ঢাকা, রবিবার, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৭ জুলাই ২০২৫, ০১ সফর ১৪৪৭

জাতীয়

‘স্বেচ্ছায় আত্মাহুতির’ পুরান ঢাকা!

প্রশান্ত মিত্র, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:৩৫, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২০
‘স্বেচ্ছায় আত্মাহুতির’ পুরান ঢাকা!

ঢাকা: নিমতলী থেকে চকবাজার ট্র্যাজেডি, এর বাইরেও কেমিক্যালের আগুনে বার বার পুড়েছে পুরান ঢাকা। প্রতিটা অগ্নিকাণ্ডের পরপরই পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর ঘোষণা দিয়েছে প্রশাসন। কার্যত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন কারণে প্রশাসনের সেসব উদ্যোগে ভাটা পড়ে যায়।
 

অগ্নিকাণ্ডে যতো বড় দুর্ঘটনাই ঘটুক এ নিয়ে পুরান ঢাকাবাসীর মধ্যে ব্যক্তি উদ্যোগ নেই বললেই চলে। যেকোনো মুহূর্তে ভয়াবহ দুর্ঘটনার কথা জেনেও আবাসিক ভবনেই ক্যামিক্যাল গোডাউন ভাড়া দিচ্ছেন বাড়ির মালিক।

মোটা অঙ্কের টাকার কাছে হার মানে সকল শঙ্কা আর ভয়। এ যেন পুরান ঢাকাবাসীর স্বেচ্ছায় আত্মাহুতির পথ বেছে নেওয়া।

>>>নিষ্প্রাণ ওয়াহেদ ম্যানশনের দেয়ালে পোড়া ক্ষত!

ভয়াবহ চকবাজারের চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির বছর পেরলেও এখনো দগদগে আগুনের ক্ষত বিধ্বস্ত ‘ওয়াহেদ ম্যানশন’ জুড়ে। যে ভবনের কেমিক্যাল গোডাউন থেকে সৃষ্ট আগুন কেড়ে নিয়েছে ৭১টি তাজা প্রাণ। সেই ভবনেরই নিচতলা সংস্কার করে আবারো ভাড়া দেওয়া হয়েছে প্লাস্টিক তৈরির কাঁচামাল বিক্রেতাকে।
 
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আগুনে পোড়া চারতলা ওয়াহেদ ম্যানশনটি এখনো পোড়া ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভবনের দ্বিতীয় তলায় ভাঙা দেয়াল কালসিটে দাগ দেখতে এটি যেন এক ভূতুড়ে বাড়ি মনে হয়। ট্র্যাজেডির বছর পূর্তিতে নিহতদের স্মরণে বিভিন্ন সংগঠন ও স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতির উদ্যোগে টানানো হয়েছে ব্যানার। আগুনে ভবনের প্রায় পুরোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হলেও শুধুমাত্র নিচতলা সংস্কার করা হয়েছে।

>>>চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ড: ক্ষতিপূরণের আশায় এখনও অপেক্ষা
 
ভবটির নিচতলায় একটি দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন প্লাস্টিক তৈরির কাঁচামাল ব্যবসায়ী। তিনি বাংলানিউজকে জানান, নিচতলার দোকানগুলো কয়েকমাস আগে ঠিকঠাক করার কাজ শুরু হয়। এখন নিচতলা প্রায় প্রস্তুত হয়েছে, ব্যবসায়ীরা আসতে শুরু করেছেন।

ওয়াহেদ ম্যানশনের আশেপাশে চুড়িহাট্টা এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পুরো এলাকাজুড়ে প্লাস্টিক তৈরির কাঁচামাল এবং কেমিক্যাল গোডাউনে সয়লাব। সরু গলিপথের দোকানে দোকানে প্রকাশ্যে সেসব বিক্রি হচ্ছে। চুড়িহাট্টাবাসী যেন ভুলতেই বসেছে, এই কেমিক্যালে কোনোভাবে আগুনের স্পর্শ পেলেই আবারো ঘটতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

এলাকার বেশিরভাগ আবাসিক ভবনগুলোর নিচতলার সামনের অংশের দোকানগুলোতে প্লাস্টিক কাঁচামালের দানা, বিভিন্ন কেমিক্যালের বিক্রির দোকান। কোনো কোনো ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ড অর্থাৎ পার্কিং প্লেসে রয়েছে সেসব মরণঘাতি কেমিক্যালের গোডাউন। আগের মতো কোনো ধরনের নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার ছাড়াই কর্মীরা সেগুলো ভেতরে-বাহিরে আনা নেওয়া করছেন। বিভিন্ন গাড়ি থেকে মালামাল উঠাচ্ছেন বা নামাচ্ছেন।

>>>ভয়ঙ্কর সেই রাতের আগুনময় চকবাজার

স্থানীয়দের মতে, প্রশাসনের উদাসীনতা এবং এলাকার স্থানীয় বাড়িওয়ালাদের কারণেই ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল, প্লাস্টিক কাঁচামাল এখান থেকে সরানো সম্ভব হচ্ছেনা। নিমতলী ট্র্যাজেডির পর সচেতন হলে চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতোনা। এই কেমিক্যালের কারণে যে আবারো বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটবেনা তারও কোন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবেনা।
 
এলাকাবাসীরা জানায়, চকবাজারসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে পুরাতন ভবন হওয়ার কারণে ভাড়াটিয়ারা থাকতে চান না। এর বিপরীতে কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের ঘর ভাড়া দেওয়া হলে জামানত এবং মাসে মাসে মোটা অঙ্কের ভাড়া পাওয়া যায়। কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যে পরিমাণ অর্থ পাওয়া যায় তার অর্ধেক পরিমাণও আবাসিক ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে পাওয়া যায়না। ফলে কেমিক্যালের ঝুঁকির বিষয়টি জেনেও বাড়ির মালিকরা ব্যবসায়ীদের ঘর ভাড়া দেন।
 
ওয়াহেদ ম্যানশনের আগুনে নিহত ওয়াসির উদ্দীনের বাবা নাসির উদ্দীনের বয়স হয়েছে। একসময় ব্যবসা করলেও এখন আর আগের মতো ব্যবসা চালানোর সক্ষমতা নেই। মোটামুটি অবসরেই কাটে প্রায় সারাদিন, মৃত ছেলের কথা মনে হলে ওয়াহেদ ম্যানশনের দিকে ঘোরাফেরা করেন। আগুনে সন্তান গেছে সেই শোক চেপে আক্ষেপ করেই বলতে থাকেন এলাকার অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।

>>>চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির বর্ষপূর্তি বৃহস্পতিবার
 
বুধবার (১৯ জানুয়ারি) ওয়াহেদ ম্যানশনের পাশে মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক ব্যক্তি। কথাপ্রসঙ্গে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, নিমতলীতে আগুন লাগার পর কেমিক্যাল গোডাউনগুলো সরিয়ে নিলে এখানে আগুন লাগতো না। এখানো সরকার চাইলেই কোনো একটা নির্দিষ্টস্থানে কেমিক্যাল গোডাউনগুলো সরিয়ে নিতে পারে। এগুলোর জন্য আলাদা এলাকা করে দেওয়া হোক। একবার বলাবলি হচ্ছিলো নদীর ওপারে নির্ধারিত জায়গায় নিয়ে যাবে, কিন্তু সেই কথার কোনো বাস্তবায়নই দেখছিনা। প্রশাসন এখনো কেন নির্ধারিত স্থানে কেমিক্যাল গোডাউন নিয়ে যাচ্ছেনা? নিমতলী-চকবাজারের মতো আমরা আর কোনো ঘটনা দেখতে চাইনা।

পরক্ষণেই প্রশাসনের উদাসীনতার পাশাপাশি বাড়ির মালিকদের খামখেয়ালীপনার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু প্রশাসনকে দায় দিলে ভুল হবে। আমি পুরান ঢাকার বাসিন্দা, আমি জানি। এখানকার লোকজন ঝুঁকির কথা জেনেই কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের ভাড়া দেয়। আমি জানি যেকোন মুহূর্তে আগুন লাগলেই স্ত্রী-সন্তানসহ আমি মারা যেতে পারি। তারপরেও আমি টাকার জন্য ভাড়া দিচ্ছি। কারণ কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা বেশি ভাড়া দেয়, জামানতও বেশি। এটা জেনেশুনে বিষপানের মতো।
 
তিনি আরও বলেন, ব্যাংক এখানকার বাসিন্দাদের বাড়ির জন্য লোন দেয় না। বছরের পর বছর ধরে পুরাতন বাড়িগুলো টিকে আছে। টাকার জন্য বাড়িওয়ালারা নতুন বাড়িও বানাতে পারেন না। এদিকে, রুচিশীল ভাড়াটিয়ারা পুরাতন ভবনগুলোতে ভাড়ায় থাকতে চায় না। ফলে বাড়ি মালিকরা আয়ের কথা চিন্তা করে জীবনের কথা ভাবেই না।
 
চকবাজার এলাকার বাসিন্দা আকরাম বাংলানিউজকে বলেন, সবাই জানে এগুলো বিপদজনক। তারপরও বাড়ির মালিকরা জায়গা দেয়। কারণ একটাই, বেশি ভাড়া। না হলে কেউ মৃত্যু দাওয়াত দিয়ে ঘরে আনে? তাদের ধারণা, দুর্ঘটনাতো আর নিয়মিত হয় না। যখন হবে দেখা যাবে। এই দেখতে দেখতেই আজ একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।
 
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন, প্লাস্টিকের কাঁচামাল সরিয়ে অন্যত্র নেওয়ার জোরালো দাবি উঠে। কেমিক্যাল থাকলে পুরান ঢাকাকে আরো বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে বলেও মত দেন বিশেষজ্ঞরা। এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কিছুদিন সরব ছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। ঘটা করে আয়োজন করে টানা অভিযানও চালানো হয়েছিলো।
 
কিছুদিন পরই চিরায়ত নিয়মে প্রশাসনের নিরবতা আর সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীদের সরব উপস্থিতিতে চকবাজার এলাকায় পুরনো রূপ ফিরে আসে। আবারো ভবনে ভবনে কেমিক্যাল গোডাউনসহ ছোট-বড় দোকান। এ যেন পুরনো রূপেই পুরান ঢাকা। তবে, ভয়াবহ আগুনে স্বজন হারানোর পরও একই অবস্থা দেখে নীরবে কষ্ট পান কেউ কেউ।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২০
পিএম/এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।