ঢাকা, শুক্রবার, ২৮ ভাদ্র ১৪৩২, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

সারাদেশ

সাতক্ষীরা-৪: বিএনপিতে কোন্দল, আসন পুনরুদ্ধারে মরিয়া জামায়াত

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:০৭, সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৫
সাতক্ষীরা-৪: বিএনপিতে কোন্দল, আসন পুনরুদ্ধারে মরিয়া জামায়াত ওপরে ডান থেকে আব্দুল ওয়াহেদ, আশেক এলাহি মুন্না, মনিরুজ্জামান মনির, নজরুল ইসলাম, নিচে ডান থেকে রেজা, মোস্তফা আল মামুন, ইফতেখার ও আলাউদ্দিন (ছবি জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নয়)

সাতক্ষীরা: নির্বাচন কমিশন ঘোষিত সংসদীয় আসনের চূড়ান্ত সীমানা অনুযায়ী পূর্বের রূপে ফিরেছে সাতক্ষীরা-৪ আসন (শ্যামনগর, তৎকালীন সাতক্ষীরা-৫)।

এতে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে যেমন উচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি অনেকের জন্য হতাশারও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের তথ্য মতে, ১৯৮৪ সালে সাতক্ষীরা জেলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সাতক্ষীরা জেলায় পাঁচটি সংসদীয় আসন ছিল। এক্ষেত্রে জেলার শ্যামনগর উপজেলা নিয়ে ছিল সাতক্ষীরা-৫ আসন। ২০০৮ সালে সাতক্ষীরা জেলা থেকে একটি আসন কমিয়ে চারটি আসন করা হয়। যেখানে শ্যামনগরের সঙ্গে কালিগঞ্জের আটটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠন করা হয় সাতক্ষীরা-৪ আসন। এভাবেই চলেছে ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত।  

সম্প্রতি আবার সাতক্ষীরার চারটি সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। যেখানে শুধুমাত্র শ্যামনগর উপজেলা নিয়ে গঠন করা হয়েছে সাতক্ষীরা-৪ আসন।

সংসদীয় আসনের এ ভাঙা-গড়ার খেলায় এ আসনে কখনো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন শ্যামনগর থেকে, কখনও কালিগঞ্জ থেকে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা প্রস্তুতি নিয়েছেন শ্যামনগর-কালিগঞ্জ ধরে, কিন্তু আকস্মিক সীমানা পরিবর্তন হওয়ায় কালিগঞ্জ অংশের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা পড়েছেন বিপাকে। যা তাদের জন্য অস্বস্তিরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।  

বিপরীতে শ্যামনগর অংশের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা রয়েছেন স্বস্তিতে।

খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, শ্যামনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত সাতক্ষীরা-৪ আসনের ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৯৫ হাজার ৫৩৬। এ আসনে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিপর্যস্ত বিএনপির অন্তত পাঁচজন হেভিওয়েট প্রার্থী মাঠে রয়েছেন।  

মনোনয়ন কিনতে চান কয়েকজন তরুণ নেতাও। বিপরীতে একক প্রার্থী নিয়ে স্বস্তিতে রয়েছে জামায়াত। মাঠে রয়েছেন ইসলামী আন্দোলনের একজন মনোনয়ন প্রত্যাশী। তবে, মাঠে দেখা যাচ্ছে না সদ্যগঠিত দল এনসিপির কোনো নেতাকর্মীকে।

তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, ১৯৮৪ সালে জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় সাতক্ষীরা। এরপর ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন (শ্যামনগর, তৎকালীন সাতক্ষীরা-৫) থেকে জাতীয় পার্টির শেখ আবুল হোসেন, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির শেখ আবুল হোসেন, ১৯৯১ সালে জামায়াতের গাজী নজরুল ইসলাম, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের একে ফজলুল হক, ২০০১ সালে জামায়াতের গাজী নজরুল ইসলাম এবং ২০০৮ সালে তৎকালীন সাতক্ষীরা-৪ (শ্যামনগর-কালিগঞ্জের একাংশ) আসন থেকে জাতীয় পার্টির এইচএম গোলাম রেজা, ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের জগলুল হায়দার, ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের জগলুল হায়দার ও ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের আতাউল হক দোলন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

বর্তমানে মাঠে নেই কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগ। চোখে পড়ছে না জাতীয় পার্টির কোনো কার্যক্রমও। এ সুযোগে আসনটি পুনরুদ্ধার করতে চায় জামায়াত।  

অপরদিকে সাতক্ষীরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আসনটিতে একবারও জিততে না পারা বিএনপিও চায় প্রথমবারের মতো জিতে আসনটি তারেক রহমানকে উপহার দিতে।

শ্যামনগরের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেন্দ্র অনুযায়ী কমিটি গঠন, পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণ, প্রচারণা ও গণসংযোগের মধ্য দিয়ে সাতক্ষীরা-৪ আসনে জামায়াত মনোনীত একক প্রার্থী ও সাবেক এমপি (সংসদ সদস্য) গাজী নজরুল ইসলামের নির্বাচনী প্রস্তুতি জোরদার করেছে দলটি।
একইভাবে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশায় তৃণমূলে গণসংযোগের পাশাপাশি দলকে সুসংগঠিত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ড. মনিরুজ্জামান মনির, শ্যামনগর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও জেলা বিএনপির সদস্য মাস্টার আব্দুল ওয়াহেদ এবং শ্যামনগর উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সদস্য আশেক এলাহি মুন্না।  

এ তালিকায় আরও রয়েছেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও তৎকালীন সাতক্ষীরা-৪ (কালিগঞ্জ-দেবহাটা) আসনের সাবেক এমপি কাজী আলাউদ্দিন ও জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সৈয়দ ইফতেখার আলী।  

তবে কাজী আলাউদ্দিন ও অ্যাডভোকেট সৈয়দ ইফতেখার আলী পড়েছেন আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসজনিত জটিলতায়। আর বাকি মনোনয়ন প্রত্যাশীরা শ্যামনগরে অবস্থানগত কারণে সুবিধাজনক স্থানে থাকলেও দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন করতে না পারলে সাতক্ষীরা-৪ আসনে জয় অর্জন করা অসাধ্য হয়ে পড়বে বিএনপির জন্য।
যদিও দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, উপজেলা বিএনপির কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলমান। কমিটি গঠনের কার্যক্রম শেষ হলে নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো কোন্দল থাকবে না।

এ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন সাতক্ষীরা-৪ (শ্যামনগর-কালিগঞ্জের একাংশ) আসনের সাবেক এমপি এইচএম গোলাম রেজা।

জামায়াত-বিএনপির বাইরে নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত প্রার্থী মোস্তফা আল মামুনকে (হাজি মনির)।

সব মিলিয়ে এ আসনে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে মূল লড়াইটা হবে। তবে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে এলে বদলে যেতে পারে সমীকরণ।

নির্বাচনী প্রস্তুতি প্রসঙ্গে শ্যামনগর উপজেলা জামায়াতের আমির মাওলানা আব্দুর রহমান বলেন, সাতক্ষীরা-৪ আসনে জামায়াতের প্রার্থী সাবেক এমপি গাজী নজরুল ইসলাম। আমরা প্রতিপক্ষকে দুর্বল না ভেবে সংসদীয় আসনের প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি। তাদের আমাদের প্রতিশ্রুতিগুলো জানাচ্ছি। আশা করছি, আমরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করব।

দলীয় মনোনয়ন ও দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিয়ে সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ড. মনিরুজ্জামান মনির বলেন, গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে আমি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে তৃণমূলে গণসংযোগ বৃদ্ধি, দলকে সুসংগঠিত করার ও জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো নির্দেশ দেন এবং প্রস্তুতি নিতে বলেন। আমি সে অনুযায়ী কাজ করছি।

দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আসলে মনোনয়ন প্রত্যাশী যারা থাকেন, তাদের কেন্দ্র করে একটি বলয় গড়ে ওঠে। এটা মনোনয়ন কেন্দ্রিক। দল যখন চূড়ান্ত মনোনয়ন দেবে, এ দূরত্ব কমে আসবে। এরই মধ্যে দূরত্ব কমে আসতে শুরু করেছে। যাকেই মনোনয়ন দিক না কেন, আমাদের সবারই লক্ষ্য ধানের শীষকে জয়যুক্ত করা।
শ্যামনগর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও জেলা বিএনপির সদস্য মাস্টার আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, শ্যামনগরে বিএনপির কার্যক্রম শুরুর পর থেকে আমি দলের সঙ্গে আছি। নেতৃত্ব দিচ্ছি। উপজেলার তৃণমূল পর্যায়ে দলকে সংগঠিত করেছি। আগে আমাদের শ্যামনগরে বিএনপিতে কোনো গ্রুপিং ছিল না। যখন জেলা কমিটির নেতৃত্বে ইফতেখার আলী ও তারিকুল হাসান এলেন, তখন থেকেই গ্রুপিং শুরু। এ গ্রুপিংটা মূলত সাতক্ষীরা কেন্দ্রিক। তবে, আমি মনোনয়ন পেলে কোনো গ্রুপিং থাকবে না।

তিনি আরও বলেন, আমি শ্যামনগর পাইলট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলাম, শ্যামনগর সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলাম, উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলাম, শ্যামনগর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম, উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। শ্যামনগরের প্রতিটি পরিবারই আমার পরিবার। এজন্য মনোনয়ন প্রাপ্তির ব্যাপারে আমি যথেষ্ট আশাবাদী।

শ্যামনগর উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সদস্য আশেক এলাহি মুন্না বলেন, আমরা সাতক্ষীরা-৪ আসনটি তারেক রহমানকে উপহার দিতে চাই। এজন্য তৃণমূলে দলকে সুসংগঠিত করা হচ্ছে। ৩১ দফা ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। আগামী নির্বাচনে আমি দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী।

দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে শ্যামনগরে উপজেলা কমিটি গঠনের কার্যক্রম চলমান। কমিটি হয়ে গেলে এ কোন্দল আর থাকবে না। এছাড়া আমরা বসেও সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দল যাকে মনোনয়ন দেবে, আমরা তাকে জয়যুক্ত করতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব।

বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও তৎকালীন সাতক্ষীরা-৪ (কালিগঞ্জ-দেবহাটা) আসনের সাবেক এমপি কাজী আলাউদ্দিন বলেন, আমি এক সময় কালিগঞ্জ-দেবহাটা আসনের এমপি ছিলাম। এখন নির্বাচন কমিশন ঘোষিত সংসদীয় আসনের চূড়ান্ত সীমানা অনুযায়ী দেবহাটা পড়েছে সাতক্ষীরা-২ আসনের (সাতক্ষীরা সদর ও দেবহাটা) মধ্যে, আর কালিগঞ্জ পড়েছে সাতক্ষীরা-৩ আসনের (কালিগঞ্জ-আশাশুনি) মধ্যে। আমি বিগত ১৫ বছর কাজ করেছি শ্যামনগর ও কালিগঞ্জে। এখনো শ্যামনগর ও কালিগঞ্জেই কাজ করছি, প্রতিদিন দুই উপজেলাতেই একাধিক প্রোগ্রামে অংশ নিচ্ছি। দুই আসনের নেতাকর্মীরাই আমাকে চাচ্ছে, তারা বলছে, আমাদের ছেড়ে যেয়েন না। এমন পরিস্থিতিতে আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য দলীয় হাই কমান্ডের সিগন্যালের অপেক্ষায় আছি।

জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সৈয়দ ইফতেখার আলী জানান, তিনি সাতক্ষীরা-২ ও সাতক্ষীরা-৪ আসনকে সামনে রেখে এগুচ্ছেন। কেন্দ্রের সিগন্যাল পেলে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবেন।

নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রসঙ্গে সাবেক এমপি এইচএম গোলাম রেজা বলেন, আগামী নির্বাচনে অংশ নেব। আমি শ্যামনগর ও কালিগঞ্জের মানুষের সঙ্গে সব সময় ছিলাম, থাকব।

এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।