ঢাকা: ঢাকা আর ঢাকাতেই নেই। ঢাকার অনেক কিছু ঢাকা পড়ে গেছে কালের গহব্বরে।
মোট কথা, ঢাকা বিশেষ করে পুরাতন ঢাকার পরিবেশটা আর ‘ঢাকাইয়া ঢাকাইয়া’ নেই।
এই কথা ফের মনে পড়লো নবাবপুরের রথখোলায় গিয়ে।
ঐতিহ্যবাহী রথখোলার শত বছরের পুরনো দুধের আড়ৎ এর দিকে তাকালে বুকটা চড় চড় করে ওঠে।
খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেল শত বছরের ঐতিহ্যবাহী দুধের আড়ৎগুলির এখন যাই যাই অবস্থা। কালের সাক্ষী হয়ে কোনোরকমে টিকে আছে দুটি আড়ৎ মাত্র।
এর মধ্যে একটিতে আবার সকাল থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত চলে বিড়ি সিগারেট বিক্রির ধূম।
পাশাপাশি ১২টি আড়ৎ নিয়ে পথচলা শুরু হয়েছিল এই বিখ্যাত রথখোলা দুধের আড়ৎ এর। শত বছর আগে যখন এই আড়তের পদযাত্রা শুরু হয় তখন কাকডাকা ভোর থেকে দুধ বেচা-কেনা শুরু হত এখানে।
ঢাকা এবং এর আশেপাশের এলাকা থেকে কচুরিপানা আর খেজুরপাতায় মুখ বন্ধ করা ড্রামে আর কলসে ভরে গোয়ালারা দুধ নিয়ে আসতেন রথখোলায়।
এখানে দুধের আড়ৎ গড়ে ওঠার পেছনে একটি মন্দিরের ভূমিকা রয়েছে। জানা যায়, শ’খানেক বছর আগে এখানকার এক মন্দিরে ভক্তরা পূজা দিতে আসতো দুধ নিয়ে। এ কারণে দুধে প্রচুর চাহিদা গড়ে ওঠে এখানে। এ চাহিদা এবং আশপাশের সমৃদ্ধ এলাকাগুলোর মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে রথখোলায় গড়ে ওঠে দুধের আড়ৎ।
আগের সময়টায় দুধ দিয়ে পুরান ঢাকার লোকজন বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার তৈরি করতো। নানাপদের মিষ্টান্ন ছাড়াও বায়ান্ন বাজার আর তিপ্পান্ন গলির এই প্রাচীন নগরের মোড়ে মোড়ে, গলিতে গলিতে, বাড়িঘরে দধি, ঘি, মাখন, দুধ-পিঠা, মাঠা, ছানা, সন্দেশ তৈরি হতো হরদম।
রথখোলায় দুধের আড়ৎ হয়ে যাওয়ায় ক্রমশ তৎকালীন ঢাকার দুধের পুরো চাহিদার যোগানদার হয়ে ওঠে এটি। তখন ছিল না টিনজাত দুধ, ছিল না প্যাকেটে করে তরল দুধের সরবরাহও। তাই দুধের জন্য রথখোলার কদর বাড়ে ঢাকা ও এর আশপাশে। রথখোলাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে বেশকিছু প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারও। এখনও এ এলাকার অন্যতম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হয়ে আছে মরণ চাঁদ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, ইসলামিয়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। মরণচাঁদের পাশে গড়ে ওঠে আরও কিছু ছোট ছোট মিষ্টির দোকান।
এছাড়া নবাবপুরের মাঝামাঝি এলাকার মতিলাল, কানুলাল, নিত্যলাল নামের মিষ্টান্ন ভাণ্ডারগুলোও এখানকার দধের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। তবে মতিলালসহ কয়েকটি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার এখন আর নাই। নানা প্রতিকূলতার কারণে তারা ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন।
একসময় শত শত মণ দুধ সরবরাহ হতো এখান থেকে পুরান ঢাকার বিভিন্ন দোকান, হোটেল এবং বাসাবাড়িতে।
কিন্তু এখন আর রথখোলার দুধের আড়তের সেই জৌলুস নেই। চাহিদা কমার সঙ্গে সঙ্গে কমে গেছে দুধের সরবরাহও। একে একে কমতে কমতে এখানে এখন টিকে আছে ২টি মাত্র দোকান।
কালের সাক্ষী হয়ে যেন টিকে আছে দোকান দুটি।
এর মালিকরা অনেকটা পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার জন্যই যেন আড়ৎকে আঁকড়ে ধরে আছেন প্রতিষ্ঠান দুটিকে। এর একটির নাম মতিলাল দুধের আড়ৎ যার বর্তমান বিশ্বনাথ ঘোষ। তার বাবা ছিলেন মতিলাল ঘোষ।
অপরটির মালিক ইয়াকুব। এটি ইয়াকুবের দুধের আড়ৎ নামে পরিচিত।
দিনে বর্তমানে এখানে ৩০ মণ দুধ বিক্রি হচ্ছে।
তবে মতিলাল আড়ৎ-এ বেচা কেনা শুরু হয় বিকাল ৫টার সময় এবং রাত ৮টা বাজতে না বাজতে বন্ধ হয়ে যায়।
মতিলাল দুধের আড়ৎ এর ব্যবস্থাপক, লালজী ঘোষ বাংলানিউজকে বলেন, “এই দুধের আড়ৎ-এর সঠিক ইতিহাস কেউ বলতে পারবে না। তবে ধারণা করা যায় এর বয়স প্রায় ১শ বছর হবে।
তিনি বলেন, মাত্র ৩০ বছর আগেও এখানে দৈনিক ১২০ থেকে দেড়শ’ মণ দুধ দৈনিক বেচা কেনা হত।
বেচাকেনা হত ভোর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। ব্যাপক চাহিদার কারণে ঢাকা শহরের আশপাশের এলাকা সাভার, কেরাণীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গি, নবাবগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, দোহার থেকে দুধ আসত আড়ৎগুলিতে। ”
লালজী ঘোষ বাংলানিউজকে বলেন, “এখন শুধু, কেরাণীগঞ্জ, দোহার এবং মুন্সিগঞ্জের কিছু এলাকা থেকে সামান্য পরিমাণ দুধ আসে।
আর এখন বেচা-কেনা শুরু হয় বিকাল ৫টায় আর শেষ হয় রাত ৮টায়। দৈনিক আমরা ৩০ মণ দুধ বিক্রি করতে পারি। ”
তিনি আরো বলেন, “এইভাবে চলতে থাকলে বাপ দাদার ঐতিহ্য মনে হয় আর ধরে রাখতে পারবো না। ”
পর্যাপ্ত দুধ কেন পাওয়া যাচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “দিন দিন গবাদি পশুর চারণভূমি কমে যাচ্ছে। এর ফলে গবাদিপশুর খাদ্যের অভাব দেখা দিচ্ছে। তা ছাড়া গোয়ালরা দুধ আড়ৎ-এ বিক্রি না করে বিভিন্ন দোকান এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করছে। ”
এছাড়া লোকজন আগের মত গবাদিপশু আর পালতে চায় না। এখন তারা অনেক ‘আধুনিক’ হয়েছে বলে আক্ষেপ করেন লালজী।
মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান থেকে রথখোলায় দুধ নিয়ে আসা গোয়ালা সইফুদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, “আমরা কোনোদিন আসি আবার কোনোদিন আসি না। দুধ পেলে আসি, না পেলে আসিনা। ”
তিনি আরো বলেন, “বৈশাখ, জৈষ্ঠ এবং আষাঢ় মাসে ভাল ব্যবসা হয় না। আমাদের এই তিন মাস টিকে থাকা দায়। ”
সইফুদ্দিন আরও বলেন, এখন আমার দৈনিক ৫০ থেকে ৬০ কেজি দুধ এখানে নিয়ে আসতে পারি। যাতায়াতে ২শ থেকে আড়াইশ’ টাকা খরচ হয়। সেই হিসাবে আমাদের কোনোরকমে দিন চলে।
বাংলাদেশ সময়: ২২০০ ঘন্টা, ২২ জুন, ২০১২
সম্পাদনা : আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর


