সিলেট: ‘এক্সকিউজ মি স্যার, আই অ্যাম হাংরি, গিভ মি টেন পাউন্ড’- এভাবেই ইংরেজিতে ভিক্ষা চাওয়া যেন নিত্তদিনের এক দৃশ্য ছিল সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।
দীর্ঘদিন ধরে ভিক্ষাবৃত্তিকে ঘিরে বিমানবন্দর এলাকায় গড়ে ওঠে এক ধরনের অস্বস্তিকর পরিবেশ।
বিশেষত বিদেশগামী ও বিদেশফেরত যাত্রীদের লাগেজ ট্রলির পিছু নিয়ে ডলার কিংবা পাউন্ড চাওয়ার প্রবণতায় বিমানবন্দরের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হচ্ছিল বলে জানা গেছে।
ডলার বা পাউন্ড ভিক্ষা দিতে না পারলে যাত্রীদের অনেক সময় ভিক্ষুকদের কটু মন্তব্যের মুখেও পড়তে হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে সম্প্রতি বিমানবন্দরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. এমদাদুল হক শরীফ এর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেন। ফলে এমন নাজুক পরিস্থিতির অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটেছে বিমানবন্দর এলাকায়। এখন বিমানবন্দরে প্রবেশ করলে সেই পুরোনো দৃশ্য আর চোখে পড়ে না।
নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে বিমানবন্দরের ভিক্ষুক চক্রকে দমন করেছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এতে ভিক্ষুকদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা অসাধু চক্রের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. এমদাদুল হক শরীফ।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, যাত্রী হয়রানি ও বিমানবন্দরের স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করার অভিযোগে একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করা হয়। এতে ভিক্ষুকদের বিমানবন্দর এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিমানবন্দরে ভিক্ষুকদের অনাকাঙ্ক্ষিত তৎপরতা রোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত এপিবিএন পুলিশ ও আনসার সদস্যরা সার্বক্ষণিক নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, বন্দর এলাকায় সত্যিকারের দুই/একজন ভিক্ষুক থাকলেও সক্রিয় ভিক্ষুকদের অনেকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। তাদের মধ্যে একজন নারী ভিক্ষুক চারটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও একটি পাকা বাড়ির মালিক। আরেকজন ভিক্ষুকের বাসায় রয়েছে গৃহকর্মী।
এক নারী ভিক্ষুক নিয়মিত তার শিশু সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে বিমানবন্দরে ভিক্ষা করতে আসতেন। ওই নারীর স্বামী আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হলেও তাদের ভিক্ষা করতে পাঠাতেন বলে বিমানবন্দরের এক কর্মী জানান।
আন্তর্জাতিক দুটি ফ্লাইট কাভার করতে পারলেই অনায়াসে দুই থেকে তিন হাজার টাকা উপার্জন করার লোভ সামাতে না পারায় স্ত্রী-সন্তানকে দিয়ে ভিক্ষা করাতেন তিনি।
বিমানবন্দরের কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী সূত্রে জানা যায়, বিমানবন্দরে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত কয়েকজন ভিক্ষুককে ইংরেজি ভাষায় ভিক্ষা করতে তাদের ইংরেজিতে প্রশিক্ষণ দিত ভিক্ষুক চক্রের স্থানীয় কয়েকজন। তারা ভিক্ষুকদেরকে Excuse me বা I am hungry, Give me 10 pound ধরনের বাক্য মুখস্থ করাতেন। তাদের ছত্রছায়ায় ভিক্ষুকরা বিদেশি যাত্রীদের কাছে অর্থ চাইতেন। পরে দিনের আয় থেকে নির্দিষ্ট একটি অংশ কমিশন হিসেবে ওই চক্রকে দিতে হতো। প্রতিদিন আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের সময়সূচি জেনে ভিক্ষা করতে আসতেন এসব ভিক্ষুক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, এক সময় বিদেশি ও প্রবাসী যাত্রীরা ভ্রমণে এলেই তাদের কাছে ভিক্ষুকরা ডলার, পাউন্ড কিংবা টাকা চাইতেন। এতে বিদেশি পর্যটক ও প্রবাসীরা বিব্রত হতেন। এখন সেই দৃশ্য একেবারে নেই বললেই চলে। ফলে বিমানবন্দরের পরিবেশ হয়ে উঠেছে নিরাপদ ও যাত্রীবান্ধব।
শহীদ নামের একজন স্থানীয় গাড়িচালক বলেন, আগে প্রবাসীরা দেশে নামলেই ভিক্ষুকরা তাদের ঘিরে ধরতেন। এখন সেই দৃশ্য আর নেই। এটি সত্যিই স্বস্তিদায়ক। স্থানীয় যাত্রীরাও এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। তারা মনে করেন, এ পদক্ষেপ শুধু যাত্রীদের হয়রানি কমায়নি, বরং সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করেছে।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. এমদাদুল হক শরীফ গত কয়েক মাস ধরে বিমানবন্দরের সার্বিক শৃঙ্খলা ও শুদ্ধি অভিযানে কাজ করছেন। ডলার-পাউন্ড চাওয়া ভিক্ষুকদের নির্মূল তার উদ্যোগের একটি বড় সফলতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এখন আর ভিক্ষুকের উৎপাতের স্থান নয়, বরং হয়ে উঠেছে একটি সুশৃঙ্খল ও আন্তর্জাতিক মানের যাত্রীবান্ধব টার্মিনাল।
এর আগে লোডার পরিচয়ে বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি করা এমন চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ছয়জনকে কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন শাস্তি দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। পাশাপাশি বিমানবন্দর এলাকায় পাবলিক টয়লেটে নিয়মবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত টাকা আদায় করায় ইজারাদারকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এসআই