ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২০ মে ২০২৫, ২২ জিলকদ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

এনবিআর ভাঙা তুঘলকি, নিরপেক্ষ বিশ্লেষণনির্ভর সিদ্ধান্ত হোক

জাফর আহমদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:৫৩, মে ১৯, ২০২৫
এনবিআর ভাঙা তুঘলকি, নিরপেক্ষ বিশ্লেষণনির্ভর সিদ্ধান্ত হোক গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলছেন আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিনিধি

দেশে রাজস্ব আহরণের প্রধান প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংস্কারের অংশ হিসেবে ভেঙে দুই ভাগ করা হচ্ছে। এখন রাজস্ব আদায়ের ‘নীতি’ ও ‘বাস্তবায়ন’ নামে ভিন্ন দুটি বিভাগ হবে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভাগ করার ফলে রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি কমবে এবং রাজস্ব আদায় বাড়বে।

অন্যদিকে সংস্কারের এই প্রক্রিয়াকে অস্বচ্ছ মনে করছেন এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, গবেষক ও অংশীজনরা। তারা মনে করেন, রাজস্ব বোর্ড সংস্কারে গঠিত কমিটির সুপারিশ পুরোপুরি গ্রহণ না করে তড়িঘড়ি করে তুঘলকি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।  

এনবিআরের প্রায় সব পর্যায়ের কর্মচারীরা এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তারা প্রকাশ্যে বিক্ষোভ ও কলমবিরতির মাধ্যমে প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে অর্থ উপদেষ্টাসহ আরও কয়েকজন উপদেষ্টার সঙ্গে বুধবার (২০ মে) বিকেল সাড়ে ৩টায় মন্ত্রণালয়ে বৈঠকের প্রতিশ্রুতিতে কর্মসূচি স্থগিত করেছেন তারা।  
 
এনবিআর সংস্কারের সঙ্গে রাজস্ব আদায় বাড়ানো, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্যাডারগুলোর মতামত গ্রহণসহ নানা বিষয় সংশ্লিষ্ট আছে। এ বিষয়ে দক্ষ লোক ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সংস্কার করা প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে কী বলা হয়েছে জানি না। কিন্তু কমিটি যে সুপারিশ করেছিল, প্রজ্ঞাপনে তা পুরোপুরি আসেনি। অন্তত গণমাধ্যম থেকে যেটা দেখেছি, তাতে বোঝা যাচ্ছে-এটা নিয়ে দ্বিমত আছে। দ্বিতীয়ত হলো, যে প্রস্তাবই করুক না কেন, তা বাস্তবায়নের জন্য একটি সুস্পষ্ট পথ নকশা করতে হবে। রাজস্ব বোর্ড এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠেছে। এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে যে ধরনের রিস্ক ফ্যাক্টর আছে, ঝুঁকি- এসব বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন আছে।

তৃতীয়ত হলো, সংস্কার কমিটির প্রস্তাব যদি এমনই থাকে এনবিআরকে শুধু দুই ভাগে ভাগ করতে হবে- এটা যদি বাস্তবসম্মত হয়ও এর উদ্দেশ্য কী? সেই উদ্দেশ্যটা যদি রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি করা বা কর-জিডিপির হার বাড়ানো হয়, তাহলে এই প্রতিষ্ঠানকে দুই ভাগে ভাগ করলেই কি তা হবে? এমন বড় একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটি গবেষণামূলক গ্রহণযোগ্য গবেষণার ওপর ভিত্তি করে যদি করা হতো তাহলে এ ধরনের আলোচনা আসতো না।

তিনি বলেন, সে ক্ষেত্রে কস্ট বেনিফিট অ্যানালাইসিস করে দেখার প্রয়োজন ছিল। অর্থাৎ আমি যে কাজটি করছি, তা থেকে আমি কতটুকু বেনিফিট পাবো, কতটুকু লস হবে। এটা করা হয়েছে কি না এবং বাস্তবে কর আহরণ বাড়বে কি না। এটা যদি লক্ষ্য হয়, তাহলে সেটা কতটুকু অর্জন হবে? এ ধরনের বিশ্লেষণ করার সুযোগ আছে। অভিজ্ঞ আর অংশীজনদের সম্পৃক্ত করে সেটা করা যেত।  

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এখানে একটি উপাদন কাজ করতে পারে তাহলো, আইএমএফ-এর পক্ষ থেকে একটা চাপ ছিল। এখানেও কথা আছে, আইএমএফ কি সুনির্দিষ্ট করে এনবিআর ভেঙে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিল, নাকি বাংলাদেশের কর জিডিপির হার বাড়ানোর জন্য চাপ দিয়েছিল? আর সেটা করার জন্য এটাই কি সমাধান, নাকি অন্য সমাধানও আছে? দেশে যারা যোগসাজস করে বড় বড় অংকের কর ফাঁকি দেয়, সে সমস্যার সমাধান কি এনবিআরকে ভাগ করলেই হয়ে যাবে? যারা এটা করেছেন তাদের আগে থেকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রস্তুত করে রাখার দরকার ছিল। তাহলে এই সমস্যাগুলো হতো না।

এখন যাদের মধ্যে টেনশনটা দেখা যাচ্ছে, কেউ এটাকে যৌক্তিক বলবে, কেউ অযৌক্তিক বলবে। সরকারি কর্মকর্তাদের মাঝে যে বিভাজন আছে, একদিকে প্রশাসন ক্যাডার, অন্যদিক থেকে অন্য ক্যাডার। সেটারও তো একটা প্রতিফলন এখানে দেখা যাচ্ছে। সার্বিকভাবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে যে সব ঝুঁকি আছে, সেগুলো পর্যাপ্ত হয়নি বলে এমন প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে; তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, এটা ভাল বা মন্দ সে ব্যাপারে আমি বলতে চাই না, এটা কঠিন। কারণ আমি প্রতিবেদনটা দেখিনি। আমি যেটা বুঝিতে পারছি, এটা তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে; সেটা যে কোনো কারণেই হোক। এটা অনেকটা তুঘলকি স্টাইলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। যে কারণে পরিস্থিতি এমন ঘোলাটে। এটা অনাকাঙ্খিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা অ্যাফোর্ড করা যাবে না। এরপর এটি এত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এ অবস্থায় আমি মনে করি, অবশ্যই এই  সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখে বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে পর্যালোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক।  

এনবিআর সংস্কারে প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে অন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। তারা কলম বিরতিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের’ অন্যতম নেতা অতিরিক্ত কমিশনার (কাস্টমস ও ভ্যাট) সাধন কুমার কুন্ডু বলেন, আমরা চাই কমিটির মূল প্রতিবেদন আলাপ-আলোচনা করে চূড়ান্ত করা হোক, সেই আলোচনায় অনীতিবিদ, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, ব্যবসায়ী মহল, গবেষক ও গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা থাকুক। আলোচনার মাধ্যমে দেশের স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত আসে-সেটা করা হোক। তাতে দ্বিমত নেই। আমাদের প্রশ্ন, এনবিআর সংস্কার কমিটি সিদ্ধান্ত, কিন্তু সেটা পাশ কাটিয়ে অন্য কিছু করা হলো। এটা ভাল কোন ফল দেবে না বলে আমরা মনে করি।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এখন যেটা করা হয়েছে সংস্কার কমিটির প্রতিবেদনের অংশবিশেষ নিয়ে অংশীজনদের আলাপ-আলোচনা ছাড়াই প্রজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে।  

তিনি বলেন, আমরা সংস্কার চাই, সংস্কার প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেটা হতে হবে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে এবং অংশগ্রহণমূলক। অংশমূলক না হলে, স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে না হলে বৃহত্তর স্বার্থ উপেক্ষিত হওয়ার আশঙ্কা আছে।  

এনবিআরের সংস্কার কার্যক্রম ব্যবসায়ীদের অনেক দিনের প্রত্যাশিত। তারা আশা করছেন, এর মাধ্যমে আমদানি রপ্তানিতে দীর্ঘসূত্রিতা, ব্যয় হ্রাস ও অনাকাঙ্খিত সমস্যা দূর হবে। তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, এনবিআরের একটি সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। সেই সংস্কার হয়েছে। পরিবর্তন যদি এখন না করা হয় তাহলে আন্তর্জাতিক পরিসরে যে পরিবর্তন আসছে, সেখানে আমরা মোকাবিলা করে টিকে থাকতে পারবো না। পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে রাজস্ব বোর্ডের কাঠামোগত এই পরবির্তনের দরকার ছিল।  

তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তা মোকাবিলার জন্য এনবিআরকে আধুনিকায়ন করতে হবে। সেই জায়গা থেকে এই সংস্কারের প্রত্যাশা ছিল। এই বিবেচনা থেকে বাস্তবায়ন করা খুবই জরুরি। যদি বাস্তবায়ন না করতে পারি তাহলে পরিবর্তিত ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবো না।

পণ্য রপ্তানিতে এনবিআর-এর অদক্ষতা ও সংস্কারের প্রয়োজনীতার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, তৈরি পোশাকের একক প্রধান বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার পর তা তিন মাসের জন্য স্থগিত আছে। দেশটিতে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে স্থগিত শুল্ক প্রত্যাহারে আলোচনা চলছে। আলোচনায় বাংলাদেশে কাস্টম ও বন্দরের অদক্ষতার বিষয়টিও উঠে আসছে। এনবিআর যাতে কোনো সমস্যা হয়ে না দাঁড়ায় এজন্য সংস্কারের পাশাপাশি সংস্কার বাস্তবায়নে কোথায় কোথায় সমস্যা আছে, সেই বাধা দূর করতে হবে।

জেডএ/এজে
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।