টানা দেড় দশক ধরে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা হামলা, মামলা কিংবা নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। কিন্তু জুলাই আন্দোলনে এর মাত্রা ছিল ভিন্ন।
ওই সময়ের সরকারের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া ব্যক্তিরা সব ধরনের আক্রমণ, নির্যাতন-নিপীড়ন, গণগ্রেপ্তার, মামলাবাজি, ভয়ভীতি ও সহিংসতার মুখেই পড়েন। এই আন্দোলনের সমর্থনকারী হিসেবে ভিন্নমতাবলম্বী চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, শিক্ষাবিদ, অনলাইন সমালোচক ও সাধারণ নাগরিকদেরও নির্যাতন-নিপীড়ন, গণগ্রেপ্তার ইত্যাদি দমনমূলক ব্যবস্থায় হয়রানি করা হয়।
গত বছরের জুলাই আন্দোলনের নৃশংস ঘটনাগুলোর সঙ্গে এ বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে। এই মামলায় আসামি করা হয়েছে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে। যদিও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন এরইমধ্যে রাজসাক্ষী হয়েছেন।
ফরমাল চার্জ মোট ১৩৫ পৃষ্ঠার। এই ফরমাল চার্জ আদালতে তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. আব্দুস সোবহান তরফদার, মো. মিজানুল ইসলাম, যেটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
যে কৌশলে বিরোধীদের লক্ষ্যবস্তু করা হতো
আওয়ামী লীগের শাসনামলে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহায়তায় রাষ্ট্র সুসংগঠিতভাবে সর্বত্র নজরদারি ও দমননীতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় মানুষের যোগাযোগ ও চলাফেরার ওপর গোয়েন্দা সংস্থা সক্রিয়ভাবে সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নজরদারি করেছে।
বিরোধী ও ভিন্নমত দমন ও নিপীড়নের কৌশল হিসেবে ডিজিটাল সার্ভেইলেন্সের জন্য তারা একটি স্বতন্ত্র নজরদারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, যার নাম দেয়া হয় এনটিএমসি। এর আগে এই নজরদারির কাজটি পরিচালনা করতো দুটি সংস্থা। তখন এর নাম ছিল এনএমসি।
বাহ্যিক আবরণে এই প্রতিষ্ঠানটির কাজ অপরাধী শনাক্ত করনের বৈধ নজরদারির লক্ষ্যে পরিচালিত বলে বলা হলেও আড়ালে এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে বিরোধী নেতাকর্মী এবং ভিন্নমত পোষণকারী কিংবা সরকারের অবৈধ কর্মকাণ্ডের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা ব্যক্তিবর্গকে নজরদারি, অপহরণ ও গুম করার কাজে ব্যবহৃত হতে থাকে।
বিশেষত জুলাই-আগস্ট গণবিপ্লবে এই আন্দোলনকারীদের চিহ্নিত করা এবং এর আলোকে দমন-পীড়নের লক্ষ্যে নজরদারি করতে ড্রোন, ফোনে আড়িপাতা এবং লোকেশন ট্র্যাকিং ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। এর পাশাপাশি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করতে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন যেমন ছাত্রলীগ, যুবলীগ তাদের মাঠপর্যায়ের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনীকে ব্যবহার করেছে।
এসব তথ্যের আলোকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বিশেষ করে পুলিশ ও র্যাব প্রতিবাদ দমন, গ্রেপ্তার, এবং বিক্ষোভ দমন করতে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নিপীড়ন চালিয়েছে, যার সরাসরি নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তা কার্যকর করেন তৎকালীন সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও তাদের অধস্তন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
জুলাই আন্দোলনের পুরো ঘটনায় যৌথ দায় হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিবন্ধন (১২৭ নম্বর) করা হয়েছে। ওই অভিযোগের প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তদন্ত সংস্থার উপ-পরিচালক মো. জানে আলম খান। পরে তদন্ত করেন উপ-পরিচালক মো. আলমগীর (পিপিএম)। সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা। এ ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে ৩১ মে সম্পূরক অভিযোগ দেওয়া হয়। ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়।
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনার মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়। এ মামলায় আগামী ৩ আগস্ট সূচনা বক্তব্য এবং ৪ আগস্ট প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল-১।
৫ আগস্টের পর ট্রাইব্যুনালে গত ২৫ জুন পর্যন্ত ২৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭৩ জনকে। কারাগারে মৃত্যু হয়েছে এক আসামির।
ইএস/আরএইচ