ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ ভাদ্র ১৪৩২, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

জাতীয়

পুরান ঢাকায় হালখাতা ঘিরে উৎসবের আমেজ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:০২, এপ্রিল ১৩, ২০১৮
পুরান ঢাকায় হালখাতা ঘিরে উৎসবের আমেজ পুরাণ ঢাকার হালখাতা উৎসবের প্রস্তুতি। ছবি: সুমন শেখ

ঢাকা: দুয়ারে কড়া নাড়ছে বৈশাখ, আসছে নতুন বাংলা বছর ১৪২৫। ব্যস্ত নাগরিক জীবনে বাংলা সাল বা মাসের খুব একটা প্রচলন কিংবা ব্যাবহার না থাকলেও শত বছর ধরে ঐতিহ্যগতভাবে পালন করে আসা পুরান ঢাকার মানুষের কাছে পহেলা বৈশাখ ঘিরে হালখাতা আয়োজন একটি উৎসবের আমেজ সৃষ্টি করে। দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য এবারও প্রস্তুতির কোনো কমতি রাখছেন না এখানকার দোকানিরা।

পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজার, তাঁতিবাজার, ইসলামপুর, শ্যামবাজার, বাবুবাজার এলাকায় বছরের পর বছর ধরে ঐতিহ্যগতভাবে বাংলা বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখে বা এরপর দিন পুরাতন বছরের বাকি/ধারের পাঠ চুকিয়ে নতুন টালি খাতা খোলেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসার ধরণ ও আকার অনুযায়ী ক্রেতাদের বিভিন্নভাবে আপ্যায়নও করেন তারা।

তবে আপ্যায়নে ভিন্নতা থাকলেও তাতে মিষ্টিমুখ বাদ যায় না কখনো।
পুরাণ ঢাকার হালখাতা উৎসবের প্রস্তুতি।                                          ছবি: সুমন শেখ
ইতিহাস থেকে জানা যায়, এক সময় সর্বজনীন উৎসব হিসেবে ‘হালখাতা’ ছিল বাংলা নববর্ষের প্রাণ। ১৫৮৪ সালে ১০-১১ মার্চ সম্রাট আকবর বাংলা সন প্রবর্তনের পর থেকেই ‘হালখাতা’র প্রচলন হয়। পুরনো বছরের হিসাব বন্ধ করে নতুন হিসাব খোলা হয় যে খাতায়, সেটাই ‘হালখাতা’ নামে পরিচিত। অতীতে জমিদারকে খাজনা দেওয়ার অনুষ্ঠান হিসেবে ‘পুণ্যাহ’ প্রচলিত ছিল। বছরের প্রথম দিন প্রজারা সাধ্যমতো ভালো পোশাক পরে জমিদার বাড়িতে গিয়ে খাজনা পরিশোধ করতেন। তাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। জমিদারী প্রথা উঠে যাওয়ায় পুণ্যাহ বিলুপ্ত হয়েছে।

কিন্তু হালখাতা যেহেতু ব্যবসায়ীরা পালন করতেন তাই এটি অক্ষুণ্ণ আছে আজও। তবে এই হালখাতা এক সময় গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্র পহেলা বৈশাখে উদযাপন হলেও এখন তা শুধুই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। তবে এখন তাতে ভাটা পড়েছে বেশ। কারণ, মানুষের অতিশয় ব্যস্ততা ও অনলাইনকেন্দ্রিক জীবনযাপন এবং ইংরেজি সাল বা মাসকে সর্বত্র প্রাধান্য দেওয়া ও সর্বোপরি নতুন ব্যবসায়ীদের হালখাতা ইংরেজি নববর্ষকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়া।  

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, হালখাতা উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়েছে। যেসব দোকানে হালখাতা আয়োজন করা হচ্ছে তাদের আয়োজন প্রায় শেষের দিকে। পুরাতন জরাজীর্ণ বছর ও তার হিসাবপত্রকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরে নতুনভাবে এগিয়ে যেতে তাদের আয়োজন চলছে জোরেশোরে। দোকানপাট ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে তাতে রঙ দিয়ে নতুনত্ব আনার চেষ্টা চোখে পড়ার মতো। ফুল বেলুন দিয়ে সাজানো হচ্ছে দোকান। এছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি তারা পুরাতন খাতার সব লেনদেনের হিসাবও করছেন।

এদিকে নতুন টালি খাতা কেনার ধুম পড়েছে দোকানগুলোতে। হালখাতায় পুরাতন খাতার হিসাব-নিকাশ সব নতুন খাতায় তুলে রাখবেন। তাই টালি খাতা বিক্রেতাও দোকানে দোকানে ঢুঁ মেরে খাতার দাম ও আকৃতির জানান দিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া এক সময়  ক্রেতার এলাকায় গিয়ে কার্ড দিয়ে দাওয়াত দেওয়ার রেওয়াজ থাকলেও এখন ডাকযোগে কার্ড পাঠানো ও সেটা না হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফোনেই দাওয়াত পৌঁছে দিচ্ছেন দোকানিরা। আর গত কয় বছর ধরে অনেক ক্রেতাও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে তাদের ঋণ পরিশোধ করছেন। দূরের ক্রেতাদের আগেভাগে কার্ড বিতরণ করা শেষ। এখন চলছে কাছের ক্রেতাদের কার্ড বিতরণ। ফলে এসব কাজে সময় ব্যয় করে বেচাবিক্রি কমেছে অনেকাংশ।  তবুও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারলেই খুশি তারা।
পুরাণ ঢাকার হালখাতা উৎসবের প্রস্তুতি।  ছবি: সুমন শেখ
এছাড়া এক সময় হালখাতায় ক্রেতাদের নিজ আয়োজনে গরম মিষ্টি, জিলেপি ও অন্যান্য উপায়ে খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করলেও এখন তা বদলেছে। বেশিরভাগ দোকানি হোটেল বুকিং করে রেখেছেন। এর ফলে ক্রেতারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দেনা চুকিয়ে একটি টোকেন দেখিয়ে হোটেলগুলো থেকে খাবার নিয়ে নিচ্ছেন। রাখা হচ্ছে উপহারের ব্যবস্থাও। বিভিন্ন ধরনের দামি ও আকর্ষণীয় উপহার রাখা হচ্ছে ক্রেতাদের জন্য।

এ বিষয়ে শাঁখারি বাজারের ব্যবসায়ী নিখিল চন্দ্র দাস বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমাদের পুরো বছরের হিসাব-নিকাশের শেষ হয় হালখাতার দিনে। এবার আমাদের এখানে বৈশাখের দ্বিতীয় দিনে হালখাতা আয়োজন করেছি। এদিন গ্রাহকদের আপ্যায়নের পাশাপাশি উপহার দেওয়ার চেষ্টা করি। এছাড়া নতুন বছরে ব্যবসায়ের উন্নতির জন্য শিব ও চিরক পূজা করে থাকি। ’

কথা হয় শ্যামবাজার বিসমিল্লাহ্‌ আড়তের মালিক ইদ্রিস আলমের সঙ্গে। তিনি বাংলানিজকে বলেন, ‘আমাদের এই রীতি বাপ-দাদাদের আমল থেকে চলে আসছে। আমাদের এই বাজারে কৃষিপণ্য নিয়েই ব্যবসা চলে। তাই একেক ক্রেতার কাছে আমাদের পাওনা ২-৩ কোটি টাকার মতো হয়ে থাকে। যেহেতু আমাদের ব্যবসার পরিধি বড়, তাই আমাদের হালখাতাও চলে ১৫ দিন। দূর-দুরান্তের ক্রেতাদের জন্য আবাসিক হোটেল ও খাবার হোটেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আসা-যাওয়ার জন্য বাস ও প্লেন টিকেটও পাঠানো হয়েছে অনেক ক্রেতাকে। এছাড়া নতুন বছরে ব্যবসায়ের সমৃদ্ধি কামনায় দোয়ার আয়োজন করেছি। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৮
কেডি/জিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।