ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ ভাদ্র ১৪৩২, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

জাতীয়

ফসলের মাঠেই তাদের পহেলা বৈশাখ 

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১:২৪, এপ্রিল ১৩, ২০১৮
ফসলের মাঠেই তাদের পহেলা বৈশাখ  মাঠে ধান কাটতে ব্যস্ত কৃষক-ছবি- অনিক খান 

ময়মনসিংহ: মাঠজুড়ে বাতাসে দোল খাচ্ছে সোনারাঙা ধান। স্বপ্নের বোরো ফসল ঘরে তুলতে মাঠে মাঠে চলছে কৃষকের ব্যস্ততা। ব্যতিক্রম নন স্থানীয় অবস্থাসম্পন্ন কৃষক নূর হোসেনও (৪৫)। তবে ধানে ভরা ফসলের মাঠ তার একার পক্ষে সামলানো কঠিন। 

ফলে ধান কাটা, মাড়াই আর রোদে শুকানো পর্যন্ত বিস্তর কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে মাসখানেকের চুক্তি করেছেন নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরের ভূমিহীন ক্ষেত মজুর খায়রুল মিয়া (৪০), তোতা মিয়া (৫৫), রুবেল মিয়া (২৫) ও হযরত আলীর (৩৫) সঙ্গে।  

ময়মনসিংহ সদর উপজেলার কাতলাসেন চরপাড়া গ্রামে কড়া রোদ মাথায় নিয়ে নিবিষ্ট মনে নূর হোসেনের ক্ষেতে চুক্তিভিত্তিক ধান কাটার কাজ করছেন এ মজুররা।

 

বাঙালির ঐতিহ্যের অহংকার বাংলা নববর্ষ উদযাপনে সবাই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠলেও খায়রুল, রুবেল বা তোতা মিয়াদের মতো ক্ষেত মজুরদের জীবনে নতুন সূর্যের আলতো ছোঁয়া কোনো প্রভাবই ফেলে না। তাদের জীবনে আসে না বর্ষবরণের আনন্দ! 

মাঠে ধান কাটতে ব্যস্ত কৃষক-ছবি- অনিক খান নতুন বছরের নতুন দিনটি তাদের কাছে অন্যদিনের মতোই সাধারণ। এ নিয়ে তাদের সংগ্রামী জীবনেও নেই বিশেষ কোনো আয়োজন। প্রতিদিনের মতো পহেলা বৈশাখের উৎসবমুখর দিনটিও তাদের কাটবে পরের জমিতে ধান কেটে, মজুর হিসেবে খেটে।  

বৃহস্পতিবার (১২ এপ্রিল) চৈত্রের কড়া রোদে ফসলের মাঠেই কথা হচ্ছিল তাদের সঙ্গে। তবে এ ক্ষেত মজুরদের জীবনেও রয়েছে পহেলা বৈশাখের সুখস্মৃতি।  

এ স্মৃতি হাতড়ে বয়োঃবৃদ্ধ তোতা মিয়া (৫৫) বলছিলেন, অভাব-অনটনের সংসারে বেড়ে ওঠলেও বৈশাখ করতে বাবা টাকা দিতেন। সেই টাকা নিয়ে সবার সঙ্গে মেলায় যেতাম। মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা কিনতাম। সারাদিন আনন্দেই ঘুরে বেড়াতাম। এখন তো সেই আনন্দ নেই। মানুষের জমিতে কামলার (মজুর) কাজ করতে হয়।

দরিদ্রতার স্পষ্ট ছাপ খায়রুল মিয়ার মুখেও। প্রতিদিন ধান কেটে তার পকেটে উঠবে ৪শ’ টাকা। মাস শেষে নগদ এ টাকার পাশাপাশি পাবেন ১৫ থেকে ২০ মণ ধান। আর এ ধান নিয়ে ফিরে যাবেন বাড়িতে। এতেই চলবে তার ৪ সদস্যের পরিবারের আহার।  

মাঠে ধান কাটতে ব্যস্ত কৃষক-ছবি- অনিক খান খায়রুল জানান, ছোটবেলায় বৈশাখ এলেই মনে আনন্দের রঙ লাগতো। বাবা-চাচাদের কাছ থেকে ২০ থেকে ৫০ টাকা নিয়ে মেলায় ছুটে যেতেন। পান্তা ভাতের সঙ্গে চেঁপা ভর্তা খেতেন। দুপুরে হরেক রকমের শাক রান্না হতো।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খায়রুল বলেন, ‘অহন তো দেশের বাড়িত যাওয়ার বাও নাই। ধান কাইটাই কূল পাই না। ’ তবে নিজের দু’সন্তানের জন্য বিকাশে ঠিকই পহেলা বৈশাখে নতুন জামা কেনা আর মেলার যাওয়ার খরচ পাঠিয়েছেন জানান এ দরিদ্র মজুর।  

গ্রামীণ জীবনে বোরো ধান কাটার এ ভরা মৌসুমে পহেলা বৈশাখে রঙের আভা ছড়ানো তারুণ্যের জোয়ারে নাচে-গানে-বাদ্যের সঙ্গে অবহেলিত গ্রামগুলোর যেন কোনো যোগাযোগ নেই। ফলে প্রাণের নববর্ষ তাদের জীবনকে রাঙিয়ে দেয় না। তবে বিস্তীর্ণ ফসলি জমিতে উপচেপড়া ধানের দৃশ্যে ঠিকই আন্দোলিত হয়ে ওঠে কৃষকের মন।  

পহেলা বৈশাখ উদযাপনের চেয়ে ঘাম ঝরানো স্বপ্নের ফসল নিয়েই নিজের ব্যস্ততার কথা জানালেন কৃষক নূর হোসেন (৪৫)। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, পহেলা বৈশাখেও প্রতিদিনের মতো দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই মাঠে আসবো। কামলাদের (শ্রমিক) নিয়ে ধান কাটবো। তবে স্ত্রী-সন্তানের বায়না আছে অন্তত বিকেলে পাশের গ্রামে মেলায় নিয়ে যাওয়ার। মাটির হাড়ি-পাতিল, হাতি-ঘোড়া ও খাবার সামগ্রী কিনে দেবো ওদের।  

স্থানীয় কাতলাসেন চরপাড়া গ্রামের বিস্তীর্ণ ফসলি জমির যেদিকে চোখ যায় শুধু ধান আর ধান। চারিদিকে চলছে ধান কাটার মহোৎসব। কৃষক আর কৃষাণীর এ কারণে দম ফেলারও যেন ফুরসত নেই।  

দিনমান ধান কাটা ও মাড়াই নিয়ে ব্যস্ততা থাকলেও সাত সকালেই শুকনো মরিচের সঙ্গে লবণ চটকিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার রেওয়াজটা আবার ঠিকই ধরে রাখতে চান একই গ্রামের স্থানীয় কৃষক শামসুদ্দিন (৫০)। তিনি বলেন, ফসলের মাঠেই পহেলা বৈশাখের দিন সবাইকে নিয়ে দুপুরে পাট শাক দিয়ে ভাত খাবো। আমাদের মতো গরিবের জন্য এমন আনন্দই কম কিসে! 

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৮ 
এমএএএম/আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।