গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিলের কর্মসূচি পালনকালে হামলার প্রতিবাদে আন্দোলন তীব্র থেকে আরও তীব্রতর হতে থাকে। এক পর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেশব্যাপী ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করে।
ওইদিনের এসব ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে। যে মামলায় আসামি করা হয়েছে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে। যদিও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ইতিমধ্যে রাজসাক্ষী হয়েছেন।
ফরমাল চার্জ মোট ১৩৫ পৃষ্ঠার। এই ফরমাল চার্জ আদালতে তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. আব্দুস সোবহান তরফদার, মো. মিজানুল ইসলাম। যেটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
আদালতের নথি ও গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে, কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের যৌথ হামলায় ১৬ জুলাই আবু সাঈদসহ আন্দোলনকারী ছয়জনকে হত্যার প্রেক্ষিতে ১৭ জুলাই সারা দেশে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিলের কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী ও সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর (পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, সোয়াট) হামলায় সহস্রাধিক আহতের ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেশব্যাপী ১৮ জুলাই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। ঢাকা ছাড়াও দেশের ৪৭টি জেলায় সাধারণ, নিরপরাধ, নিরস্ত্র, শান্তিপ্রিয় ছাত্র-জনতার ওপর শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের নির্দেশে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা আগ্নেয়াস্ত্রসহ সশস্ত্র অবস্থায় পুলিশের সহায়তায় এবং পুলিশের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বিচারে গুলি করে সারা দেশে কমপক্ষে ৩১ জনকে হত্যা করে এবং মারাত্মকভাবে জখম করে কয়েক হাজার ছাত্র-জনতাকে।
ওই দিন ঢাকা শহরের বিভিন্নস্থানে র্যাব হেলিকপ্টার ব্যবহার করে। কোটা সংস্কার ইস্যুতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ ও সরকার দলীয় সন্ত্রাসীদের হামলায় রাজধানী ঢাকা শহর রক্তে রঞ্জিত হয়। ওই কর্মসূচি ঘিরে দফায় দফায় উত্তরা, মিরপুর, রামপুরা, বাড্ডা, মহাখালী, বাসাবো, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, যাত্রাবাড়ী, আজমপুর, শনিরআখড়াসহ ঢাকা শহরের সর্বত্রই নিরীহ নিরস্ত্র, শান্তিপ্রিয় স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী, পুলিশ, র্যাব, আনসার, বিজিবি ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা নির্বিচারে গুলি করে ২৫ জনকে হত্যা করে এবং সহস্রাধিক ছাত্র-জনতাকে মারাত্মকভাবে জখম করে। অনেক শিক্ষার্থী চোখে, মুখে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলির আঘাতে স্থায়ীভাবে অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্ব বরণ করেন। উত্তরা আজমপুর এলাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল নিয়ে মূল সড়কে উঠলে সশস্ত্র আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী, পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা যৌথভাবে হামলা করে এবং নির্বিচারে গুলি করে।
রাজধানীর ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, বনশ্রী আইডিয়াল কলেজসহ বিভিন্ন স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীরা রামপুরা ব্রিজ এলাকায় শান্তিপূর্ণ মিছিল নিয়ে জড়ো হলে পুলিশ নির্বিচারে তাদের ওপর হামলা ও গুলিবর্ষণ করে। একইভাবে যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, মিরপুর, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর এবং মহাখালীতে সশস্ত্র হামলা করে। এই দিন আওয়ামী সন্ত্রাসী ও পুলিশের নির্বিচারে হামলায় ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থী ফারহান ফাইয়াজ গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। সাভারে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের গুলিতে শহীদ হন মিরপুরের এমআইএসটির শিক্ষার্থী আসহাবুল ইয়ামিন, যাকে গুলি করে এপিসি থেকে টেনে-হিঁচড়ে রাস্তার ওপর ফেলে দেওয়া হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে পুলিশ। এ ঘটনায় পাঁচজন গুরুতর জখমসহ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় মুরাদ চত্বর এলাকায় গাড়ি থামিয়ে ভেতরে থাকা আহত শিক্ষার্থীদের মারধর করতে থাকে পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল মামুন ভিডিও করতে গেলে তার ওপর হামলা চালায় পুলিশ। এদিন রাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটও বন্ধ করে দেয় তৎকালীন আওয়ামী সরকার। এ ছাড়া আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হত্যার উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যে নির্দেশনা দিতে দেখা যায় আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতাদের। তৎকালীন আওয়ামী সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এদিন হুমকি দিয়ে বলেন ‘আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অস্ত্র জমা দিয়েছি, ট্রেনিং জমা দিইনি, চেতনা জমা দিইনি’।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরের বহদ্দারহাটে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা। আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ নির্বিচারে হামলা ও গুলিবর্ষণ করে। নগরের বিভিন্ন এলাকায় নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আওয়ামী লীগ, আওয়ামী সহযোগী সংগঠন ও পুলিশের হামলায় অন্তত দুজন শহীদ ও সাতজন গুলিবিদ্ধ এবং অর্ধশতাধিক ছাত্র-জনতা আহত হন। শহীদদের মধ্যে ইমাদ চট্টগ্রামের পটিয়া কলেজের ছাত্র। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধদের অধিকাংশই চট্টগ্রাম মহানগরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়াও দেশের অধিকাংশ জেলায় ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে হামলা করে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, সশস্ত্র সন্ত্রাসী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। নরসিংদী শহরের জেলখানার মোড়ে পুলিশের ছোড়া গুলিতে নরসিংদীর নাছিমা কাদির মোল্লা হাইস্কুল অ্যান্ড হোমসের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাহমিদ ভূঁইয়া এবং নরসিংদি আইডিয়াল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইয়ামিন ওরফে ইমন শহীদ হন। পরে তাহমিদের লাশ নিয়ে মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে ছাত্র-জনতা। মাদারীপুরে পুলিশ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হামলায় মাদারীপুর সরকারি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র দীপ্ত দে শহীদ হন। এ সময়ে আন্দোলনরত অনেকে গুলিবিদ্ধ হন।
একইভাবে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণ ও হামলায় বগুড়া, রাজশাহী, বরিশাল, ময়মনসিংহ, মুন্সিগঞ্জ, শেরপুর, গাইবান্ধা, টাঙ্গাইল, চুয়াডাঙ্গা, কুমিল্লা, ফেনী, নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, নাটোর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরা, কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী ও মানিকগঞ্জে গুলিবিদ্ধসহ কয়েক হাজার ছাত্র-জনতা ও সাংবাদিক আহত হন। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ড ও হাসপাতালের বেডে স্থান সংকুলান না হওয়ায় গুলিবিদ্ধ শত শত শিক্ষার্থীকে ফ্লোর এবং বারান্দায় রাখা হয়। যাদের অনেকেরই স্থায়ীভাবে দৃষ্টিশক্তি বিনষ্ট হয়।
শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন উসকানি, প্ররোচনা, উৎসাহ, সহায়তা সর্বোপরি তাদের অধঃস্তনদের নির্দেশ দেওয়ার মাধ্যমে এসব মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছেন।
এদিনের ঘটনাসহ জুলাই আন্দোলনের পুরো ঘটনায় যৌথ দায় হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিবন্ধন (১২৭ নং) করা হয়। ওই অভিযোগের প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক মো. জানে আলম খান। পরে তদন্ত করেন উপপরিচালক মো. আলমগীর (পিপিএম)। সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা। এ ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরবর্তীতে ৩১ মে সম্পূরক অভিযোগ দেওয়া হয়। ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়।
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনার মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়। এ মামলায় আগামী ৩ আগস্ট সূচনা বক্তব্য এবং ৪ আগস্ট প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল-১।
৫ আগস্টের পর ট্রাইব্যুনালে গত ২৫ জুন পর্যন্ত ২৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭৩ জনকে। কারাগারে মৃত্যু হয়েছে এক আসামির।
ইএস/এমজেএফ