ঢাকা: আগামী ত্রোয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবিতে জোরেশোরে মাঠে নামছে বিএনপি। প্রয়োজনে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘেরাও কর্মসূচি দিতে চায় দলটি।
বিএনপির সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পর থেকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। একই সঙ্গে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় সংস্কারও দ্রুততম সময়ের মধ্যে করার দাবি জানিয়েছেন দলটি।
বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের ৯ মাস পার হলেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সুনির্দৃষ্ট কোনো রোডম্যাপ এখনো ঘোষণা করেনি। আর এতেই নড়েচড়ে বসেছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি।
তারা বলছেন, প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য নয় মাস যথেষ্ট। কিন্তু এখনো পর্যন্ত নির্বাচনী প্রক্রিয়ার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। যার কারণে দেশে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা বিরাজমান। আর এটা থেকে উত্তরণের জন্য নির্বাচিত সরকারই একমাত্র উপায়। কিন্তু সরকার সেটি না করে সংস্কারের ধোঁয়া তুলে অহেতুক কালক্ষেপণ করছে। যা দেশকে পেছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আর এ কারণেই দ্রুত নির্বাচনী রোড ঘোষণার দাবিতে জোরালো ভাবে রাজপথে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি।
দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে ইতিমধ্যে বিএনপি তার সমমনা রাজনৈতিক মিত্রদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেছে। এসব বৈঠকে মিত্ররা আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে একমত।
এদিকে প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের দাবি-দাওয়া নিয়ে সভা-সমাবেশ থেকে শুরু করে বিক্ষোভ মিছিল, অবস্থান-ধর্মঘট, গণঅনশনসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করছেন তারা।
বিএনপি নেতারা বলছেন, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিনিয়ত এই সংস্কার চলতে থাকবে। যা ইতিপূর্বে বিএনপি সরকারে থাকাকালীন এবং দলীয় পর্যায়ে করে এসেছে। তারা বলছেন এই মুহূর্তে বাংলাদেশে স্থিতিশীল পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নেই। এ কারণে বিএনপি যেহেতু জনগণের দল, তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচনী রোড ম্যাপ ঘোষণা না হলে রাজপথে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।
বিএনপি সূত্র মতে, বিএনপি এখন রাষ্ট্র মেরামতের দলীয় রূপরেখা ৩১ দফাকে ব্র্যান্ডিং করছে। বিভাগ- জেলাসহ বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কর্মশালা চলছে। এতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হচ্ছেন। নির্বাচনের দাবিতে সারাদেশে সভা-সমাবেশ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে দিনক্ষণ এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
জানা গেছে, নির্বাচনী রোড ম্যাপ ঘোষণার দাবিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে কয়েকবার আলোচনা হয়েছে। সম্ভাব্য কী কর্মসূচি দেওয়া যায়, এ নিয়েও একাধিক নেতা বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন, সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়া উচিত হবে না। কারণ, সরকার ফেল করলে, সেটি হবে সামগ্রিক ব্যর্থতা। বিএনপি এ সরকারকে ব্যর্থ দেখতে চায় না। তারা চান, সরকার একটি অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে তাদের কাজ সম্পন্ন করুক। যে কারণে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়া উচিত হবে না। এ কারণে বিএনপির উচিত হবে নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং জনগণ যে ভোট দিতে উন্মুখ হয়ে রয়েছেন, সেটি তুলে ধরে সারাদেশে বড় বড় সমাবেশ করা।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বাংলানিউজকে বলেছেন, বিএনপির চায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনে আবারো রাজপথে নামতে চাই বিএনপি। তবে কবে নাগাদ এবং কোন পদ্ধতিতে আন্দোলন করবে সেটা এখনো ঠিক হয়নি। সময় হলে জানানো হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, নির্বাচন যত বিলম্বিত হচ্ছে, দেশকে তত বেশি অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। জাতি এখন এক গভীর শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ এখন এক অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে আছে। দেশ কোথায় যাচ্ছে, কেউ জানে না। সবাই মিলে স্বৈরাচারকে বিদায় করেছে। এরপর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেশ পরিচালনার যে প্রত্যাশা ছিল, তা হয়নি।
তিনি বলেন, সরকার এমনভাবে কাজ করছে যেন তারা একটি নির্বাচিত সরকার। অথচ এটি একটি অন্তর্বর্তী সরকার। তাদের দায়িত্ব ছিল একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করে ক্ষমতা নির্বাচিত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বাংলানিউজকে বলেন, আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে বলে আসছি অতি দ্রুত নির্বাচনী রোড ম্যাপ ঘোষণা করার জন্য। কারণ নির্বাচিত সরকার ছাড়া বর্তমান দেশের অরাজক পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। আমরা সরকারকে সতর্ক করেছি নির্বাচিত সরকার ছাড়া রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা বাড়বে। ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নাজুক হয়ে পড়েছে, বাজার পরিস্থিতিও ভালো না, শিক্ষাঙ্গনে ও লেখাপড়া হচ্ছে না, বিদেশি বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। আর এর মূল কারণ হচ্ছে অনির্বাচিত সরকার।
তিনি আরও বলেন গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশে অভ্যুত্থান হয়েছে। সরকারের ৯ মাস অতিবাহিত হতে গেলেও নির্বাচনী রোড ম্যাপ দিতে তাদের একেবারেই অনীহা। কিন্তু তার যে কাজ না তিনি সেই কাজে ব্যস্ত। করিডোর দেয়া, বিদেশিদের হাতে বন্দুক তুলে দেয়া এটি তার কাজ নয়। এটি একটি নির্বাচিত সরকারের কাজ। অথচ তাদের যে কাজ তারা সেটা করছে না। এ কারণে আমরা বলেছি আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের নির্বাচন ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু আন্দোলনের ধরন বা সময় কী হবে সে বিষয়ে এখনো দলের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। কখন কীভাবে আন্দোলন হবে সেটা সিদ্ধান্ত নিলে জানা যাবে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেছেন, তারেক রহমান আমাদের ধৈর্য ধরতে বলেছেন, তাই আমরা ধৈর্য ধরে আছি। কিন্তু ধৈর্যের ফল যদি হয় বিলম্বিত নির্বাচন, তাহলে সেই বাঁধ আমরা ভেঙে ফেলব।
বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বাংলানিউজকে বলেন, যে সকল সংস্কার জরুরি সেগুলো সম্পন্ন করে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করবে এটিই ছিল প্রত্যাশা। আর যে সব সংস্কার সংসদ ছাড়া করা সম্ভব নয় সেগুলো একটি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে করতে হবে। তবে আমরা একটি বিষয় একমত হতে পারি, যে বিষয়গুলো সংশোধনের জন্য সংসদের প্রয়োজন নেই সেই বিষয়গুলো দ্রুত করে ফেলি এবং যে বিষয়গুলো সংসদ ছাড়া সংস্কার করা সম্ভব নয় সেই বিষয়গুলো সংসদের উপরেই ছেড়ে দেই। আর যে বিষয়গুলো একমত হতে পারব না সে বিষয়গুলো ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে তুলে ধরবে। নির্বাচনের যে দল জয়লাভ করবে তারা সেই সংস্কারগুলো সম্পন্ন করবে।
তিনি আরো বলেন, যদি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ না হয়, কার্যকর কোন পদক্ষেপ যদি না নেয়া হয় তাহলে আমরা যেহেতু জনগণের জন্য রাজনীতি করি, প্রয়োজনের জনগণের দাবি নিয়ে আমাদের আবারো রাজপথে নামতে হবে। সেজন্য এখনো কোনো কর্মসূচি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয়নি। সেটি হলে অবশ্যই আমরা আবারো আন্দোলনে নামবো। সেটা সময় বলে দেবে আমারা কখন আন্দোলনে নামবো, কিভাবে নামবো, প্রক্রিয়াটা কী হবে। সেটা এই মুহূর্তে বলবো না, বলার সময়ও আসেনি।
টিএ/এমএম