চাঁদপুর: সৈকত চন্দ্র দে সুমন (৪৩)। রাজধানীর শনির আখড়া বাজারের রুপসি গার্মেন্টস গলিতে পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকতেন।
ঠিক ওই সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছোড়া হয়। এতে পাঁজরে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন সুমন।
সুমন শনির আখড়ায় থাকলেও তার বাড়ি চাঁদপুরে। তিনি জেলার মতলব দক্ষিণ উপজেলার উপাদি উত্তর ইউনিয়নের উপাদি গ্রামে সূত্রধর বাড়ির মৃত দুলাল চন্দ্র দে’র ছেলে।
মা শিখা রানি দে মারা গেছেন সুমনের মৃত্যুর পর। তিন ভাই এবং এক বোনের মধ্যে সুমন ছিলেন সবার বড়। মেজো ভাই সুজন চন্দ্র দে (৩৫) ঢাকায় জুয়েলারির কারখানায় কাজ করেন। ছোট ভাই চন্দন চন্দ্র দে রাজধানীর আনন্দ হাউজিংয়ে এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত। বোন মৌসুমী রানী দে (৪০) থাকেন চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলায় স্বামীর বাড়িতে।
সুমনের ছোট ভাই চন্দন চন্দ দে বলেন, আমি পুলিশের অবসপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রতিষ্ঠান মতিঝিল আনন্দ হাউজিংয়ে চাকরি করি। ভাই সুমনও এ কোম্পানিতে হিসাবরক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করতেন। তিনি ২০১৬ সালে এখানে চাকরি নেন। তিনি জীবনে অনেক কষ্ট করে সর্বশেষ অবস্থানে পৌঁছেছিলেন। কারণ আমার বাবা স্কুলশিক্ষক ছিলেন, আয় ছিল খুবই কম। এছাড়া তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী ছিলেন। যে কারণে আমাদের ভাই-বোনদের বড় করার জন্য ভাই (সুমন) আমাদের দায়িত্ব নেন। তিনি ছাত্রাবস্থায় টিউশনি পড়িয়ে আমাদের সহযোগিতা করেছেন।
তিনি আরও জানান, সুমন ১৯৯৭ সালে নিজ এলাকার বোয়ালিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৯৯ সালে মতলব ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ২০০২ সালে একই কলেজ থেকে বিকম পাস করেন। সংসারের আয় বৃদ্ধির জন্য চাকরির পাশাপাশি সন্ধ্যার পর শনির আখড়ায় গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে তিনটি টিউশনি করাতেন। শুধু তাই নয়, নিজ সন্তানদের গণিত ও ইংরেজি তিনি নিজে পড়াতেন। অন্য বিষয়ের জন্য একজন শিক্ষক ছিলেন।
সুমনের মেজো ভাই সুজন চন্দ্র দে বলেন, গতবছর জুলাই মাসের ৮ তারিখে মোবাইল ফোনে সর্বশেষ সুমনের কথা হয়। ভাই তাকে আন্দোলন থেকে দূরে থাকার জন্য সতর্ক করেন। কারণ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নিউ মার্কেট এলাকায় থাকতাম। তিনি আমার বড় ভাই হলেও বন্ধুর মতো ছিল সম্পর্ক। তিনি আমাদের বাবার অভাব বুঝতে দেননি। সব সময় বিপদে আপদে এগিয়ে আসতেন।
সুজন চন্দ্র দে আরও বলেন, আমার মা ভাইয়ের বাসায় থাকতেন। মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে গিয়ে ভাই শহীদ হন। ভাইয়ের মৃত্যু শোকে সাত মাস পর মায়েরও মৃত্যু হয়। আমার বড় ভাই সুমনের স্ত্রী স্বপ্না রাণী দে, ভাতিজা দ্রুব চন্দ্র দে (১২) ও মাতৃকা রাণী দে’কে (৮) নিয়ে বাবার বাড়ি রংপুরে চলে যায়।
প্রেম করে ২০১২ সালে স্বপ্না রানীকে বিয়ে করেন সুমন।
সুমনের স্ত্রী স্বপ্না রাণী দে বলেন, আমার শ্বাশুড়ি অসুস্থ থাকার কারণে গ্রাম থেকে আমাদের বাসায় আসেন জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। মায়ের চিকিৎসা চলছিল। তখন দেশে ছাত্র-আন্দোলন চলছিল। ঘটনার দিন ২০ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে শনির আখড়া বাজারের প্রধান সড়কে মায়ের ওষুধ হাতে নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন সুমন। ঠিক ওই সময় গুলি এসে লাগে সমুনের বুকে। ঘটনাস্থলেই তিনি লুটিয়ে পড়েন এবং মৃত্যুবরণ করেন। স্থানীয় লোকজন তার লাশ পাশের গলিতে এনে রাখেন।
তিনি বলেন, তার মৃত্যুর সংবাদ পাই আমার বান্ধবীর ফোন থেকে। খবর পেয়েই আমি ছুটে গিয়ে তার লাশ দেখতে পাই। পরে লাশ বাসায় নেওয়া হয়। পরদিন ভোরে তার লাশ যাত্রাবাড়ী থানায় নেওয়া হয়। সেখানে পুলিশ তার ময়নাতদন্তও করেনি এবং জিডিও নেয়নি। যার কারণে প্রতিবেশীদের সঙ্গে পরমার্শ করে লাশ বাড়িতে এনে সৎকার করি এবং ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শ্রাদ্ধ করে বাসায় চলে আসি।
স্বপ্না রাণী বলেন, সুমনের মৃত্যুর পর আমাদের ঘরে ছিল আড়াইশ টাকা। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের আত্মীয়-স্বজন, তার কোম্পানি ও স্থানীদের সহযোগিতায় কিছুদিন চলার পর সব কিছুই বন্ধ হয়ে যায়। ছেলে শনির আখড়া বর্ণমালা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে এবং মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত ওই সময়। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো রকম সন্তানদের পড়ালেও আর এগুতে পারিনি। যে কারণে জানুয়ারি মাসে রংপুরে বাবার বাড়িতে চলে যাই। বাবা মারা গেছেন, এখন মায়ের সঙ্গে বাবার বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। কারণ মতলবে আমার স্বামীর কোনো সম্পত্তি নেই। তারাই থাকতেন নানা বাড়ির আশ্রয়ে।
তিনি জানান, সুমনের মৃত্যুর পর সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই ফাউন্ডেশন এবং ডিসির পক্ষ এ পর্যন্ত সাত লাখ টাকা পেয়েছেন। এছাড়া ঢাকায় জামায়াতে ইসলামী থেকে পেয়েছেন দুই লাখ এবং বিএনপির পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা পেয়েছেন। সর্বশেষ জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পেয়েছি। এসব আর্থিক অনুদানের টাকা থেকে পারিবারিক খরচ এবং সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে আসছি। সন্তানদেরও রংপুরে পড়াতে হচ্ছে। আমি নিজে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য হলেও আমার কোনো কর্মসংস্থান দরকার।
সুমনের ছেলে দ্রুব চন্দ্র দে বলে, বাবার স্বপ্ন ছিল আমাকে ক্রিকেটার বানানোর। তিনি বলতেন, বিকেএসপিতে ভর্তি করাবেন। বোনকে চিকিৎসক বানানোর কথা বলতেন। বাবার মৃত্যুতে আমাদের সব স্বপ্ন শেষ। বাবার মৃত্যুর সঠিক বিচার দাবি করছি।
এসআই