ঢাকা, শুক্রবার, ২৭ ভাদ্র ১৪৩২, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

শিক্ষা

এক নজরে জাকসু নির্বাচন: সারাদিন যা ঘটল

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৩৪, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৫
এক নজরে জাকসু নির্বাচন: সারাদিন যা ঘটল

৩৩ বছর পর আয়োজিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন নানা অভিযোগ আর অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। দিনভর পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, কয়েক দফায় বিভিন্ন হলে ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকা এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ঘিরে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ বলে দাবি করেছেন অনেকেই।

ভোট শেষ হওয়ার এক ঘণ্টা আগে ছাত্রদল ও বাম সংগঠনের তিনটি প্যানেল নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থী তিন শিক্ষকও নানা অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জন করেছেন।

বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯টা থেকে একযোগে ২১টি হলে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। বিকেল ৫টায় ভোট শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কিছু কেন্দ্রে ভোট চলে সাড়ে ৭টা পর্যন্ত। জাকসু নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ হাজার ৭৪৩ জন। এর মধ্যে কতজন ভোট দিয়েছেন তা এখনো জানা যায়নি। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, ফলাফল প্রকাশ হতে ডাকসুর মতো এবারও মধ্যরাত পেরিয়ে যেতে পারে।

এদিন ভোট শুরুর ঘণ্টা দুয়েক পর ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়। তবে বৃষ্টি উপেক্ষা করেই শিক্ষার্থীরা ভোট দিতে আসেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটার উপস্থিতিও বাড়তে থাকে। তবে নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ থাকলেও ক্যাম্পাসে তেমন কোনো উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি।

ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের প্রার্থীরা একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার চেষ্টা শুরু করেন। বেলা যত বাড়ে অভিযোগ ততই বাড়তে থাকে ছাত্রদলের অভিযোগ, শিবিরের প্রার্থীরা নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘন করে ভোটের সময় লিফলেট বিতরণ করছেন। এছাড়া তারা দাবি করেছেন, নির্বাচনের ব্যালট পেপার জামায়াত কর্মীর প্রতিষ্ঠানে তৈরি হওয়ায় শিবিরকে অতিরিক্ত সুবিধা পেয়েছে। পাশাপাশি শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে শিবিরের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগও তোলা হয়েছে।

অন্যদিকে, একই বিষয়ে ছাত্রদলের ওপর অভিযোগ তোলে ইসলামী ছাত্রশিবির। সংগঠনের নেতারা অভিযোগ করেন, ছাত্রদল সঠিক তথ্য বিকৃত করে অপপ্রচার করছে। তাদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রদলকে সুবিধা দিতে সব ব্যবস্থা নিয়েছে। তারা আরও বলেন, যে প্রতিষ্ঠানে ব্যালট পেপার তৈরি হয়েছে তা জামায়াতের নয়, বিএনপি সমর্থক দলের। ক্যাম্পাসের ভেতরে ছাত্রদলের সাবেক শিক্ষার্থী, কেন্দ্রীয় নেতা ও কয়েকজন বিএনপি নেতার উপস্থিতি সুষ্ঠ ভোটগ্রহণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করেছে, এমনটিও তারা অভিযোগ করেছেন। এছাড়া তারা নির্বাচনের সুষ্ঠ পরিবেশের অভাব এবং প্রশাসনের অসহযোগিতার কথাও উল্লেখ করেছেন।

অপরদিকে, জাকসু নির্বাচনকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হল (বর্তমানে ১০ নম্বর হল), মীর মোরাশরফ হোসেন হল এবং ফজিলাতুন নেসা হলে ভোটগ্রহণ সকাল ৯টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও পৌনে ১০টায় শুরু হয়।

এরপর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বৈদ্যুতিক গোলযোগ দেখা দেয়। বৃষ্টি শুরু হওয়ায় মওলানা ভাসানী হল, শহীদ রফিক-জব্বার হল, ফজিলাতুন নেসা হল, এ এফ এম কামালউদ্দিন হল, প্রীতিলতা হল এবং বীর প্রতীক তারামন বিবি হলে বিদ্যুৎ চলে যায়। ফলে অন্ধকারের মধ্যে মোবাইলের আলো দিয়ে ২৫ মিনিট ভোটগ্রহণ চালাতে হয়।

নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ব্যালট পেপার আসতে দেরি হওয়ায় এসব কেন্দ্রে ভোট শুরু করতে সময় লেগেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেলের সদস্য ফজলুল করিম পাটোয়ারী বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেননি। তিনি বলেন, সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রশাসনকে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল, কেন বিভ্রাট হলো তা জানি না।

এর বাইরে, বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ভোটারদের সংখ্যার চেয়ে অতিরিক্ত ব্যালট পেপার দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ও কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী। ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা করতে পারেনি।

৫-৬টি কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের আঙুলে মার্কার দিয়ে দাগ দেওয়া হয়নি। আবার কিছু কেন্দ্রে দাগ লাগালেও তা দ্রুত মুছে গেছে। পোলিং এজেন্টদেরও কোনো কার্ড দেওয়া হয়নি। কাজী নজরুল ইসলাম হলের ছাত্রদলের এজেন্ট জিসান বলেন, নির্বাচনে কোনো পোলিং এজেন্টদের কার্ড দেওয়া হয়নি। এছাড়া আমার হলে ভোট দেওয়ার পরও আঙুলে দাগ দেওয়া হচ্ছে না।

এছাড়া, বিভিন্ন কেন্দ্রে সাংবাদিকদের প্রবেশেও বাঁধা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

নির্বাচনে ব্যালট পেপারেও কিছু ভুল ছিল। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হলে কার্যকরী সদস্য পদে ৩ জন প্রার্থী থাকলেও ব্যালটে কেবল একজন প্রার্থীর পাশে টিকচিহ্ন দেওয়ার নির্দেশনা ছিল। এতে ভোটাররা বিভ্রান্ত হন।

যে কারণে ওএমআর মেশিনে ভোট গণনার পরিকল্পনা থাকলেও শেষ মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন এই সিদ্ধান্ত বাতিল করে হাতে গণনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণ কমিটির সদস্য ড. সালেহ আহম্মদ খান জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে মেশিনে ভোট গণনা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে এবার জাকসু নির্বাচনে সব ভোট হাতে গণনা করা হচ্ছে।

নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলে শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ হল ও ফজিলাতুন্নেছা হলে (বর্তমান ১৫ নম্বর) দুইবার ভোট গ্রহণ বন্ধ থাকে। জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ও হট্টগোলের কারণে ১৫ নম্বর হলে সোয়া ১২টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত ভোট বন্ধ ছিল। তাজউদ্দিন হলে দুপুর ১২টা থেকে প্রায় ২০ মিনিট ভোট বন্ধ ছিল।

হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী বলেন, দুপুর পৌনে ১২টার দিকে কেন্দ্রে কিছু সমস্যা দেখা দিলে ভোট গ্রহণ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে ভোট পুনরায় শুরু হয়।

অনিয়মের অভিযোগ তুলে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার প্রায় এক ঘণ্টা আগে নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান বিএনপিপন্থী তিনজন শিক্ষক। বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান অধ্যাপক শামীমা সুলতানা, নজরুল ইসলাম ও নাহরিন খান।

অধ্যাপক শামীমা সুলতানা বলেন, কেন্দ্রে অতিরিক্ত ব্যালট সরবরাহ করা হয়েছে। আমরা প্রতিবাদ করেছি, কিন্তু কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলেছে, অতিরিক্ত ব্যালট ছিঁড়ে ফেলতে। ভোট শেষে ভোটারের আঙুলে কালো দাগ দেওয়ার কথা, কিন্তু তারা যে মার্কার দিয়েছে, তাতে দাগ দেওয়া সম্ভব নয়। এই অবস্থায় আমাদের মনে হয়েছে, আমরা নির্বাচন চালিয়ে যেতে পারব না।

নির্বাচন চলাকালীন ক্যাম্পাসে অবৈধভাবে অবস্থান করার অভিযোগে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি হাফিজুর রহমান সোহানকে আটক করা হয়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ৩৬তম ব্যাচের (২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষ) সাবেক শিক্ষার্থী।

আটকের পর তাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরিয়াল বডির হাতে হস্তান্তর করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, সোহানের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার দেড় ঘণ্টা আগে, বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল নির্বাচনে অংশগ্রহণ বর্জন করে। তারা দাবি করেছেন, ব্যাপক অনিয়ম, ভোট কারচুপি ও প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের কারণে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে না।

ভোট বর্জনের পর জরুরি সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী তানজিলা হোসেন বৈশাখী বলেন, শুরু থেকেই আমাদের আশঙ্কা ছিল এটি সাজানো নির্বাচন হবে। আমরা বারবার প্রশাসনকে জানিয়েছিলাম যে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না, কিন্তু তারা আমাদের দাবি উপেক্ষা করেছে।

তিনি বলেন, বিভিন্ন হলে ভোটগ্রহণে অনিয়ম হয়েছে। জাল ভোট, নকল ব্যালট ব্যবহার, পোলিং এজেন্টদের কাজে বাধা দেওয়া এবং শিবির-সমর্থিত প্রার্থীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগও তিনি তোলেন।

ছাত্রদল ভোট বর্জনের পর, নির্বাচনে প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা এবং ছাত্রশিবিরকে ভোট জালিয়াতিতে সহযোগিতা করার অভিযোগ তুলে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয় ছাত্র ইউনিয়ন একাংশসহ কয়েকটি বাম সংগঠনের প্যানেল ‘সংশপ্তক পর্ষদ’।

ছাত্র ইউনিয়নের অপরাংশ সমর্থিত প্যানেল ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছে। বিকেলে প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী শরণ এহসান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এই নির্বাচন যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে হচ্ছে না। আমরা নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করছি। তারা শুরু থেকেই আমাদের আস্থা, ভরসা ও আকাঙ্ক্ষার জায়গা নষ্ট করেছে।

এছাড়াও, বামপন্থী অন্য একটি প্যানেল ‘স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ’ও ভোট বর্জন করেছে।

টিএ/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।