ঢাকা, বুধবার, ১৯ ভাদ্র ১৪৩২, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

জাতীয়

এটা প্রত্যাবাসন নয়, তবে ‘ইতিবাচক’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:০৩, এপ্রিল ১৫, ২০১৮
এটা প্রত্যাবাসন নয়, তবে ‘ইতিবাচক’ পরিবারের চার সদস্যকে নিয়ে স্বদেশে ফেরত গেছেন আখতার কামাল, তাদের স্বাগত জানান মিয়ানমারের কর্মকর্তারা

কক্সবাজার: সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ড থেকে একটি রোহিঙ্গা পরিবার ফেরত নেওয়া হয়েছে বলে মিয়ানমার যে দাবি করেছে, সেটি কখনও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় পড়ে না। তবে ব্যাপক দমন-পীড়নের পরও যে রোহিঙ্গারা আপন ভিটে-মাটিতে ফিরছেন, সেটা ইতিবাচক। এই দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালামের একই দৃষ্টিভঙ্গি সীমান্তে আশ্রিত সচেতন রোহিঙ্গা, এমনকি বিশেষজ্ঞ মহলেরও। অভিমত, এর মাধ্যমে মিয়ানমারে যাওয়ার ‘আস্থা ফিরে আসার’ বিষয়টি প্রকাশ পেলো।

শনিবার (১৪ এপ্রিল) সকালে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছ‌ড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ড থেকে আখতার কামাল নামে এক রোহিঙ্গা নেতা তার পরিবারের আরও চার সদস্যকে নিয়ে স্বদেশে ফিরে যান। এ বিষয়ে শনিবার রাতে মিয়ানমারের বিবৃতিতে বলা হয়, পাঁচ সদস্যের এক মুসলিম পরিবার (শনিবার) সকালে রাখাইনের তানজিপিওলেটওয়া অভ্যর্থনা কেন্দ্রে এসেছেন।

অভিবাসন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যাচাই-বাছাই শেষে তাদের ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তাদের চাল, মশারি, কম্বল ও পোশাক সরবরাহ করা হয়েছে। প্রত্যাবাসনের জন্য যাচাই-বাছাই শেষে ওই পরিবারকে মিয়ানমারে প্রবেশের আগেই ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) দেওয়া হয়েছে।

এ নিয়ে রোববার (১৫ এপ্রিল) দুপুরে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম কক্সবাজারে তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে বলেন, শনিবার সীমান্তের তমব্রু শূন্য রেখায় অবস্থান করা পাঁচ সদস্যের একটি পরিবার মিয়ানমারে ফেরত গেছে বলে প্রচার হয়েছে। ওই শূন্য রেখাটি মিয়ানমারের অংশবিশেষ। তাই এটি কোনোভাবেই প্রত্যাবাসনের পর্যায়ে পড়ে না। তারা তাদের দেশে আসা-যাওয়া করতেই পারে। সুতরাং এটি প্রত্যাবাসন নয়।

তিনি বলেন, ওই শূন্য রেখায় প্রায় ছয় হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। শূন্য রেখায় থাকা রোহিঙ্গারা যদি তাদের দেশে চলে যায় বা তাদের সরকার নিয়ে যায়, তাহলে এটি খুবই ইতিবাচক। এর ফলে পুরো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সহজ হয়ে যাবে।

এ ব্যাপারে নাইক্ষ্যংছ‌ড়ি উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সরওয়ার কামাল বলেন, শূন্য রেখার কোনারপাড়া জায়গাটি হচ্ছে মিয়ানমারের। সুতরাং তাদের সীমান্ত থেকে কেউ ওদের দেশে গেলে সেটাকে চলে যাওয়া বা প্রত্যাবাসন বোঝায় না। তবে চলে যাওয়া শুরু হলে ভাল হবে। আমরাও চাই রোহিঙ্গারা তাদের দেশে চলে যাক।

এ বিষয়ে নো ম্যান্স ল্যান্ডে থাকা রোহিঙ্গা মাঝি দিল মোহাম্মদ বাংলানিউজকে জানান, পরিবার নিয়ে চলে যাওয়া আখতার কামাল মিয়ানমারের মংড়ু জেলার বলিবাজারের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ‘গোপনে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাতের আঁধারে সবার অজান্তে নিজ দেশে পাড়ি দেন’। সঙ্গে ছিলেন তিন নারী ও এক শিশু।

আরিফ নামে আরেক রোহিঙ্গা নেতা দাবি করেন, আখতার কামাল দীর্ঘদিন মিয়ানমার সরকারের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতেন নো ম্যান্স ল্যান্ডে। তার দেশে ফেরা এবং সেখানে তাকে স্বাগত জানানোর বিষয়টি প্রত্যাবাসনের সহজ প্রক্রিয়াকে জটিল করার একটি অংশ।

যদিও কক্সবাজারে আশ্রিত ইয়াঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও শরণার্থী নেতা জাফর আলম দীপু দেখছেন ‘ইতিবাচক’ হিসেবে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমরা জেনেছি রোহিঙ্গাদের ফেরানোর বিষয়ে গত ১৩ এপ্রিল জেনেভায় ইউএনএইচসিআর প্রধান ফিলিপো গ্রান্ডি এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের মধ্যে একটি স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। চুক্তিতে রয়েছে মিয়ানমারও।

এই চুক্তির খবরে রোহিঙ্গা শিবিরে আস্থা ফিরে আসতে শুরু করেছে উল্লেখ করে জাফর বলেন, এর মধ্যে অনেকে মিয়ানমারে ফিরে যেতে শুরু করেছেন। শনিবার পাঁচ সদস্যের একটি মুসলিম রোহিঙ্গা পরিবার মিয়ানমারে ফিরে গেছেন বলে আমরা জেনেছি। তবে সে পরিবারটি কোনো ক্যাম্পে থাকতো না। ক্যাম্পের বাইরে অবস্থান করছিল। পরিবারটির কর্তা মিয়ানমারে স্থানীয় কোনো অঞ্চলের জনপ্রতিনিধি ছিলেন। তার সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের যোগাযোগ ছিল।  সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম।  ছবি: বাংলানিউজ‘ব্যতিক্রম’ হলেও এ প্রত্যাবাসনকে স্বাগত জানিয়ে জাফর বলেন, মিয়ানমার যদি তার দেশের রোহিঙ্গা নাগরিকদের ফেরত নেয়, তাহলে মধ্যস্থতাকারীর কোনো দরকার নেই। মিয়ানমারের মনোভাব বদলে ধন্যবাদ পেতে পারে তারা। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত যেতে আশ্বস্ত হলে বা নিরাপদ বোধ করলে কেউ তাদের আটকে রাখতে পারবে না।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, এটি পরিষ্কার নয় কে ফিরে গেছে। আমাদের জানা মতে, শরণার্থী শিবিরের কেউ এখনও ফিরে যায়নি। আপাতদৃষ্টেতে এটিকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে ছলনা বলেই মনে হচ্ছে। এখানে পাঁচজনের ফেরার বিষয় নয়, এটি ১১ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনের বিষয়।

এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, আমি শুনেছি পাঁচ রোহিঙ্গা শনিবার ফিরে গেছেন। রোহিঙ্গারা যদি স্বেচ্ছায় ফিরে যান, মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদের (ভেতরে প্রবেশে) ছেড়ে দেয় এবং তারা যদি আর ফিরে না আসে, তাহলে বাংলাদেশ সরকারের আপত্তি থাকার কথা নয়।

গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি মুসলমান’ আখ্যা দিয়ে দমন-পীড়ন শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। জীবন বাঁচাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের পথে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। বিভিন্ন সংস্থার জরিপ মতে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে।  

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে দুই বছরে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে গত জানুয়ারিতে দুই দেশের মধ্যে প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যে দু’টি অভ্যর্থনা কেন্দ্র স্থাপন করে। তবে জাতিসংঘ জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাখাইন এখনও প্রস্তুত নয়।

সম্প্রতি সেখানে সফর করে জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধি দল। সফর শেষে জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল উরসুলা মুয়েলার জানান, সেখানে স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা, নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা আর অব্যাহত স্থানচুত্যির ঘটনা ঘটছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার জন্য এই পরিস্থিতি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৫, ২০১৮
কেজেড/টিটি/এইচএ/

** ‘গোপনে’ ফিরে গেছে নো ম্যান্স ল্যান্ডের রোহিঙ্গা পরিবার?
** এক রোহিঙ্গা পরিবারকে ফেরত নেওয়ার দাবি মিয়ানমারের

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।