ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ ভাদ্র ১৪৩২, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

জাতীয়

সিরাজগঞ্জের তাঁতপল্লীতে বৈশাখী উৎসবের আমেজ

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩:২৪, এপ্রিল ১২, ২০১৮
সিরাজগঞ্জের তাঁতপল্লীতে বৈশাখী উৎসবের আমেজ তাঁতপল্লীতে বৈশাখী উৎসবের আমেজ

সিরাজগঞ্জ: থ্রি-পিস আর সালোয়ার-কামিজের দাপটে দেশীয় শাড়ি পড়ার প্রচলন হ্রাস পেলেও বিভিন্ন উৎসবকে ঘিরে শাড়ির ব্যাপক চাহিদা থাকে।

বিশেষ করে বৈশাখী উৎসব এলে তো শাড়ির কোনো বিকল্প থাকে না। মেয়েরা এসময় বেছে নেন তাঁতের শাড়ি।

তাই বছরের বেশিরভাগ সময় তাঁতিরা অলস সময় কাটালেও বৈশাখী উৎসবকে ঘিরে শাড়ি ও প্রিন্টের কারিগরদের যেন দম ফেলার সময় নেই।

সব শ্রেণি-পেশার নারীরাই পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে রঙ-বেরঙের শাড়ি পড়তে চান। ফলে পহেলা বৈশাখের দু’মাস আগে থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সিরাজগঞ্জের তাঁতিরা। তাঁতের শাড়ি উৎপাদনের পাশাপাশি হাজার হাজার তাঁতি নিজ বাড়িতে শাড়ি প্রিন্ট করছেন। বৈশাখের আবহ বজায় রাখতে তাঁতের কিংবা প্রিন্ট করা শাড়িতে ঢাক-ঢোল, একতারা-দোতারা, কলসি, ঘুড়ি, নৌকা, হাতপাখা, ইলিশ মাছ, মাছ ধরার পলোর ছবি এঁকে বাঙালি সংস্কৃতির চিত্র ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে।
 
সোমবার (৯ এপ্রিল) সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ, বেলকুচি উপজেলার তামাই, বেতিল ও এনায়েতপুর থানার গোপীনাথপুর ও উল্লাপাড়া উপজেলার দুর্গানগর, বালশাবাড়ি এলাকায় ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেলো।  

তাঁতিরা জানান, ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শুরু করে এপ্রিলের ১৩ তারিখ পর্যন্ত রাত-দিন কাজ করতে হচ্ছে তাদের। এ বছর বৈশাখী শাড়ির চাহিদা এতোটাই বেশি যে প্রিন্ট কারিগরদের প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছে।  

বৈশাখী শাড়ি উৎপাদনকারী সয়দাবাদের শামছুল আলম, লাবু খান, আব্দুল হান্নান, গোপীনাথপুরের আনোয়ার হোসেন বলেন, নরসিংদীর বাবুরহাট এলাকা থেকে গজ হিসেবে সাদা কাপড় কিনে আনেন। ওই কাপড়ে প্রিন্টিংয়ের কাজ করে বাজারে তোলেন। শাড়িতে চাহিদা অনুযায়ী ডুগি-তবলা, ঢোল, একতারা-দোতারা, মাছ ধরার পলো, ইলিশ, কাঁঠাল, শাপলা ফুলসহ নানা চিত্র ও নকশা ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে।
তৈরি করা হচ্ছে বৈশাখী শাড়ি ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার দিগুণ সংখ্যক শাড়ি উৎপাদন ও কেনাবেচা হয়েছে। শেষ মুহূর্তেও দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা বৈশাখী শাড়ির জন্য ভিড় জমাচ্ছেন। প্রতিদিন প্রায় ছয়-সাত হাজার শাড়িতে প্রিন্ট করছেন তারা। এতে খরচ শেষে শাড়ি প্রতি চার/পাঁচ টাকার মতো লাভ হয়।  

কথা হয়, প্রিন্টের শাড়ি তৈরির শ্রমিক শাহাদত, খাদিজা, রেখা খাতুন, তাসলিমা ও রোজিনার সঙ্গে। তারা জানান, তারা প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দুই মাস প্রিন্টের কাজ করে বাড়তি আয় করেন। দিনপ্রতি তিন থেকে চারশ’ টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকেন।  

গোপীনাথপুরের প্রিন্টিং শ্রমিক আবু সাঈদ জানান, বছরের এ তিন-চার মাস তিনি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে প্রিন্টিংয়ের কাজ করেন। প্রতিটি শাড়ি প্রিন্ট করা বাবদ মহাজন ১৫ টাকা করে দেন। খরচ শেষে শাড়ি প্রতি পাঁচ টাকা আয় হয়। প্রতিদিন গড়ে আড়াই থেকে তিনশ’ পিস শাড়ি প্রিন্ট করে রোদে শুকিয়ে মহাজনকে দিয়ে আসেন তিনি। এতে প্রায় এক থেকে দেড় হাজার টাকা প্রতিদিন আয় হয়।  

তাঁত ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ আলী, নুরনবী ও মোরসালিন বলেন, মার্চ মাসের শুরু থেকে পহেলা বৈশাখের আগের রাত পর্যন্ত চলে প্রিন্টিংয়ের কাজ। ঢাকার গাউছিয়া, ইসলামপুর, টাঙ্গাইলের করটিয়া, পঞ্চগড়ের আটোয়ারী, পাবনার আতাইকুলাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা এসে তার কারখানার শাড়ি নিয়ে যান।

অপরদিকে, বৈদ্যুতিক তাঁত মেশিনেও তৈরি করা হচ্ছে উন্নতমানের বৈশাখী শাড়ি। এসব শাড়ি সাতশ’ থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার টাকায় পর্যন্ত বিক্রি করা হচ্ছে।

বেতিল এলাকার টাঙ্গাইল তাঁত বাজারের মালিক তোফাজ্জল হোসেন বাবু বলেন, আমরা প্রতিবছর বৈশাখ আসার তিন-চার মাস আগে থেকেই রঙ-বেরঙের শাড়ি তৈরি করি। আমাদের মতো অনেকেই এখন পাওয়ারলুমে বৈশাখী শাড়ি উৎপাদন শুরু করেছেন।  

সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক জিহাদ আল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সিরাজগঞ্জে তাঁতের শাড়ির অবস্থা নাজুক হলেও বৈশাখী উৎসব উপলক্ষে যেন পূর্ণ যৌবন ফিরে পান তাঁতিরা। দীর্ঘদিন ধরেই এখানে শাড়ি প্রিন্টিংয়ের কাজ চলছে। বর্তমান তাঁতশিল্পের মন্দার বাজারে বৈশাখী শাড়ি যেন এখানকার তাঁত শ্রমিক-মালিকদের কাছে অবলম্বন হয়ে উঠেছে।  

সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটির নেতা নব কুমার কর্মকার বলেন, বাঙালির সার্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখকে আরো রঙিন করে তুলছেন সিরাজগঞ্জের তাঁতিরা। এটা বাঙালি সংস্কৃতির পাশাপাশি সিরাজগঞ্জের অর্থনীতির জন্যও অত্যন্ত ইতিবাচক। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বৈশাখী শাড়ি তৈরির কাজে তাঁতিরা আরও এগিয়ে যাবেন।  

বাংলাদেশ সময়: ০৯২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৮
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।