ঢাকা, শুক্রবার, ২০ ভাদ্র ১৪৩২, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

অন্যান্য

বিনিয়োগে ‘দাওয়াই’ নির্বাচিত সরকার

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:১৪, সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৫
বিনিয়োগে ‘দাওয়াই’ নির্বাচিত সরকার ছবি: সংগৃহীত

দেশে বিনিয়োগপ্রবাহে স্থবিরতা চলছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নীতিগত অনিশ্চয়তার কারণে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগে আস্থা পাচ্ছেন না।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মতে, বিনিয়োগকারীরা চান ধারাবাহিক নীতি এবং দীর্ঘমেয়াদি দিকনির্দেশনা। নির্বাচিত সরকার এই ধারাবাহিকতা দিতে পারে, আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া বিনিয়োগের গতি ফেরানো সম্ভব নয়।

ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, বিনিয়োগে স্থবিরতা দেশের অর্থনীতিকে সরাসরি প্রভাবিত করছে। কর্মসংস্থান ব্যাহত হচ্ছে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকট, ঋণের ব্যয় বৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং জ্বালানিসংকটের কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ পতনের দিকে। অনিশ্চয়তার কারণে নতুন বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিতে চাইছেন না; বিদ্যমান ব্যবসায়ীরাও নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগে যাচ্ছেন না।

তাঁরা দীর্ঘমেয়াদি নীতি ও স্থিতিশীলতার জন্য নির্বাচিত সরকারের জন্য অপেক্ষা করছেন।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এখন সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা। বিনিয়োগকারীরা সব সময় স্থিতিশীলতা খোঁজেন। জ্বালানি সমস্যার সমাধান সম্ভব, কিন্তু রাজনৈতিক সহিংসতা বা সড়ক অবরোধ দেখলেই বিনিয়োগকারীরা পিছিয়ে যান।

নির্বাচিত সরকার এলে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। ’

জুলাইয়ে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি ৬.৫২ শতাংশ
বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি তেমন বাড়ছে না। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও তেমন উন্নতি হয়নি বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৬.৫২ শতাংশ। আগের মাস জুনে যা ছিল ৬.৪৯ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে গত ২২ বছরের যে তথ্য রয়েছে তাতে এই প্রবৃদ্ধি তার মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে একবার প্রবৃদ্ধি কমে ৬.৮২ শতাংশে নেমেছিল। করোনাভাইরাসের মধ্যেও বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ৭.৫ শতাংশের ওপরে ছিল।

গত জুলাই মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬.৫২ শতাংশ। আগের মাস জুনে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬.৪৯ শতাংশ। জুনের তুলনায় জুলাইয়ে সামান্য কিছুটা বৃদ্ধি হয়েছে। এবারের মুদ্রানীতিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ৭.২৮ শতাংশ ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা। আগের মাস জুনে ছিল ১৭ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা। এক বছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬.৫২ শতাংশ।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ অন্তত দুই বছর ধরেই হ্রাসমান। এর মূল কারণ সামষ্টিক অর্থনীতির যে সংকটে আমরা পড়েছিলাম, সেখানে টাকার প্রায় ৪০ শতাংশ অবমূল্যায়ন, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, রিজার্ভের দুর্বল অবস্থার কারণে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করা—এসবের আমদানি হোঁচট খায়। আমদানি কমে যাওয়ায় ট্রেড ফিন্যানসিংয়ের চাহিদাও নিম্নমুখী হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে গেছে। যে কারণে শিল্পোৎপাদন ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি ব্যাপকভাবে হোঁচট খেয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবেলা করতে গিয়ে নীতি সুদহার দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। ফলে ঋণ অনেক ব্যয়বহুল হয়ে গেছে, যা ১৬ শতাংশ অতিক্রম করেছে। জ্বালানি সংকট গত এক বছরে তীব্র হয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা ঋণ নিতে আগ্রহ হারিয়েছেন। এমন একটি সামষ্টিক অর্থনীতির সংকটে নতুন বিনিয়োগ কম হয়। বিদ্যমান ব্যবসায়ীরাও নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছেন না। অন্তর্বর্তী সরকার সামষ্টিক অর্থনীতির কিছু দিক সামাল দিলেও মূল্যস্ফীতি এখনো উচ্চমাত্রায় রয়েছে। সাময়িক সময়ের সরকারের সময় বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক তথা নির্বাচিত সরকারের জন্য অপেক্ষা করতে চান, যাতে বিনিয়োগে দীর্ঘমেয়াদি নীতি ও দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়।

বিনিয়োগের বর্তমান চিত্র
২০২৪ সালে বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রায় ২.২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৫ শতাংশ কম। নতুন শিল্প ও অবকাঠামো প্রকল্পের অনুমোদন গত ছয় মাসে প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে। তবে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) জানিয়েছে, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মোট ১.২৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছে। এর মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ৪৬৫ মিলিয়ন ডলার, স্থানীয় বিনিয়োগ ৭০০ মিলিয়ন ডলার এবং যৌথ বিনিয়োগ ৮৫ মিলিয়ন ডলার।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, নির্বাচিত সরকার ছাড়া নীতিমালা ও কর সুবিধা নিয়ে অনিশ্চয়তা বিনিয়োগ স্থবির করছে। নির্বাচিত সরকার বিনিয়োগকারীদের আস্থা নিশ্চিত করে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করেন।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘নির্বাচিত সরকারের অনুপস্থিতিতে নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা কঠিন। ব্যাংকও ঋণ দিতে দ্বিধা করে। অন্তর্বর্তী সরকার বৈদেশিক খাতে সফলতা দেখালেও টেক্সটাইল খাতে করহার বাড়ানোর কারণে শিল্পের জন্য নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। করপোরেট কর ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৭ শতাংশে এবং আরএমজির কর ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে গেছে। এতে নতুন শিল্প খাত বিকাশে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের পাশাপাশি কর বাড়ানোর ফলে কারখানা বন্ধ হচ্ছে এবং শিল্প উৎপাদন কমছে। নির্বাচিত সরকার ছাড়া বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। ’

তুলনামূলক বিশ্লেষণ : এশিয়ার উদীয়মান দেশ
ভিয়েতনাম কর সুবিধা, রপ্তানি সহজীকরণ ও বিনিয়োগ সহায়তা নির্বাচন করে বিনিয়োগকে স্থিতিশীল করেছে। অন্যদিকে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে নতুন উদ্যোক্তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো হয়েছে।
কৃষি ও পরিবহন খাতে বিনিয়োগ সহজ করে অভ্যন্তরীণ বাজারে স্থিতিশীলতা এনেছে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ এই তুলনায় পিছিয়ে আছে। কর সুবিধা, বিনিয়োগের অনুমোদন প্রক্রিয়া এবং নীতিগত ধারাবাহিকতা নির্বাচিত সরকারের অনুপস্থিতিতে স্থবির হয়।

ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) সভাপতি এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান জাভেদ আখতার বলেন, ‘একজন বিনিয়োগকারী ভিয়েতনামের মতো দেশে কম কার্যকর করহার পেলে স্বভাবতই সেখানে বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকবেন। লভ্যাংশ প্রত্যাবাসনের জটিল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়াও একটি বড় বাধা, কারণ এটি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করে। এ ছাড়া আমাদের কাস্টমস ব্যবস্থা বাণিজ্য সহজ করার পরিবর্তে কর আদায়ের ওপর বেশি জোর দেয়, যা পণ্য খালাস প্রক্রিয়াকে ধীর করে তোলে। এসবই মূলত বাংলাদেশে এফডিআই বাড়ার পথে বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা নিজেরাই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য এমন কিছু পরিবেশ তৈরি করেছি, যা তাদের নিরুৎসাহ করে।

তিনি বলেন, দুবাইতে আমি ১৫ মিনিটে কম্পানি তৈরি করে ফেলতে পারি; সিঙ্গাপুরে পারি এক সপ্তাহের মধ্যে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ আনতে একটি কম্পানির অনেক ক্ষেত্রে বছর পার হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়া সহজ করতে সবগুলো একটি একক প্ল্যাটফর্মে আনা জরুরি। এসব ক্ষেত্রেও আমাদের আরো সাহসী সংস্কার করতে হবে।

এখনই বিনিয়োগ বাড়ার আশা কাল্পনিক : বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, ‘নিশ্চিত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া এখনই কেউ বিনিয়োগে ঝাঁপিয়ে পড়বেন এমন প্রত্যাশা পুরোপুরি কাল্পনিক। আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা থাকলেও দেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি অনিশ্চিত থাকার কারণে বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রবাহ অচিরেই বাড়ার সম্ভাবনা কম। তিনি বলেন, বিনিয়োগ পাইপলাইনে ইতিবাচক কিছু সাইন দেখা যাচ্ছে; কিন্তু সময় লাগবে। সামনে নির্বাচন থাকায় বড় কোনো বিনিয়োগকারী বা বিদেশি বিনিয়োগকারী এই মুহূর্তে আসতে চাইবেন না।

সমাধানের পথ
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে বিনিয়োগের জন্য নির্ভরযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বিনিয়োগ পুনরুদ্ধার করতে হলে সরকারকে দ্রুত নীতিগত ধারাবাহিকতা, নিরাপদ আইন-শৃঙ্খলা এবং ব্যাবসায়িক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। এর মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা স্বল্প সময়ের জন্য বিনিয়োগ করেন না। ব্যবসায় রিটার্ন আসতে পাঁচ থেকে সাত বছর সময় লেগে যায়। তাই তাঁরা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেখতে চান। বিদ্যমান অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে কেউ বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না। এতে দেশি-বিদেশি সব বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সুদের হার ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং দুর্নীতির কারণে ব্যবসার খরচ অনেক বেশি বেড়ে গেছে। তার প্রভাব পুরো অর্থনীতিকে বহন করতে হবে। তাই আগামী বছর কিভাবে ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায় সে ধরনের পদক্ষেপের দিকে নজর দিতে হবে।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, তবে এগুলোর গতি ছিল ধীর। ব্যাংক খাত সংস্কার অন্যতম বড় পদক্ষেপ ছিল। এর ফলে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বেড়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভালো অবস্থায় গেছে এবং বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঠেকানো গেছে। এটি একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য। যদিও সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা করা গেছে, কিন্তু মূল্যস্ফীতি এখনো উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। বিনিয়োগ আসছে না, কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে না, রাজস্ব আহরণ বাড়ছে না। তাই পরবর্তী নতুন সরকারকে বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে নিয়ে কাজ করতে হবে।

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।