দেশের আবাসন খাত কি সরকারের কাঙ্ক্ষিত মনোযোগ পাচ্ছে? অর্থনৈতিক সংকটের মুখে কতটা চ্যালেঞ্জে আছে এ খাতটি? এ খাতের মন্দা দীর্ঘায়িত হলে কী হবে তিন কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের? এসব নানা বিষয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট গ্রুপের (বিডিজি) পরিচালক মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন।
প্রশ্ন : বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের আবাসন খাতে কী ধরনের সংকট দেখছেন?
মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন : বর্তমানে আবাসন খাত একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।
রাজউকের যে ড্যাপ (ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান), সেটা প্রণয়নে এখনো স্বচ্ছতা আসেনি। এই নিয়ে অনেক দাবিদাওয়া ও আন্দোলন চলছে। ড্যাপের অনেক বিষয় এখনো অনেকে মেনে নেয়নি। আবাসন খাতের ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, আর্কিটেক্ট, প্ল্যানারদের মধ্যেও দ্বিমত রয়েছে।
কাজেই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, আইন ও বিধি-বিধান প্রণয়নে অস্বচ্ছতা, দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, বৈশ্বিক অর্থনীতি বিবেচনায় আবাসন খাত চাপে রয়েছে। এর ফলে আবাসন খাতের সঙ্গে জড়িত প্রায় তিন হাজার প্রতিষ্ঠান কোনো না কোনোভাবে ভুগছে।
প্রশ্ন : আবাসন খাতের তিন হাজার প্রতিষ্ঠানের কথা বললেন, এর বাইরেও কারা জড়িত রয়েছে?
মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন : জাতীয় অর্থনীতিতে এই খাতের অবদান অনেক। জিডিপির প্রায় ২০ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। রাজস্ব দেওয়া হয় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। প্রায় তিন কোটি লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে। দুই লাখ কোটিরও বেশি এই খাতে বিনিয়োগ রয়েছে। কাজেই এই সব বিষয় বিবেচনা করলে আবাসন খাতের গুরুত্ব পরিষ্কার হয়ে যায়। তা ছাড়া এই খাতের সঙ্গে প্রায় ২৫৮টি উপখাত জড়িত, যে উপখাতগুলোর সঙ্গে প্রায় ১২ হাজার শিল্প প্রকল্প জড়িত রয়েছে।
সংগত কারণেই মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য এবং দেশের অর্থনীতির জন্য এই খাত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন : যে সংকট চলছে, এটা কতটা দীর্ঘ হতে পারে?
মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন : আবাসন খাতের এই সংকট দীর্ঘ হবে না স্বল্প হবে, সেটা বলা কঠিন। কারণ সারা বিশ্বে এখন একটা অস্থির অবস্থা চলছে। এই অস্থিরতা দ্রুত শেষ হয়ে যাবে, এমনটা ভাবার অবকাশ নেই। এই ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সরকার যদি সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন না করে এবং সঠিকভাবে এই খাতকে উজ্জীবিত করার জন্য ব্যবস্থা না নেয় এবং সুযোগ-সুবিধা না দেয় তাহলে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রশ্ন : সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে?
মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন : আমরা দেখেছি, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে যখনই কোনো অর্থনৈতিক বিপর্যয় আসে সরকারের পক্ষ থেকে আবাসন খাতকে উজ্জীবিত করার জন্য বিনিয়োগ করে। একই সঙ্গে সরকারিভাবে ফ্ল্যাট ও প্লট কেনার জন্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলো থেকেও সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করে, যা দীর্ঘমেয়াদি কিস্তির মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। এটা আমাদের দেশে আমরা অতটা দেখতে পাই না।
আমাদের দেশে হাউজিং লোন একেবারেই সীমাবদ্ধ। অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। যারা দিচ্ছে তাদের লোনের সুদের হার অনেক বেশি। আবার যারা লোন নিয়েছে তারা লোন পরিশোধের সুযোগ পাচ্ছে না। পরিশোধের জন্য একটা মেয়াদ, অর্থনীতি ও ক্যাশ ফ্লোর প্রশ্ন রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই এই জায়গাটা ব্যাহত হচ্ছে দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে। সেই কারণে ব্যাংক লোনও সহজলভ্য নয়।
প্রশ্ন : সংকট নিরসনে সরকারের কোনো উদ্যোগ দেখছেন কি?
মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন : সরকারের তরফ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে আমার জানা নেই। সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা বা নীতিমালা এই পরিস্থিতিতে নেওয়া হয়নি। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে আবাসন খাতের জন্য সরকার কোনো উদ্যোগই নেয়নি। এই খাত এখন অনেকটা ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। এটির অর্থনৈতিক দিক, উদ্যোক্তাদের সমস্যা—কোনো দিকই বিবেচনা করা হচ্ছে না। ক্রেতাদের জন্যও কোনো সুযোগ-সুবিধার কথা ভাবা হচ্ছে না। সার্বিক বিবেচনায় আবাসন খাত অনেকটা বেওয়ারিশ অবস্থায় রয়েছে।
প্রশ্ন : নির্মাণসামগ্রীর ঊর্ধ্বগতি কতটা প্রভাব ফেলছে আবাসন খাতে?
মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন : জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণের দিকে নজর দিলে আমরা দেখব, আবাসন খাতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তিন-চারটি গুরুত্বপূর্ণ উপখাত রয়েছে; তা হলো রড, সিমেন্ট, পাথর, ইট ও বালু। মিল-কারখানা নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিচালনা করতে না পারার কারণে উৎপাদন ঠিকমতো করা যাচ্ছে না। গ্যাস, তেল ও কাঁচামালের অভাব। ব্যাংকিং ব্যবস্থা বিশৃঙ্খল। ব্যাংকে এলসি করতে গেলে করা যায় না। ১০০ থেকে ২০০ পার্সেন্ট মার্জিন চেয়ে বসে। অনেক সময় এই পার্সেন্টিজ দেওয়ার পরও এলসি দিতে চায় না। এসব কারণে সরবরাহব্যবস্থা আক্রান্ত হয়েছে। খুবই খারাপ অবস্থায় গেছে। এর ফলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। সেটি আবাসন খাতের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এটি এ খাতের উদ্যোক্তাদের ভোগাচ্ছে।
প্রশ্ন : দাম বৃদ্ধি ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতাকে কেমন প্রভাবিত করে বলে আপনি মনে করেন?
মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন : জিনিসপত্রের দাম বাড়লে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতায় বিশাল প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশে যারা আবাসন ব্যবসা করে বা করি তাদের লক্ষ্যই থাকে মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত। উচ্চবিত্ত সেখানে খুব কম। এই মধ্যবিত্তের আয়ের সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে এবং দেশের সার্বিক পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকার কারণে কেনার মতো সাহস করতে পারছে না। তারা বিনিয়োগও করছে না।
প্রশ্ন : আবাসন খাত চাঙ্গা করা কিসের ওপর নির্ভর করে?
মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন : অন্তর্বর্তী সরকার বিশেষ কয়েকটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এ কারণে এখন নির্বাচন, সংস্কার ও বিচারকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এখানে অর্থনীতি নেই। অর্থনীতিকে চতুর্থ বা পঞ্চম কোনো জায়গায়ও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সংগত কারণে আবাসনের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। অর্থনীতিকে যদি গুরুত্ব না দেওয়া হয়, অর্থনীতি নিয়ে যারা কাজ করে তাদের যদি সম্মান না দেওয়া হয়, ব্যবসায়ীদের যদি প্রটেকশন না দেওয়া হয়, সংগত কারণে সমস্যা সমাধানের মতো অবস্থা থাকবে না বা নেই।
প্রশ্ন : সংকট সমাধানে তাহলে কী করতে হবে?
মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন : স্থানীয়ভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় একটা শৃঙ্খলা আনতে হবে। সেটি রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমে হোক অথবা অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে হোক। অবশ্যই রাজনৈতিক সরকার বা নির্বাচিত সরকার এলে দেশ তখন জনগণের দ্বারা পরিচালিত হবে। জনগণের সরকার এলে তাদের দাবিদাওয়া, ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। পাশাপাশি বর্তমান সরকারে যাঁরা আছেন তাঁরা খুবই বিজ্ঞ। তাঁরা যদি অর্থনীতিকে একটু গুরুত্ব দেন, তাহলে দ্রুততার সঙ্গে সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে।
প্রশ্ন : আবাসন খাতের এমন অবস্থায় ব্যবসায়ীদের অবস্থা কেমন যাচ্ছে?
মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন : আমরা দেখি যারা ব্যবসা করেনি, কখনো একজন লোকের কাজের ব্যবস্থা করেনি, তারা টক শোতে বলছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা ঋণখেলাপি, তাদের ধরে জেলে পুরে দেওয়া হোক। এই জেলে পুরে দেওয়াই যে সমাধান নয়, সেটি বিবেচনা করা হচ্ছে না। দেশে উৎপাদন করতে না পারার কারণে ক্যাশ ফ্লো আসছে না। ব্যাংক লোন দেওয়া যাচ্ছে না। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে জীবন, সম্মান, সামাজিক মর্যাদা বাঁচিয়ে রাখতে এখন ব্যবসায়ীদের আত্মাহুতি দিতে হবে। সরকার যদি এখনই উদ্যোগ না নেয় তাহলে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটেও যেতে পারে।
প্রশ্ন : দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া না হলে কী ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে?
মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন : ব্যবসায়ীমহলকে বিশেষ করে আবাসন খাতকে যদি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া না হয়, তবে এর ক্ষতিকর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হবে। তখন আর ফিরে আসার পথ থাকবে না। আবাসন খাতে নজর না দিলে কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন হবে। উৎপাদন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাবে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ হারাবে। জিডিপিতে অবদান থাকবে না। মোটকথা চরম একটি খারাপ পরিণতি হবে দেশের অর্থনীতির জন্য।
সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ