ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ ভাদ্র ১৪৩২, ২৮ আগস্ট ২০২৫, ০৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

সরকার ও ইসি জিরো টলারেন্সে থাকলে নির্বাচন হবেই

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৪১, আগস্ট ২৭, ২০২৫
সরকার ও ইসি জিরো টলারেন্সে থাকলে নির্বাচন হবেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বানানো ছবি

আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র চলছে বলে ইতোমধ্যে বিভিন্ন দিক থেকে অভিযোগ উঠেছে। তবে সরকার ও নির্বাচন কমিশন (ইসি) দৃঢ় অবস্থান নিলে নির্বাচনের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র করে কাজ হবে না বলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা মনে করছেন।

২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সে অনুযায়ী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে নির্বাচন কমিশন। অল্প সময়ের মধ্যেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা দেওয়া হতে পারে বলে নির্বাচন কমিশন থেকে জানা যাচ্ছে। সরকারও নির্বাচনের সার্বিক সহযোগিতার প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

গত ২৫ আগস্ট কক্সবাজারে রোহিঙ্গা অংশীজন সংলাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন ঘোষণা করা হয়েছে এবং এই নির্বাচনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।

এদিকে এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র ও সংশয় তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। ইতোমধ্যে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনের আগে সংস্কার ও বিচারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিকে জোরালোভাবে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। আবার এই বিষয়গুলো সরকার ঘোষিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি হতে পারে বলে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল মনে করছে।

গুরুত্বপূর্ণ দুই রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দিক থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, সংস্কার ও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচারের বিষয় পাশ কাটিয়ে একটি সাজানো নির্বাচন করার চেষ্টা হচ্ছে।

জামায়াত ও এনসিপির দাবি জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনগত ভিত্তি দিতে হবে এবং সনদ বাস্তবায়ন করে তার ভিত্তিতে নির্বাচনে যেতে হবে। আবার ভোটের আনুপাতিক হার বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিকে জোরালোভাবে সামনে এনেছে জামায়াত। সেই দাবিতে রাজপথে আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়ার কথাও বলছে দলটি।

আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না বলে গত ১২ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের উপস্থিতিতে ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “নির্বাচনের ডেট ঘোষণা হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে; ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না। ”

“যদি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হয়, আমার যে ভাইয়েরা শহীদ হয়েছিল, রক্ত দিয়েছিল সংস্কারের জন্য, তাহলে কবরে গিয়ে তার লাশটা ফেরত দিতে হবে এই সরকারকে। ”

নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী আরও বলেন, “আমার যে ভাইয়ের হাতটা চলে গিয়েছিল, যদি সংস্কার কাজ শেষ না করে নির্বাচন হয়, তাহলে এই সরকারকে আমার ভাইয়ের হাতটা ফিরিয়ে দিতে হবে। যে মায়ের বুক খালি হয়েছিল, ওই মায়ের বুকের সন্তানকে ফেরত দিতে হবে।

গত ২৬ আগস্ট এনসিপি ডায়াসপোরা অ্যালায়েন্স, মালয়েশিয়ার আয়োজনে এক অনুষ্ঠানে একই মন্তব্য করেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, “জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির মাধ্যমে আমরা নির্বাচন, যেটা গণপরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাই। আমরা মনে করি এর বাইরে কোনো নির্বাচন হবে না। আমার কাছেও মনে হচ্ছে না, সেটা বাস্তবিক হবে। আমরা প্রথম থেকেই নির্বাচনের তারিখ নিয়ে কখনো পক্ষ-বিপক্ষ করিনি। আমরা শুধু বলেছি, সংস্কারের নিশ্চয়তা এবং বিচারের নিশ্চয়তা দিয়ে যদি ডিসেম্বরেও নির্বাচন হয়, সেটাতেও আমাদের আপত্তি নেই। ”

অন্যদিকে জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী জাতীয় নির্বাচন হতে হবে বলে জোর দাবির জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। গত ৬ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের হওয়ার ক্ষেত্রে জামায়াতের কোনো আপত্তি নেই। তবে তার আগে জুলাই সনদদের আইনি ভিত্তি ও নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। সরকার চাইলে এই দাবিগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মনে করে জামায়াত। ”

পিআর পদ্ধতি ছাড়া জামায়াত নির্বাচন অংশগ্রহণ করবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “এটি আমাদের দাবি। আমরা আমাদের দাবির ব্যাপারে আন্দোলন করব। পরবর্তী সময়ে কী হয়, সেটি দেখার বিষয়। ”

নির্বাচনের সময় ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর গুরুত্বপূর্ণ দুটি দল এসব দাবি সামনে আনায় এর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা। বিভিন্ন শর্ত তুলে আন্দোলনের হুমকি দিয়ে নির্বাচনকে বানচাল করা ও বিভ্রান্তি তৈরির কৌশল বলেও দলগুলো থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে।

বর্তমান অবস্থায় দেশকে আবারও ষড়যন্ত্রের অন্ধগলিতে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে গত ২০ আগস্ট নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী মন্তব্য করেছেন।

তিনি বলেন, “আমাদের অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন এখনো নিশ্চিত হয়নি। আমরা নানা ধরনের চক্রান্তের কথা শুনি, নানা ধরনের মাস্টার প্ল্যানের কথা শুনি। ”

এদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বুধবার (২৭ আগস্ট) জাতীয় প্রেসক্লাবে ভাসানী জনশক্তি পার্টি ও ভাসানী অনুসারী পরিষদ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “আমরা একটি ভয়াবহ ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত হয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণের চেষ্টা করছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু রাজনৈতিক মহল পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনকে বানচাল করতে নিত্যনতুন দাবি তুলছে। ”

তিনি আরও বলেন, “তারা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির মতো এমন সব বিষয় আনছে, যা এদেশের সাধারণ মানুষ চেনেও না, বোঝেও না। কাকে ভোট দিল, কে নির্বাচিত হলো, তা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা চলছে। ”

এই পরিস্থিতি নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলে সংশয় প্রকাশ করছেন বিভিন্ন দলের নেতারা। এই সময়ে নির্বাচন যদি না হয় তাহলে তৃতীয় শক্তি হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করবে বলে তারা আশঙ্কা করছেন, যা দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। নির্বাচনের বিরুদ্ধে যেকোনো ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে সরকারকে জিরো টলারেন্সে থাকতে হবে বলে তারা মনে করেন। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনকেও নির্বাচনের বিরুদ্ধে যেকোনো ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে বলে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা মতামত দেন। দেশের জনগণ নির্বাচনের বিরুদ্ধে যেকোনো ষড়যন্ত্র প্রতিহত করবে। ষড়যন্ত্রকারীরা লাভবান হতে পারবে না বলেও তারা আশা প্রকাশ করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক এমপি হারুনুর রশীদ বাংলানিউজকে বলেন, “বিভিন্ন দল তাদের নিজেদের অবস্থান নিয়ে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে। দলগুলোর অবস্থান থাকতেই পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নির্বাচন যদি না হয় তাহলে তৃতীয় শক্তি হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করবে। এটা দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। দেশের জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্য নির্বাচন এই সময়ে হতেই হবে। নির্বাচনের বিরুদ্ধে যেকোনো ষড়যন্ত্র সরকারকে প্রতিহত করতে হবে। যারা ষড়যন্ত্র করবে, এর জন্য যারা দায়ী হবে, জনগণ তাদের চিহ্নিত করবে। জনগণ ষড়যন্ত্র সফল হতে দেবে না। ”

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত নানা ধরনের ষড়যন্ত্র আসতে পারে। কিছু আভ্যন্তরীণ ও বিদেশি শক্তি মনে করে অনির্বাচিত সরকার থাকলে তাদের ভালো হয়। সরকার যদি এসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয় তাহলে সরকারই দায়ী থাকবে। আর নির্বাচন কমিশন যদি দৃঢ় ও শক্ত অবস্থানে থাকে তাহলে কোনো ষড়যন্ত্র করে কাজ হবে না। ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে সরকারের দায়িত্ব নিতে হবে। সরকার ও নির্বাচন কমিশন দৃঢ় অবস্থান নিলে কোনো ষড়যন্ত্র কাজে আসবে না। দেশের মানুষ সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে পারবে। ”

এসকে/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।