ঢাকা: জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের শুরুর দিকে ১০ থেকে ১১ জুলাইয়ের এক রাতে শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গোপন সমঝোতার অনুমতি দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়িত্বও দিয়েছিলেন তিনি।
দমন-পীড়নের কারণে তাতে তেমন সাড়া না পেয়ে এর কয়েকদিন পর তৎকালীন তিন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকেও আলোচনার দায়িত্ব দেন। সেটি অবশ্য ছিলো প্রকাশ্য। এরপরও শেষ রক্ষা হয়নি। ধারাবাহিকভাবে নৃশংসতা চালানোয় ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। পরবর্তী সময়ে ছাত্রদের প্রস্তাব গ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে তৎকালীন শীর্ষ কর্মকর্তাদের বরাতে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করা এই প্রতিবেদন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের সহজবোধ্যভাবে বোঝার সুযোগ করে দিতে অনলাইন নিউজপোর্টাল বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এর সম্পাদকীয় বিভাগ ইংরেজি থেকে হুবহু বাংলায় অনুবাদ করেছে। বাংলায় অনুদিত সেই প্রতিবেদনটি ধারাবাহিকভাবে পাঠকদের কাছে সংবাদ আকারে তুলে ধরা হচ্ছে। আজ থাকছে সেই প্রতিবেদনের অষ্টম পর্ব।
প্রতিবেদনের তথ্য মতে, গোপন সমঝোতার আলোচনার সিদ্ধান্তের মধ্যে ১১ জুলাই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন প্রকাশ্যে হুঁশিয়ারি দেন, ‘কেউ কেউ আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করছে, আর ছাত্রলীগ তাদের মোকাবিলায় প্রস্তুত’। সেই দিনই পুলিশ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলনে লাঠিচার্জ ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে। এ ছাড়া শাহবাগ এলাকায় শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয় এবং চট্টগ্রামেও একই ধরনের ঘটনার খবর পাওয়া যায়। ১৩ জুলাই ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) আন্দোলনে (বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের) কথিত ‘অনু প্রবেশের’ তদন্ত শুরু করার ঘোষণা দেয়।
এর মধ্যে ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘ওদের (ছাত্র আন্দোলনকারীদের) মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এত ক্ষোভ কেন? যদি মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা কোটার সুবিধা না পায়, তাহলে কি রাজাকারদের নাতি-নাতনিরা সেই সুবিধা পাবে?’
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর ‘রাজাকার’ মন্তব্যে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণের শিকার বলে মনে করেন। বাংলাদেশে এই শব্দটি অত্যন্ত অবমাননাকর, যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগীদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। ১৪ জুলাই সন্ধ্যায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের বিশাল জমায়েত বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং স্লোগান তোলে—‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার’। এই স্লোগান দ্রুত আন্দোলনের মূল কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়, যা পরে আরেকটু দীর্ঘ হয়ে দাঁড়ায়— ‘কে বলছে? কে বলছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার!’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত ছাত্রী রাতে হলের তালা ভেঙে বিক্ষোভে যোগ দেন।
১৭ জুলাই সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের সুপ্রিমকোর্টের সিদ্ধান্তের জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার আহ্বান জানান। তিনি ১৬ জুলাইয়ের প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করেন এবং দাবি করেন, আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ সহযোগিতা করেছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ আন্দোলনের নেতাদের কাছে আন্তরিক বলে মনে হয়নি। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেশ জুড়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউনের’ ডাক দেয়। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতারা তাদের নেতা কর্মী ও সমর্থকদের এই শাটডাউনকে সমর্থন করার আহ্বান জানায়।
এই পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য আইনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও তথ্য প্রতিমন্ত্রীকে দায়িত্ব দেন। একই সঙ্গে গোয়েন্দাদের প্রচেষ্টাও চলতে থাকে। তবে তখন শিক্ষার্থীরা আর আলোচনায় আগ্রহী ছিলেন না, কারণ আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলার পর সরকারের সদিচ্ছার প্রতি তাদের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়।
ঘটনার ধারাবাহিকতা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৮ জুলাই থেকে সাধারণ জনগণও রাস্তায় নেমে আসে। আন্দোলনকারীরা গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় নিরাপত্তাবাহিনী দমন-পীড়নে প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের পথে হাঁটে। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে নিরাপত্তা বাহিনী রাইফেল, পিস্তল ও শটগানের পাশাপাশি কম প্রাণঘাতী অস্ত্রও ব্যবহার করে। এর ফলে উত্তরাসহ বিভিন্নস্থানে হত্যাকাণ্ড ঘটে, পাশাপাশি আহতদের চিকিৎসা সেবায় ইচ্ছাকৃতভাবে বাধা দেওয়া হয় ।
২৩ জুলাই পর্যন্ত দেশে পূর্ণাঙ্গভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করার আদেশ দেয়। রামপুরা ও বাড্ডাসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থান এবং দেশের বিভিন্নস্থানে লোকজনের জমায়েত লক্ষ্য করে গুলি চালায়, তবে তারা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ বা সহিংস অস্থিরতা থামাতে পারেনি। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে কারফিউ আরোপের নির্দেশ দেন। নিরাপত্তা বাহিনী বড় ধরনের অভিযান চালায়, যাতে তারা আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে এবং গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো চালু রাখতে রাইফেল ও শটগান ব্যবহার করে। এর মধ্যে ছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কমুক্ত করতে যাত্রাবাড়ীতে যৌথ অভিযান।
২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট একটি নতুন রায় দেন। এর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। সরকার দ্রুত আদালতের রায় মেনে নেয় এবং তা প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয়। তবে তখনই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি আরও বাড়িয়ে দেয়। তাদের দাবির মধ্যে ছিল তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ কয়েকজনকে বরখাস্ত করা এবং হত্যাকাণ্ডে দায়ী পুলিশ সদস্য ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের শাস্তির আওতায় আনা।
এরপর আন্দোলনের তীব্রতা কিছুটা কমে গেলেও গণগ্রেপ্তার, নির্যাতন ও অমানবিক আচরণ শুরু হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, পথে ঘাটে আন্দোলনের তীব্রতা সাময়িকভাবে কমে গেলেও নিরাপত্তাবাহিনী আন্দোলনে জড়িত সন্দেহে শিক্ষার্থী, বিরোধী সমর্থকসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যাপক গ্রেপ্তার অভিযান শুরু করে। অনেক সময় তাদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কার্যকলাপের কোনো প্রমাণ ছাড়াই আটক করা হয় এবং বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে তাদের ওপর নির্যাতন ও অমানবিক আচরণ করা হয়। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য অনুযায়ী, কর্তৃপক্ষ ছয় ছাত্রনেতাকে (বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক) গ্রেপ্তার করে আটকে রাখে। ২৮ জুলাই তৎকালীন গোয়েন্দা প্রধান (মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ) একটি ভিডিও প্রকাশ করেন। তাতে ছাত্র নেতাদের আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে বাধ্য করা হয়। এ ঘটনায় জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম হয়।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫ জুলাই ভাঙচুরের শিকার একটি মেট্রোস্টেশন এবং ২৬ জুলাই অগ্নিসংযোগের শিকার বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন পরিদর্শন করেন। একই দিনে তিনি বিভিন্ন হাসপাতালে যান, যেখানে পুলিশ ও বিজিবির গুলিতে আহত অনেককে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। ২৮ জুলাই তিনি নিহত শিক্ষার্থীদের পরিবারের সদস্যদের নিজ বাসভবনে আমন্ত্রণ জানান। তিনি প্রকাশ্যে সব সহিংসতা ও প্রাণহানির সম্পূর্ণ দায় বিরোধীদলগুলোর ওপর চাপিয়ে দেন।
এর মধ্যে ৩০ জুলাই সরকার জামায়াতে ইসলামী ও তাদের অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এসব ঘটনা ২০২৪ সালের আগস্টের শুরুতে গণবিক্ষোভ ও সহিংস আন্দোলন পুনরায় ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।
যখন আন্দোলন আবার জোরালো হয়, তখন আন্দোলনকারীরা একটিই দাবি তোলেন— তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পদত্যাগ। এর প্রতিক্রিয়ায় নিরাপত্তা বাহিনী কঠোর ব্যবস্থা নেয়, এমন কি প্রাণঘাতী শক্তিও ব্যবহার করে। আগস্টের শুরুতে একজন জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও মন্ত্রিসভার একজন সদস্য ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীকে নিরাপত্তা বাহিনীর শক্তি ব্যবহারের বিষয়ে উদ্বেগ জানান।
পরে বিক্ষোভকারীরা ৫ আগস্ট মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির পরিকল্পনা করেন (‘মার্চ অন ঢাকা’)। এর আগের দিন ৪ আগস্ট, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে বিভিন্ন বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রধানসহ স্বরাষ্ট্র, শিক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। তারা ঢাকা অভিমুখী মার্চ ঠেকাতে কারফিউ পুনরায় জারি এবং তা কঠোরভাবে বাস্তবায়নের বিষয়ে আলোচনা করেন। ৪ আগস্ট রাতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেন যে ঢাকা সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ আগস্ট লাখো বিক্ষোভকারী কেন্দ্রীয় ঢাকার দিকে এগিয়ে যান। বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও সশস্ত্র আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়। তবে সেনাবাহিনী ও বিজিবি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় থাকে এবং বিক্ষোভকারীদের অগ্রসর হতে দেয়।
এর মধ্যে দুপুর ২টার দিকে সশস্ত্র বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে শেখ হাসিনাকে ঢাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং পরে তিনি বোন রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে যান। এর কিছুক্ষণ পরই আন্দোলনকারীরা তার সরকারি বাসভবনে প্রবেশ করেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০২৫
ইএস/এজে