৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। নানান ঘটনা, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা আর সম্ভাবনার মাঝে রাজনৈতিক দলগুলো চিনেছে মিত্র।
বিএনপি সমর্থিত পেশাজীবীদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের কিছু অংশের এই এক বছরে জামায়াত সংশ্লিষ্টতা ও জামায়াত দুর্বলতার প্রকাশ দলটিকে বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে।
জানা গেছে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে (২০০১-০৬) ঢাকার বাইরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মনোনীত হয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থি শিক্ষক অধ্যাপক আব্দুল লতিফ মাসুম। আওয়ামীলীগের শাসনামলে এই শিক্ষক চরমোনাই পীরের দলে যোগ দেন। এখন জামায়াতপন্থি শিক্ষকদের সাথে সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট হচ্ছে। যা বিএনপি সমর্থক শিক্ষকদের মধ্যে কৌতূহল ও বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। শুধু এই শিক্ষকই নন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিএনপি, জামায়াতপন্থি ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলে বিগত সময়ে বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের আধিপত্য দৃশ্যমান থাকলেও ৫ আগস্টের পর এই দৃশ্য এখন মলিন। সাদা দল ভেঙে গেছে। জামায়াতপন্থিরা আলাদা হয়েছেন। কিন্তু নির্দলীয় ও আওয়ামীলীগের বিগত ১৫ বছরে নিয়োগ পাওয়া বিপুল সংখ্যক তরুণ শিক্ষকও এখন জামায়াতপন্থি শিক্ষকদের সাথে মিশে গেছেন। যা বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের অবাক করছে। আওয়ামীলীগের আমলে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের একটি বড় অংশ জামায়াতপন্থি এটা বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের শুধু অবাকই করেনি বরং নিজেদের মধ্যে কারা বিএনপি আর কারা জামায়াতপন্থি সেটা নিয়েই দ্বিধাদ্বন্দ্বে শিক্ষক নেতারা।
ঢাবির সাদা দলের একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক না প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেন, এই মুহূর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যা অবস্থা তাতে কেউ যদি সাদা দল থেকে জামায়াতপন্থিদের বিরুদ্ধে কিছু বলেন, তাহলে তাকেই বরং জামায়াত বলে সাদা দলে কোণঠাসা করা হবে। তারপর শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের ব্যাপারও তো আছেই। সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঢাবির শিক্ষকদের নিয়ে একটি বৈঠক করেন। সেখানেও চিহ্নিত জামায়াতপন্থিরা উপস্থিত ছিলেন। সাদা দলের বিএনপি সমর্থক আহ্বায়ক মোর্শেদ (অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান) কিছুটা বিএনপিপন্থিদের গোছাতে চেষ্টা করছেন, তবুও তিনি কতটা পারবেন সেটা দেখার বিষয়। আবার কেউ কেউ তো আলাদাভাবে আরেকটা সাদা দল গড়ে তুলেছেন। সেখানে যারা তারাও বিএনপিপন্থিই। আসলে কি, এখনকার শিক্ষকদের একটি বড় অংশই আওয়ামীলীগের আমলে নিয়োগ পাওয়া, আর এদের বড় অংশই এখন জামায়াতপন্থিদের সাথে। এটাও অনেকটা আশ্চর্যের ব্যাপার।
এ বিষয়ে ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী বাংলানিউজকে বলেন, আসলে আওয়ামীলীগের পতনের পর, এখন তো কারো পরিচয় লুকিয়ে রাজনীতি করার কিছু নেই। জামায়াতও ক্ষমতায় যেতে বা বিরোধীদল হতে চাচ্ছে। এজন্যই হয়তো এখন বিএনপি জোট বা সমমনা নাম থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের আসল পরিচয় প্রকাশ করছে।
ছাত্রদলের ক্ষেত্রে দেখা গেছে এমন বিচিত্র ঘটনা। ছাত্রদলের অভিযোগ, বিগত সময়ে ঢাকার বাইরের কিছু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের কমিটিতে ছোটপদে ছাত্রশিবিরপন্থি শিক্ষার্থীদের পদ নেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। ছাত্রদলকে বিতর্কিত করতেই বিভিন্ন ইস্যুতে এই শিক্ষার্থীরা ছাত্রদলের ছোটপদ থেকে পদত্যাগ করে গণমাধ্যম ও বিভিন্ন জামায়াতপন্থি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পেজে পোস্ট করে। এতে সাধারণ মানুষ মনে করে ছাত্রদল থেকে ছাত্রদলের নেতা পদত্যাগ করেছেন কিন্তু ব্যাপারটা এমন নয়। শিবির গোপনে তাদের লোকদের প্রকাশ্য বিভিন্ন দলের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ ঘটায় আবারও সুযোগ বুঝে তাদের দলে ফিরিয়ে নেয়।
ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম আরিফ বাংলানিউজকে বলেন, ছাত্রদল করতে গিয়ে প্রথম বর্ষ থেকে নির্যাতনের শিকার হয়েছি। বার বার হামলার শিকার হয়েছি। আমরা আমাদের সহযোদ্ধা কর্মী চিনি। কিন্তু বিগত ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে হল থেকে মাঝে মাঝে কিছু ছেলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতো। তারা প্রকাশ্যে কখনো ছাত্রদলের কর্মসূচিতে আসতো না কিন্তু ৫ আগস্টের পর দেখি এরা এখন গুপ্ত অবস্থা থেকে বেরিয়েছে। এরা কখনো সাধারণ শিক্ষার্থী, কখনো শিবির, কখনো সামাজিক সংগঠনের নেতা। এটা আমাদের অবাক করে।
বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)। ড্যাবের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেও এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
ড্যাবের নেতারা অভিযোগ করেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজিদের একজন থেকে শুরু করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল ও ভাইস প্রিন্সিপাল জামায়াতপন্থি। ৫ আগস্টের পট-পরিবর্তনের পর বিভিন্ন জেলায় নিয়োগপ্রাপ্ত সিভিল সার্জনরাও জামায়াতপন্থি। এরা কিছুদিন আগেও ছিল ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগের সংগঠন স্বাচিপের নেতা।
ড্যাব নেতাদের অভিযোগ, কিছু বললেই, জামায়াতের সমর্থক এই ডাক্তাররা বলেন, তারাই না কি শেখ হাসিনাকে কৌশলে সরিয়েছে। তাদের রয়েছে বিশাল সিন্ডিকেট। আওয়ামীলীগেও তারা সক্রিয় ছিল, এখনও সংঘবদ্ধ। ঢাকা মেডিকেলে এরা ছাত্রদলের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে। তারা বলেন, সেখানে রাজনীতি চলবে না। যদি রাজনীতি না থাকে তাহলে তাদের নিয়োগ দিলেন কারা?
ড্যাবের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ডা. শাহ মোহাম্মদ আমান উল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, ৫ আগস্টের পর আশেপাশের কিছু মানুষ দেখে নিজেকেই নিজের অচেনা লাগে, নিজের জায়গায় নিজেকে অজানা লাগছে। বিগত ১৭ বছর যাদের স্বাচিপ হিসেবে দেখেছি, যারা তখন বিএনপিপন্থিদের নানানভাবে হয়রানি করতো, এখন দেখছি তারাই বড় পদে পদায়ন হচ্ছে। ভালো জায়গায় তাদের সিন্ডিকেটের লোকদের পোস্টিং হচ্ছে। তাদের জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, তারা অরাজনৈতিক। আর একটু খোঁজ নিলে বের হবে তারা হলে শিবির ছিলেন। তারা আওয়ামীলীগের সময়ও ভালো ছিলেন, এখনও ভালো আছেন।
ডা. শাহ মোহাম্মদ আমান উল্লাহ আরও বলেন, এখন তাদের ভয়েস স্ট্রং। তারা ইস্যুভিত্তিক বিভিন্ন আন্দোলন করে। অরাজনৈকিতার আড়ালে তাদের রয়েছে স্ট্রং সিন্ডিকেট। যখন প্রয়োজন পড়ে তখন তারা আস্তে আস্তে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করে।
বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, কিছু সুবিধাপন্থি একসময় ড্যাবের সাথে ছিলেন। বিগত ১৭ বছর স্বাচিপের আজীবন সদস্যপদও তাদের কেউ কেউ নিয়েছিলেন। এখন তাদের কেউ কেউ জামায়াতের ডাক্তারদের সংগঠন এনডিএফ হয়েছেন। আসলে যারা অপ্রকাশ্যে থাকেন তাদের বিষয়ে তো সহজে জানা যায় না। আমাদের ড্যাবের নেতাকর্মীদের একটি ডাটাবেজ আছে। আমরা সেটা হালনাগাদ করছি।
তিনি আরও বলেন, সুবিধাপন্থি এই লোকগুলোর সংখ্যা আসলে খুবই লিমিটেড। সত্যিকারের যারা বিএনপিকে ভালোবাসে বা বিএনপি করে তারা কখনো সুবিধার জন্য বিভিন্ন সংগঠনে বা দলে আশ্রয় নেয় না। তারা জেল-জুলুম নির্যাতন সহ্য করে হলেও বিএনপিই করেন। বিএনপি পরিচয়ে তারা গর্ববোধ করেন। নানান কারণে হয়তো সবাই পদ-পদবিতে থাকতে পারেন না, কিন্তু দলের আদর্শচ্যুত কখনো হন না।
বিএনপির ওই নেতা আরও বলেন, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর যাদের বিরুদ্ধে এই ধরনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে, আমরা তাদের কারণ দর্শানো নোটিশ দেবো। আর ড্যাবের আগামী কমিটিতেও এ বিষয়গুলো মাথায় রাখা হবে।
বিএনপিপন্থি ব্যাংকার্সদের সংগঠন ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সদস্যসচিব মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক বাংলানিউজকে বলেন, সুবিধাপন্থি, সুবিধাভোগী ও অপ্রকাশ্যদের প্রতিরোধের জন্যই আমরা শুধু সাবেক ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের নিয়ে আমাদের কমিটি করেছি। কেননা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সবাই সবাইকে চিনতাম। তারপরও ঢাকার বাইরে স্বৈরাচারের দোসর ও বর্ণচোরাদের অনুপ্রবেশের চেষ্টার কিছু খবর পাই। চিহ্নিত হওয়ায় তারাও এখন তাদের আসল গোত্রে ফিরে গেছে। সত্যিকারের জাতীয়তাবাদী কর্মীদের ও পেশাজীবীদের এখন দেশের স্বার্থে ঐক্য গড়ে উঠছে। বর্ণচোরাদের পরিচয়ও এখন প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে।
একই অবস্থা কৃষিবিদ থেকে শুরু প্রকৌশলীসহ অন্যান্য সংগঠনেও। অন্যান্য বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা এ বিষয়ে কথা বলতেও নিজেদের সংকোচের কথা অকপটে স্বীকার করেন। কেউ কেউ বলেন, সামনে নির্বাচন ভোটে ব্যাপার আছে। আবার অনেকে পেশাজীবীদের সংগঠনের নির্বাচনে ভোটের হিসাবের ব্যাপারও মাথা রেখে চুপ থাকেন।
অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স (অ্যাবের) সাবেক সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের সম্পাদক আসাদুজ্জামান চুননু বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের রুট লেভেলে এই ধরনের কিছু ব্যাপার শোনা যায়। আমাদের অ্যাবের কমিটিও এখন নেই। নির্বাচনের আগে ব্যাপারগুলো আরও পরিষ্কার হবে।
কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের কৃষিমন্ত্রী ছিলেন জামায়াতের নেতা। তারা বিএনপির কাছ থেকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। তাদের কর্মীদের চাকরি থেকে শুরু করে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। আওয়ামীলীগের আমলে এরা গিরগিটির মতো রং বদল করেছিলেন। ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর বিগত ফ্যাসিস্ট আমলের অনেকেই এখন নতুন রূপে সক্রিয় হয়েছেন। আমরা নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছি। এদের মুখোশ উন্মোচন করা হবে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম বাংলানিউজকে বলেন, শুধু কৃষিবিদদের সংগঠন না। সব পেশাজীবীদের সংগঠনেই এখন বিগত সরকারের সুবিধাভোগীরা পদবি ও ক্ষমতায় আসতে চাচ্ছে। এরা বিগত সময়ে ছিল গুপ্ত, অরাজনৈতিক আর এখন সামনে আসছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ব্যানারে।
এএটি