহাজাগতিক ঘটনা। ছোটবেলা থেকেই আমরা এর সাথে পরিচিত।

তবে আগামী ৩১ আগস্ট, ২০১২ তারিখে যে পূর্ণিমাটি আসছে তা সাধারণ দৃষ্টিতে গতানুগতিক পূর্ণিমা মনে হলেও এর রয়েছে অন্য একটি বিশেষত্ব। এ পূর্নিমাটি হবে নীল চাঁদের পূর্ণিমা বা ব্লু  মুন। প্রতি ২ বছর ৭ মাসে একবার পৃথিবীর ব্লু  মুন দেখে থাকে। পরবর্তী ব্লু মুনের দেখা মিলবে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই।

ব্লু  মুন বা নীলচাঁদ
প্রচলিতভাবে আমরা প্রতি মাসে একটিমাত্র পূর্ণিমা দেখতে পাই, কিন্তু কখনো কখনো একই মাসে দু’টি পূর্ণিমা ঘটে থাকে। কোনো মাসের এই দ্বিতীয় পূর্ণিমাটিই হচ্ছে ব্লু  মুন। এক্ষেত্রে প্রথম পূর্ণিমাটি মাসের একদম শুরুতে বা শুরুর কাছাকাছি সময়ে হয়ে থাকে। চান্দ্র মাস ২৯.৫ দিনে সম্পন্ন হয়। ফলে ফেব্রুয়ারি মাস ছাড়া অন্য যে কোনো মাসেই দু’টি পূর্ণিমা ঘটতে পারে। কারণ ফেব্রুয়ারি মাসের দৈর্ঘ্য চান্দ্রমাসের চেয়ে কম।

ব্লু  মুন কেন ঘটে
সাধারণত সৌর বর্ষপঞ্জিতে বারোটি পূর্ণ চন্দ্র মাস হয়ে থাকে। এতে বারোটি পূর্ণিমা ঘটে। তবে সৌর মাসের তুলনায় চন্দ্র মাসের দৈর্ঘ্য কম। চান্দ্রমাস ২৯.৫ দিনে সম্পন্ন হয়। সাধারণ হিসেবে বলা যায়, চন্দ্র বছর সৌর বছরের তুলনায় গড়ে এগারো দিন কম হয়ে থাকে। এই অতিরিক্ত দিনগুলোর কারণে গড়ে প্রতি ২.৭ বছরেসৌরবর্ষপঞ্জীতে এমন একটি মাস পাওয়া যায় যখন একই মাসে দু’টি পূর্ণিমা ঘটে। একইভাবে প্রতি ১৯ বছরে ৭ বার এমন পূর্ণিমা পাওয়া যায়।

ব্লু  মুনেরও ব্যতিক্রম
ব্লু  মুন নিজেই একটি ব্যতিক্রম ঘটনা হলেও এর ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট কাল পরপর আরেকটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটে থাকে। এটি হচ্ছে একই বছরে দু’বার ব্লু মুনের দেখা পাওয়া। গড়ে প্রতি ১৯ বছরে মাত্র একবারই এমনটি ঘটে। সর্বশেষ ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি এবং মার্চ মাসে পরপর দু’বার ব্লু মুন দেখা গিয়েছিল। তবে এই ঘটনা শুধু জানুয়ারি এবং মার্চ মাসেই ঘটা সম্ভব। কারণ এই দুই মাসের মাঝখানের মাসটি সবচেয়ে ছোট অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাস যার ব্যাপ্তি সাধারণত মাত্র ২৮ দিন। তাই প্রতি ১৯ বছরে ফেব্রুয়ারি মাসটি একবার প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। তবে যদি জানুয়ারি এবং মার্চ মাসে পরপর এমন ঘটনা ঘটে সেক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারি মাসে কোনও পূর্ণিমা দেখা যাবে না। কারণ, জানুয়ারি মাসের একেবার শেষ দিকে পূর্ণিমা ঘটলে চন্দ্রমাসের হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাসে কোনও পূর্ণিমা না ঘটে মার্চ মাসের শুরুতে ঘটবে। এরকমটি আবার ঘটবে ২০১৮, ২০৩৭ সালে। এভাবে ১৯ বছর পরপর নিয়মিতভাবে।

ব্লু  মুন নামকরণ কেন
এই বিশেষ পূর্ণিমাকে ‘ব্লু  মুন’ বা ‘নীল চাঁদ’ নাম দেয়া হলেও দৃশ্যত এই পূর্ণিমায় চাঁদকে মোটেও নীল রঙের দেখায় না, বরং অন্য পূর্ণিমার মতই থাকে চাঁদ (গ্রহণকালে চাঁদকে কিছুটা লালচে দেখায়)। তাহলে ‘নীল চাঁদ’ নামের কারণ কি?

ইংরেজিতে Blue Moon পদটি দ্বারা কোনো অসাধারণ বা দুষ্প্রাপ্য ঘটনাকে প্রকাশ করা হয়। এই নামটি প্রায় চারশ’ বছর ধরেই প্রচলিত ছিল। তবে গত পঁচিশ বছর ধরে বর্ষপঞ্জিতে এই নামটি বিস্তৃতি লাভ করেছে। ‘অমাবস্যার চাঁদ’ বাক্যটি যেমন ‘সহজে দেখা মেলে না’ এ জাতীয় অর্থ বোঝাতে বাংলায় বাগধারা হিসেবে ব্যবহৃত হয়, ঠিক তেমনি ইংরেজিতে ‘once in a blue moon’ বাক্যটিও phrase হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ধারণা করা হয়, প্রাচীন সময়ে মানুষের মনের বিভিন্ন কুসংস্কার বা বিশ্বাস থেকে এই ‘ব্লু  মুন’ নামটি এসে থাকতে পারে। তবে সাম্প্রতিক সময়ের কিছু কিছু ঘটনা থেকে এই নামকরণের কিছুটা যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়, যা কিছুটা ঐতিহাসিকও বটে।

১৮৮৩ সালে ইন্দোনেশিয়ায় ক্রাকাতোয়া আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারণে পরবর্তী দুই বছর সূর্যাস্তের সময়টা সবুজ এবং চাঁদকে নীলাভ দেখা গেছে। এছাড়া ১৯২৭ সালে ভারতীয় মৌসুমী বায়ু দেরিতে আসার কারণে গ্রীষ্মকাল অতি দীর্ঘ হয়ে পড়ে, যা বায়ুমণ্ডলে ধূলার পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে। তখন রাতের আকাশে চাঁদকে নীলাভ দেখাত। পশ্চিম কানাডার বনাঞ্চলে দাবানলের কারণে ১৯৫১ সালে উত্তর আমেরিকার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের চাঁদকেও নীল দেখা গিয়েছিল। দাবনলের কারণে সৃষ্ট ধোঁয়া আকাশকে আচ্ছন্ন করে ফেলায় চাঁদকে এমন দেখা গিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ‘ব্লু  মুন’ প্রকৃতপক্ষে দেখতে মোটেও নীল নয়। তবে আকাশে ধুলোবালি বা ধোঁয়ার কারণে চাঁদকে সাময়িকভাবে নীলাভ মনে হতে পারে। এটি সময়ের ধারাবাহিকতায় সংঘটিত হওয়া একটি মহাজাগতিক ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

অমাবস্যা-পূর্ণিমার রসায়ন
চাঁদ নিজ অক্ষের উপর আবর্তনের সাথে সাথে পৃথিবীকেও প্রদক্ষিণ করে চলছে। পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরতে চাঁদের সময় লাগে ২৭.৩ দিন। এটি হচ্ছে চাঁদের নাক্ষত্রিক কাল বা সিডেরিয়াল পিরিয়ড। তখন সূর্য প্রতিদিন ১ ডিগ্রি করে পূর্ব দিকে এগুতে থাকে। অর্থাৎ এই সময়ে পৃথিবীও নিজের কক্ষপথে ১ ডিগ্রি করে এগিয়ে যায়। এ কারণে চাঁদ ২৭.৩ দিনে তার পূর্বের ‘নতুন চাঁদের’ অবস্থায় যেখানে ছিল আকাশের সেই অবস্থানে ফিরে এলেও সূর্য ততদিনে ২৭ ডিগ্রি পূর্বে এগিয়ে গেছে। তাই সূর্যের পটভূমিতে চাঁদকে নিজের কলা পূর্ণ করার জন্য এই অতিরিক্ত ২৭ ডিগ্রি পরিভ্রমণ করতে হয়। এর জন্য চাঁদের সময় লাগে ২৯ দিন ১২ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট ৩ সেকেন্ড বা সহজভাবে বললে সাড়ে ২৯ দিন, যা সাইনোডিক পিরিয়ড।

Moonনতুন চাঁদের দিন অর্থাৎ অমাবস্যা থেকেই চাঁদের মাস গণনা করা হয়ে থাকে। পৃথিবীকে প্রদক্ষিণের সাথে সাথে চাঁদের কলা পরিবর্তিত হতে থাকে। অমাবস্যার দিন চাঁদ সূর্যের মুখোমুখি অবস্থান করায় পৃথিবী থেকে চাঁদের অন্ধকারাচ্ছন্ন পিঠটি আমরা দেখতে পাই। এদিনের পর থেকে চাঁদ সূর্যের মুখোমুখি অবস্থান থেকে একটু একটু সরে যেতে থাকে। শুরু হয় শুক্লপক্ষ। সপ্তম দিনে চাঁদ সূর্য থেকে ৯০ ডিগ্রি সরে যায়। তখন আমরা অর্ধেক চাঁদ দেখতে পাই। চৌদ্দ থেকে পনেরোতম দিনে আমরা পূর্ণিমা দেখতে পাই। এসময়ে চাঁদ সূর্যের বিপরীত দিকে অবস্থান করায় পৃথিবী থেকে চাঁদের আলোকিত পিঠকে দেখা যায়। এদিনের পর থেকে শুরু হয় কৃষ্ণপক্ষের। পরিবর্তিত হতে শুরু করে চাঁদের কলা। বাইশতম দিনে চাঁদ তার কক্ষপথের তিন চতুর্থাংশ পরিভ্রমণ সম্পন্ন করে। তখন চাঁদের অর্ধেকটা আলোকিত দেখা যায়। ২৯.৫ দিনে পূর্ণ হয় একটি চন্দ্র মাস। আবার নতুন চাঁদের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় নতুন আরেকটি চান্দ্র মাসের।
 
কুসংস্কার ত্যাগ করুন
মানুষের জীবনে সাধারণ পূর্নিমা বা ব্লু  মুনের (পূর্ণিমার প্রভাবে জোয়ার-ভাটার ঘটা ছাড়া) কোনও ক্ষতিকারক বা ইতিবাচক প্রভাব আছে কি না সে বিষয়ে এখনও নির্দিষ্ট কিছু জানা যায়নি। তবে মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এটি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক নিয়মে ঘটে চলা একটি মহাজাগতিক ঘটনা মাত্র। তাই পূর্ণিমার প্রভাবে মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ বা এ জাতীয় বিশ্বাস নেহায়েত কুসংস্কার। তবে দারিদ্র-অশিক্ষা-অজ্ঞানতা-সাম্প্রদায়িকতা-রোগ-মানসিক যন্ত্রণা নানা কারণে আমাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন খুব সহজেই মহাজাগতিক ঘটনাবলীর ওপর ভর করে নিজেদের সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে নেয় বা তার বশবর্তী হয়ে পড়ে। তাই কোনোরকম কুসংস্কারে বিশ্বাস না করে, ভ্রান্ত ধারনায় পরিচালিত না হয়ে স্নাত হোন এই বিশেষ পূর্ণিমার অপূর্ব জোছনায়। এবারেরটা মিস করলে অপেক্ষা করতে হবে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত। বিজ্ঞানমনষ্কতা আর বিজ্ঞানঘনিষ্ঠতায় বেড়ে উঠুক আগামীর প্রজন্ম, সেই প্রত্যাশা আমাদের।

বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০১২
সম্পাদনা: আহমেদ রাজু, চিফ অব করেসপন্ডেন্টস; আহ্‌সান কবীর, আউটপুট এডিটর
ahsan.akraza@gmail.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।