ঢাকা, রবিবার, ২৭ আশ্বিন ১৪৩২, ১২ অক্টোবর ২০২৫, ১৯ রবিউস সানি ১৪৪৭

ব্যাংকিং

ব্যাংকের অর্ধেক আমানত ঢাকার, এবার বেড়েছে কুমিল্লা-নোয়াখালীতে

জাফর আহমদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩:৫৮, অক্টোবর ১১, ২০২৫
ব্যাংকের অর্ধেক আমানত ঢাকার, এবার বেড়েছে কুমিল্লা-নোয়াখালীতে

ঢাকায় ব্যাংকে গ্রাহকদের আমানত কমেছে। বেড়েছে চট্টগ্রাম, সিলেটে, বরিশাল ও খুলনা বিভাগে।

এর মধ্যে অনুপাতিক হারে বেশি বেড়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের কুমিল্লা, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুরে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে এমন চিত্র দেখা গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুলাইয়ে সারা দেশের ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৯৬ হাজার ৫৮৩ কোটি ৪ লাখ লাখ টাকা। ২০২৪ সালের ৩০ জুন এই আমানতের পরিমাণ ছিল ১৮ লাখ ৩৮ হাজার ৮৩৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এক বছরে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭৪৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এক বছরে বৃদ্ধি হার ৮.৫৭ শতাংশ।

ঢাকায় আমানত বৃদ্ধির হার কম
চলতি বছরের জুন শেষে ঢাকায় ব্যাংক আমানত দাঁড়ায় দেশের মোট ব্যাংক আমানতের ৬০.৫ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৬১.২ শতাংশ। রাজধানীর দুই থানা এলাকা গুলশান ও মতিঝিলে ব্যাংক আমানত দাঁড়ায় ২০ শতাংশ। গত এক বছরে শুধু রাজধানীর এই দুই অঞ্চলেই ব্যাংক আমানতের বৃদ্ধি কমেছে দেড় শতাংশ। টাকার অংকে যা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।

বৃদ্ধির হার চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাতে বেশি
আমানতের বৃদ্ধি বিভাগীয় শহরে আনুপাতিক হারে হয়নি, বরং বিভাগীর শহরের বাইরের জেলাগুলোতে বেশি হয়েছে। আমানত বেশি বেড়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের জেলা শহরগুলোতে। অন্যদিকে দেশের মোট ব্যাংক আমানতের ২০ শতাংশ গচ্ছিত থাকা রাজধানীর দুই এলাকায় ব্যাংক আমানত তুলনামূলক কম বেড়েছে।

দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্রভূত হওয়া রাজধানীর দুই এলাকায় আমানত বৃদ্ধির হার কম। অ্যদিকে আমানত বৃদ্ধির হার বেশি দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যাংক আমানত থাকা বিভাগীয় শহর চট্টগ্রামের বাইরের জেলা শহর কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে।

সিলেট, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগেও ব্যাংক আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে বৃদ্ধির হার কম, যা আগের বছরের দশমিক ১০ শতাংশ হারে।

নিম্ন ব্যাংক আমানত বরিশাল ও রংপুরে
চিত্র বলছে, বিভাগগুলোর মোট আমানতের মধ্যে বরিশালে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১.৯ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে ২ শতাংশ হয়েছে। বরিশাল বিভাগে সর্বনিম্ন ব্যাংক আমানত। ঢাকার পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যাংক আমানত চট্টগামের মানুষের। চট্টগ্রাম বিভাগে ২১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২১.২ শতাংশ হয়েছে। এক সময়ের শিল্প শহর খুলনায় বৃদ্ধির হার গতানুগতিক। খুলনা বিভাগে ৪.৩ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪.৪ শতাংশ; রাজশাহী বিভাগে ৪.১ থেকে ৪.২ শতাংশ এবং সিলেট বিভাগে ৩.৯ থেকে ৪  শতাংশ হয়েছে। দেশের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ব্যাংক আমানত রংপুর বিভাগের মানুষের। রংপুর বিভাগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের মোট আমানত ছিল ২ শতাংশ, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কোনো পরিবর্তন হয়নি, আগের আমানতই রয়ে গেছে।

কম ব্যাংক আমানত বরিশাল ও রংপুরে। এই দুই বিভাগের একেকটিতে আমানত রাজধানীর বনানী এলাকার চেয়ে কম। ২০২৫ সালের জুলাইয়ে বনানী এলাকায় ব্যাংক আমানত দাঁড়ায় ৫৬ হাজার ২২৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা, যা সারা দেশের মোট ব্যাংক আমানতের ২.৮ শতাংশ। আগের বছর ২০২৪ সালের জুলাইয়ে এই হার ছিল ২.৯ শতাংশ।

সারা দেশের অর্ধেক ব্যাংক আমানত ঢাকাতে
সারা দেশের মোট ব্যাংক আমানতের অর্ধেকের বেশি ঢাকা জেলায়। ২০২৫ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিভাগের ব্যাংক আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ১৬ হাজার ৮৯৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, যা মোট আমানতের ৫০ দশমিক ৯ শতাংশ। সারা দেশের মোট আমানতের ১০.২ শতাংশ রয়েছে মতিঝিল থানা এলাকায়, যা দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের তিন বিভাগ খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের সমম্মিলিত ব্যাংক আমানতের সমান। মতিঝিল এলাকায় ব্যাংক আমানতের পরিমাণ ২ লাখ ২ হাজার ৭৪৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

গুলশানের ব্যাংক আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ৯৩ হাজার ৯৭৭ কোটি ৩ লাখ টাকা, যা মোট ব্যাংক আমানতের ৯.৭ শতাংশ।

রাজধানীর দুই থানা মতিঝিল ও গুলশান এলাকার সম্মিলিত ব্যাংক আমানত চট্টগ্রাম বিভাগের আমানতের প্রায় সমান। ২০২৫ সালের ১ জুলাই অবধি চট্টগ্রাম বিভাগের ব্যাংক আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২৩ হাজার ৯১০ কোটি টাকা।

যে কারণে ঢাকায় ব্যাংক আমানত বৃদ্ধির হার কম
ঢাকায় অন্যান্য বিভাগগুলোর তুলনায় ব্যাংক আমানত কম বৃদ্ধির পেছনে ব্যবসা স্থানান্তর, রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যবসায় মন্দা ও প্রবাসীদের বসবাসের এলাকাগুলোতে বেশি রেমিট্যান্স আসা ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা।

ব্যবসা-বাণিজ্য সরিয়ে নেওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে একটি অঞ্চলের ব্যাংকে আমানত কমে যেতে পারে। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার কারণে এটা হয় বলে মনে করেন বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, এর সঙ্গে রাজনৈতিক কোনো কারণ থাকার যৌক্তিকতা দেখছি না। রাজনৈতিক কারণে যদি এটা হয়ে থাকে তাহলে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতো না। এটা হতে পারে মতিঝিল, গুলশান, বনানী থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য সরে যাওয়ার কারণে। কেউ ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে আবার কেউ স্থানান্তর করেছে।

তবে বেশি রেমিট্যান্স আসা জেলাগুলোতে ব্যাংক আমানত বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ হলো প্রবাসীদের স্বজনরা ব্যাংকে টাকা রেখেছেন। সম্প্রতি ফর্মাল চ্যানেলে প্রবাসী আয় আসা বেড়েছে। বেশি রেমিট্যান্স এলে ব্যাংকে আমানত রাখবে, এটা স্বাভাবিক, বলেন জাহিদ হোসেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশের প্রধান দুই শহর ঢাকা ও চট্টগ্রাম বাদে যেসব জেলায় প্রবাসী আয় প্রবাহ বেশি, সেগুলো হলো—কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেট।

২০২৪ সালের আগস্টে সরকার পরিবর্তন ব্যবসা বাণিজ্যে প্রভাব ফেলে। তৎকালীন সরকার ঘনিষ্ঠ অনেকে ব্যবসা বন্ধ করেছেন, অনেকে কোনো মতে টিকে আছেন। ব্যাংকে আমানত হ্রাস বৃদ্ধিতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। মতিঝিলে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রও পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিজনেস ইনিশিটিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, ঢাকাতে ব্যাংক আমানত হ্রাস পাওয়ার পেছনে বড় কারণ হলো ব্যবসা-বাণিজ্য অন্যত্র স্থানান্তর করা। বিশেষ মতিঝিলে ব্যাংক আমানত কমে যাওয়ার পেছনে যৌক্তিক কারণ রয়েছে। মতিঝিল বিজনেস হাব ছিল। যানজট বৃদ্ধিসহ ব্যবসার সুযোগ-সুবিধা ক্রমে সংকুচিত হওয়ার কারণে গত কয়েক বছর ধরে ব্যবসায়ীরা মতিঝিল ছাড়ছেন।

তিনি বলেন, গত কয়েক বছর মতিঝিল এলাকায় একটি ট্রেন্ড শুরু হয়েছিল—এখানকার ব্যবসায়ীরা বনানী বা আশপাশের তুলনামূলক কম ভাড়া ও কম যানজট, কম কোলাহলের এলাকায় চলে যাচ্ছিলেন। এর প্রভাব পড়েছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই), মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) পরিচালনার ক্ষেত্রে। যেহেতু ব্যবসায়ীরা চলে যাচ্ছিলেন, ডিসিসিআই-এমসিসিআইকে গুলশানের দিকে অতিরিক্ত অফিস নিতে হয়েছে, যাতে ব্যবসায়ীরা যেখানে ব্যবসা করছেন, সেখানে বসেই চেম্বারের কাজ করতে পারেন। সড়কে সময় নষ্ট করার সময় তাদের নেই। ব্যাংক অ্যাকাউউন্ট মতিঝিলে কমে যাওয়ার পেছনে এটা একটি কারণ। কেউ যদি ব্যবসার অফিস অন্যত্র স্থানান্তর করে তার একাউন্ট মতিঝিলে রাখবে না, অ্যাকাউন্ট বা আমানতও স্থানান্তর করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর সেই অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে।

জেডএ/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।