ঢাকা, সোমবার, ৩ ভাদ্র ১৪৩২, ১৮ আগস্ট ২০২৫, ২৩ সফর ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

নোনা পানিতে হারিয়ে গেছে শামুক-শালুক, জীবিকায় টান মুন্ডাদের 

পিংকি আক্তার, সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে ফিরে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:৫৩, আগস্ট ১৮, ২০২৫
নোনা পানিতে হারিয়ে গেছে শামুক-শালুক, জীবিকায় টান মুন্ডাদের 

ভক্ত মুন্ডার বাড়ির সঙ্গেই সুন্দরবন সংলগ্ন নদী। তার দাদার দাদাও এই ভিটাতে ছিলেন বলে জানান তিনি।

নদীর মধ্যেই হরেক রকমের গাছ, যার মধ্য রয়েছে কেওড়া গাছ (বৈজ্ঞানিক নাম: Sonneratia apetala), গাছ থেকে কেওড়া ফল পাড়ছেন তিনি। দুপুরে এ পরিবারে খাবারের জন্য রান্না হবে কেওড়ার ফলের টক। এটি লবণসহিষ্ণু ম্যানগ্রোভ গাছ, যে কারণে এই লবণ পানিতেও এই গাছ ফল দিয়ে যাচ্ছে।  

মুন্ডা গোষ্ঠী সুন্দরবনের উপকূলীয় এলাকায় আদিবাসি জনগোষ্ঠী। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রায় ২২০ থেকে ৩০০ বছরের অধিক সময় ধরে এখানে বসবাস করছেন তারা।  

মুন্ডা জনগোষ্ঠীকে ঝাড়খণ্ড, বিহার ও চোটা নাগপুর থেকে জমিদার ও ব্রিটিশ প্রশাসনের আয়োজনে সুন্দরবনের উপকূলীয় এলাকায় কলোনি হিসেবে আনা হয় ১৭৫০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে। তারা বন পরিষ্কার করে কৃষি ও বসতি গড়ে তোলে এবং সে থেকেই এখানে বসবাস স্থায়ী হয়।  

বয়সের ভারে ন্যুব্জ গৌতম মুন্ডা, বয়স প্রায় আশির কোটায় বলে জানায় তার পরিবার। হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে  নদীর ধারে এসে বসেন তিনি। বলেন, তার চোখে এই শ্যামনগর দাতিনাখালি এলাকার পরিবর্তনের চিত্র।  

‘তপ্ত দুপুরে আগে নদী থেকে ঝাঁকি মারলেও গামছা ভর্তি করে শামুক উঠত। সেই শামুকের ঝাল ঝোল রান্না হতো, এই খাবার ছিল আমাদের গোষ্ঠীর পরিচয়। এখন কত বছর যে শামুক খাই না। নদীতে সেই শামুক আর কই!’, হাফ ছেড়ে বলেন তিনি।  

উপকূলীয় মুন্ডা জনগোষ্ঠীর খাদ্যসংস্কৃতিতে মিঠা পানির শামুক একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা পিলা গ্লোবোসা (Apple Snail), বেল্লামিয়া বেঙ্গালেনসিস ও পিলা পোলিটা প্রজাতির শামুক ভক্ষণ করে আসছেন।

এই শামুকগুলো সাধারণত মিঠা পানির। বিল, খাল ও পুকুরেও পাওয়া যায়। মুন্ডারা এগুলো সংগ্রহ করে বিশেষভাবে সিদ্ধ বা ঝোল রান্না করে খায়। এতে প্রোটিন ও মিনারেলের পরিমাণ বেশি থাকায় এটি পুষ্টিকর খাবার হিসেবেও বিবেচিত।

তবে জলবায়ু পরিবর্তন ও নোনাজলের বিস্তারের কারণে এখন এসব মিঠা পানির শামুক দিন দিন দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ছে, যা তাদের ঐতিহ্যগত খাদ্যাভ্যাস ও জীবিকায় নতুন সংকট দেখা দিয়েছে।

এই গোষ্ঠীর খাদ্য তালিকা থেকে শুধু শামুকই না, জলবায়ুর কষাঘাতে হারিয়ে যাচ্ছে অধিকাংশ ঐতিহ্যবাহী খাবারই। এমনই একটি খাবার শালুক (শাপলা ফুলের কন্দ)।  

‘শাপলা ফুলের নিচের এই অংশ আমরা মজা করে খেতাম, এতে যথেষ্ঠ পুষ্টিও থাকত, এসব খাবার খেয়ে আমরা সারাদিন কাজ করতে পারতাম আর এখন আমাদের সন্তানরা এসব খাবার চেনেই না। শালুক দিয়ে নারিকেল আর ঝাল দিয়ে ভর্তা করা হতো, সেই স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। নোনা জল আমাদের সেই স্বাদ কেড়ে নিল’, বলছিলেন ৬৪ বছর বয়সী দীপালি মুন্ডা।  

শ্যামনগরের মুন্ডা পাড়ার মানুষদের জন্য খাবার কখনো শুধু বেঁচে থাকার উপায় ছিল না, এটা ছিল তাদের পরিচয়, উৎসব, ঋতুর বার্তা। শিশুদের কচি শামুক তুলে শেখাত প্রকৃতির পাঠ। এখন সেই খাবার শুধু গল্পে থাকে, পাতে না।

মুন্ডা জনগোষ্ঠীর খাদ্য সংস্কৃতিতে একসময় ইঁদুরও ছিল পরিচিত প্রোটিনের উৎস। ধান কাটা শেষে মাঠে ইঁদুর শিকার করে তা রান্না করে খাওয়া ছিল তাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের অংশ। তবে লবণাক্ততার কারণে ধানি কৃষিজমি হ্রাস, ধান চাষের পরিমাণ কমে যাওয়ায় এখন আর আগের মতো ধানক্ষেতে ইঁদুর মেলে না। ফলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এই অনন্য খাদ্যাভ্যাস। প্রবীণ মুন্ডা আফসোস করে বলেন, ‘আগে ধান কাটার পর ইঁদুর ধরা হতো উৎসবের মতো, এখন সে দিন নেই। আর আমাদের মধ্য সেই সৌহার্দ্য উৎসব আমেজও নেই। ’

সাতক্ষীরার মুন্ডা আদিবাসী সম্প্রদায় আজ খাদ্যসংকটের নতুন এক বাস্তবতায় আটকে আছে। জলবায়ু পরিবর্তন, লবণাক্ততার বাড়বাড়ন্ত আর বনজ খাবারের অবলুপ্তি সব মিলিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে শতবর্ষের খাদ্য সংস্কৃতি।

জলে লবণ, পাতে দীর্ঘশ্বাস
‘আগে আমরা নিজে ধান করতাম, চাল দিয়ে মাড় খেতাম। এখন সেসব জমিতে শুধু কাঁকড়া বা বাগদা চাষ হয়,’ বললেন অজিৎ মুন্ডা ।

গত কয়েক বছরে একের পর এক ঘূর্ণিঝড় আইলা, আম্পান, সিত্রাং মুন্ডা পাড়ার জমিগুলোকে করে তুলেছে চাষের অযোগ্য। লবণাক্ততা এত বেড়েছে যে একটা মৌসুমেও আমন বা বোরো উঠানো যাচ্ছে না। জমি এখন বাগদা চিংড়ির খামারীদের হাতে, আর মুন্ডারা দাঁড়িয়ে থাকে বাঁধের ওপারে।

মুন্ডারা আগে খাবার সংগ্রহ করতো বনজ উৎস থেকে। গাজর-লতা, বনচালতা, মাশরুম, কচুশাক, শাপলা বা শালুক সব ছিল তাদের রসনার গর্ব। কিন্তু বনভূমির সংকোচন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব তাদের এসব খাবার থেকে বঞ্চিত করছে।  
 

উৎসবের থালায় এখন কেনা চাল 
সারহুল, কারম, নতুন ধানের উৎসব এসব অনুষ্ঠানে মুন্ডা সমাজে খাবার ছিল সংস্কৃতির মূল বাহক। নতুন চাল দিয়ে পিঠা বানানো, বনফল দিয়ে মিষ্টি, বিশেষ দিনে শুকনো শামুকের ঝোল আর বিশেষ তৈরি হাড়িয়া সবই হারিয়ে যাচ্ছে।

মুন্ডা তরুণী বাসন্তী বললেন, ‘আগে মা একটা বিশেষ শালুক রান্না করতেন কারমে (ধর্মীয় উৎসব)। এখন সে শালুকই পাই না। বাজার থেকে চাল কিনে পোলাও করি, কিন্তু সেটা কি উৎসবের স্বাদ দেয়?’

মুন্ডা জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী মদ ‘হাড়িয়া’ বিভিন্ন সামাজিক উৎসব, বিয়ে ও নবান্ন উপলক্ষে পান করা হয়। চাল, কুচানো কুজ গাছের পাতা (বৈজ্ঞানিক নাম: Careya arborea) ও পানি মিশিয়ে এটি এক সপ্তাহ ধরে পচিয়ে তৈরি করা হয়। এই প্রাকৃতিক মদ তাদের সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। তবে বর্তমানে কুজ গাছের সংকটে হাড়িয়া তৈরিতেও সমস্যায় পড়েছেন তারা।  

“এই যে উৎসব পার্বণ হয় এইসবে আমরা নাচ, গান করি ভাং খাই, যেটা হাড়িয়া নামে পরিচিত। এটি আমাদের ‘হোমমেইড ওয়াইন’ বলি আমরা। আর এখন এই হাড়িয়া বানালেও সেই মজা নেই, কারণ এই হাড়িয়া বানানোর কয়েকটি উপাদানের মধ্য কুজ গাছের পাতা একটি, যেটি এখন আইলার পর আর এ এলাকায় পাওয়া যাচ্ছে না। জলবায়ু অভিযোজনে নানা রকম শাক, সবজি উৎপাদনের উপায় করা হয়েছে কিন্তু এই যে আমাদের সংস্কৃতির খাবারগুলো যে আমরা হারাচ্ছি সেদিকে কারও নজর নেই। ঐ খাবারগুলো আমাদের প্রোটিনের, ক্যালসিয়াম শক্তির উৎস ছিল। শামুক ছিল আমাদের সবচাইতে সহজ প্রোটিনের উৎস। এখন এসব খাবার বিদায় নিচ্ছে এই এলাকার লবণ জলের কারণে। সেই সাথে আমরা হারাচ্ছি আমাদের ঐতিহ্য। খাদ্য শুধু স্বদের বিষয়ই না, এটি আমাদের গোষ্ঠীর পরিচয়ও বটে। ” বলছিলেন সুন্দরবন আদিবাসী মুন্ডা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক কৃষ্ণ মুন্ডা।  

নারীর হাতেই ছিল রন্ধন শিল্প, এখন শুধুই সংগ্রাম
মুন্ডা নারীরাই ছিল তাদের পরিবার ও সমাজের ‘ফুড কিপার’। শাক চিনে তোলা, জ্বাল দিয়ে শামুক তৈরি, মৌসুমি কন্দ (ঋতুভিত্তিক শাক- সবজির গাছের মূল বা কাণ্ডের নিচের অংশে জন্মে যা সাধারণত বর্ষা, শরৎ বা হেমন্তে সংগ্রহ করা হয়)  সংগ্রহ সব দায়িত্ব ছিল নারীদের কাঁধে। এখন সেই নারীরা নোনাজলে দাঁড়িয়ে খাবারের পাতের জন্য চিংড়ির পোনা আর কাঁকড়া খুঁজে বেড়ায়।

ইউটিআই, ত্বক সমস্যা, হাড় ক্ষয় এই রোগগুলো উপকূলীয় নারীদের শরীরে ঝুলে আছে। অথচ তাদের স্বাস্থ্য বা খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে নেই কোনো টেকসই কর্মসূচি।

উদ্ধার না হলে হারাবে এক ঐতিহ্য, এক পরিচয়
যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্যা ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা- এফএও ও জাতিসংঘের অন্যান্য জোটের আলোচনা বিষয়ক গ্লোবাল ফোরাম অন ফুড সিকউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন (Global Forum on Food Security and Nutrition)–এ প্রকাশিত একটি অংশে উল্লেখ রয়েছে, বাংলাদেশে উপজাতি (indigenous communities) তথা পার্বত্য ও উপকূলীয় অঞ্চলের জনগণের মধ্যে খাদ্য বৈচিত্র্যহীনতা ও অপুষ্টির মাত্রা জাতীয় গড়ের চেয়ে বেশি। তারা স্থানীয় ও জলবায়ু সহনশীল খাদ্য যেমন— মিলেট, শালুক, বুনো শাক ইত্যাদির গুরুত্বে জোর দিয়েছেন, না হলে আদিবাসী সমাজের সংস্কৃতি, পরিচয় ও খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে ।  

কিছু উন্নয়ন সংস্থা চেষ্টা করছে ‘ক্লাইমেট স্মার্ট’ (climate-smart) কৃষি চালু করতে। কিন্তু আদিবাসীদের জীবনকে ‘প্রকল্প’ হিসেবে না দেখে, তাদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও রেসিপিকে ভিত্তি করে টেকসই পরিকল্পনা জরুরি। সেই সঙ্গে তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো টিকিয়ে রাখতেও জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ বলে মনে করছেন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সংগঠনের সদস্য-সচিব শরীফ জামিল।

এনডি
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।