বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করেছে শনিবার (১৯ জুলাই)। পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার, জুলাই সনদসহ সাত দফা দাবি তুলে ধরার এই সমাবেশের টার্গেট পূরণে জামায়াত কতটুকু সফল হয়েছে, সেই বিশ্লেষণই চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে দুই মেরুতে অবস্থান করছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং জামায়াত। বিএনপি বলছে, যত দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, দেশের জন্য ততই মঙ্গল। অপরদিকে জামায়াত বলছে, যাদের আন্দোলন ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়েছে, তাদের বিচার-রাষ্ট্রীয় সংস্কার ছাড়া নির্বাচন মানবে না দেশের জনগণ।
দীর্ঘদিন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার বিরোধী আন্দোলনে বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গে আন্দোলন করলেও সাম্প্রতিক বিভিন্ন ইস্যুতে দল দুটির মধ্যে নানা ধরনের বাগবিতণ্ডা ও টানাপোড়েন চলছে। দল দুটির শীর্ষ নেতাদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের স্লোগান ছড়াচ্ছে হরহামেশা।
চব্বিশের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মূলত দীর্ঘদিন রাজপথে বড় ধরনের জমায়েত করতে না পারা জামায়াত নিজেদের জনসমর্থনের প্রদর্শন করতে এমন সমাবেশের ডাক দিয়েছিল বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
শনিবার (১৯ জুলাই) দুপুর ২টার দিকে এ সমাবেশ শুরু হয়। এর আগে শুক্রবার (১৮ জুলাই) সন্ধ্যা থেকে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জমায়েত হতে শুরু করেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা দলটির নেতাকর্মীরা।
সমাবেশ শুরুর আগে শনিবার সকালেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় সমাবেশস্থল। এ সময় আশপাশের এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়ে জামায়াত ইসলামীর নেতাকর্মীদের জমায়েত। জামায়াতের নেতা-কর্মীদের ভাষ্যে, অবস্থান জানান দেওয়ার যে প্রাথমিক টার্গেট, তা পূরণ হয়েছে বলে তারা মনে করেন।
দুপুর ২টার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়া সমাবেশে বিএনপি ও এবি পার্টিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র যারা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের সঙ্গে একমত তাদেরই এই সমাবেশে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে।
সমাবেশে জামায়াতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতারা ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দেন। এদের মধ্যে ছিলেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), খেলাফত আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, হেফাজতে ইসলাম ও নেজামে ইসলামী পার্টির নেতারা।
এ ছাড়া সমাবেশে জুলাই শহীদদের পরিবারের সদস্য ও জুলাইযোদ্ধারাও বক্তব্য দেন। বক্তব্য দেন জামায়াতের সাবেক আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমান মোমেন।
সমাবেশে আসা নেতাকর্মীরা পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারসহ বিভিন্ন দাবিতে পোস্টার, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন। একই দাবিতে স্লোগান দেন তারা।
সমাবেশে আসা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা তাদের বক্তব্যে মূলত জামায়াত যে সাত দফা দাবিতে জাতীয় সমাবেশ করে, সেই দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বক্তব্য দেন।
তাদের সাত দফা দাবিতে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ও অন্যান্য সময় সংঘটিত সব গণহত্যার বিচার; রাষ্ট্রের সব স্তরে প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার; ঐতিহাসিক জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্রের পূর্ণ বাস্তবায়ন; জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের পুনর্বাসন; জনগণের প্রকৃত মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে পিআর (প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন; প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ; রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের জন্য সমান সুযোগ ও ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিতকরণ চেয়েছে জামায়াত।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে সমাবেশে আসা জামায়াতের কর্মী জাফর আহমেদ বলেন, জুলাই আন্দোলনে রক্ত দিয়েছি রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য। রাষ্ট্রীয় মৌলিক সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত কোনো পাতানো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।
মাগুরার মোহাম্মদপুর থেকে সমাবেশে আসা মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে অনেক সরকার দেখেছি। সব সরকার জনগণের জন্য কাজ না করে নিজেদের পকেট ভারি করেছে। আমরা আশা করি, আগামী নির্বাচনে ইসলামের পক্ষের শক্তি রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব পাবে।
সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান তার বক্তব্যে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক লড়াইয়ের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরেক লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়ে বলেন, পুরোনো ব্যবস্থাপত্রে বাংলাদেশ আর চলবে না।
তিনি বলেন, শহীদ আবু সাঈদরা যদি বুক পেতে না দাঁড়াতো, এ জাতির মুক্তির জন্য যদি বুকে গুলি লুফে না নিত, হয়তো বা আজকের এই বাংলাদেশটা আমরা দেখতাম না। ইতোমধ্যে হয়তো আরো অনেক মানুষের জীবন ফ্যাসিবাদীদের হাতে চলে যেত। চব্বিশে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধটা যদি না হতো তাহলে আজ যারা বিভিন্ন ধরনের কথা ও দাবি-দাওয়া পেশ করছেন তারা তখন কোথায় থাকতেন?
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ তাআলার এই নেয়ামত পাওয়া তাদের যেন অবজ্ঞা ও অবহেলা না করি। শিশু বলে তাদের যেন তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করি। অহংকার বলে অন্য দলকে যেন তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করি। অরাজনৈতিক ভাষায় আমরা যেন কথা না বলি। যদি এগুলো আমরা পরিহার করতে না পারি, তাহলে বুঝতে হবে যারা পারবেন না ফ্যাসিবাদের রোগ তাদের মধ্যে নতুন করে বাসা বেঁধেছে।
শফিকুর রহমান বলেন, আগামীর বাংলাদেশটা কেমন হবে- আমি বলি আরেকটা লড়াই হবে ইনশাল্লাহ। একটা লড়াই হয়েছে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। আরেকটা লড়াই হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ইনশাআল্লাহ। এই দুর্নীতির মূলোৎপাটন করার জন্য যা দরকার আমরা তারুণ্য ও যৌবনের শক্তিকে একত্রিত করে সেই লড়াইয়েও লড়বো ইনশাল্লাহ।
জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপার সভাপতি রাশেদ প্রধান বলেন, গত বছর ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা একটা সুর তুলেছিলেন রাজাকার। আর এক আন্দোলনে তাকে দেশ থেকে পালাতে হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, নতুন করে আবার রাজাকার শব্দটি উঠানো হচ্ছে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেন। ভুল করবেন না। আল্লাহ ছেড়ে দেন না। নতুন করে আওয়ামী লীগের সুর তুলবেন না। না হয় আপনাদেরও দেশের জনগণ দেশ থেকে বিতাড়িত করবে। জামায়াতের সাত দফার প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল বাংলানিউজকে বলেন, সংস্কার-বিচার-পিআর পদ্ধতিসহ সাত দফা দাবি আদায়ের জন্য জাতীয় সমাবেশ করেছি। এই দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক গোলাম হাফিজ বাংলানিউজকে বলেন, জামায়াতে ইসলামী যে দাবিগুলো নিয়ে সমাবেশ করেছে এসব দাবির সঙ্গে কিছু কিছু রাজনৈতিক দল একমত রয়েছে, আবার বেশ কিছু দল একমত নয়। দাবি আদায়ের প্রাথমিক শক্তি প্রদর্শনে তারা সফল হলেও কোন কোন দাবি বাস্তবায়ন হবে সেটি ঐক্যমত কমিশনে সিদ্ধান্ত হলে বোঝা যাবে।
টিএ/