ঢাকা, সোমবার, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২, ১২ মে ২০২৫, ১৪ জিলকদ ১৪৪৬

জাতীয়

বাঁচার তাগিদে প্রকৃতির ওপরই চড়াও হতে হচ্ছে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের

পিংকি আক্তার, সিনিয়র রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৩১, মে ১১, ২০২৫
বাঁচার তাগিদে প্রকৃতির ওপরই চড়াও হতে হচ্ছে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের

‘নদী আমার জমি-জাগা (জায়গা) সব নিয়া গেছে। অহন বটগাছের জাগাটাই সম্বল।

এহানে আমি বাড়ি করতে চাই। আর হেললাইগা বটগাছটা কাটতে চাইছিলাম’— কথাগুলো বলছিলেন যিনি মাদারীপুরে কুমার নদের পাশে কেটে ফেলা বটগাছের মালিক সাত্তার হাওলাদার।

তার বক্তব্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে তিনি দেশে হাজার হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তুদের একজন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্রমাগত বাড়তে থাকা নদী ভাঙনে তিনি সব হারিয়েছেন। থাকার জায়গা নেই। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করা বিশাল একটি বটগাছের জায়গাটিই তার শেষ সম্বল। বেঁচে থাকার তাগিদে সেখানে বাড়ি করতে হলে বটগাছটি কাটতে হবে। আর সে কারণেই তিনি নিরুপায় হয়ে সেটা বিক্রি করে দিয়েছেন।

অর্থাৎ জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় যেখানে গাছ লাগানোর কথা, সেখানে জলবায়ু শরণার্থী বা উদ্বাস্তুদের বেঁচে থাকার তাগিদে গাছ কাটতে হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, ২০২২ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ৭১ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। বর্তমানে এ সংখ্যা আরও বেশি। ২০৫০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা এক কোটি ৩৩ লাখে পৌঁছাতে পারে।

ইউনিসেফ বলছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে জলবায়ু সংকটে ৩ কোটি ৫০ লাখ শিশুর শিক্ষা ব্যাহত হয়েছে।

একটি গাছ ঘিরে অনেক জীবন টিকে থাকে জানিয়ে পরিবেশবিদ অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, গাছের ডালে আশ্রয় নিয়ে বসত গড়ে অনেক পাখি। আবার নানা রকম পোকা মাকড়ও গাছে আশ্রয় নিয়ে বেঁচে থাকে। এটি প্রকৃতির জন্য উপকারী এবং বাস্তুতন্ত্রে সাম্যাবস্থা বজায় রাখে।

তিনি বলেন, বটগাছটির মালিকের দিকে তাকালেই আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের যে দুষ্টুচক্র, সেটি দেখতে পাই। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভুক্তভোগী হয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে আবার প্রকৃতির ওপরই চড়াও হতে হচ্ছে মানুষকে।

মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়নের আলমমীরের কান্দি গ্রামে খেয়া ঘাটে ‘পূজা-মানতের মতো শিরকের কাজ হচ্ছে’- এ অভিযোগ তুলে বটগাছটি কেটে ফেলা হয় বলে সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তা নিয়ে সংবাদও প্রকাশিত হয়।

তবে জলবায়ু উদ্বাস্তু গাছের মালিক ষাটোর্ধ্ব সাত্তার হাওলাদার জানান, স্থানীয় বাসিন্দা আবিল হোসেন বেপারীর কাছে তিনি এক হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে বটগাছটি বিক্রি করেন।

এ নিয়ে বাংলানিউজ কথা বলেছে আবিল বেপারীর সঙ্গে। তিনি জানান, কম দামে পেয়ে গাছটি কেনেন তিনি। পরে শ্রীনদী বাইতুস সুন্নত ক্যাডেট মাদরাসায় দান করেন, কারণ তার ছেলে সেখানে পড়তো। মাদরাসার লোকজন জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য গাছটি কেটে নিয়ে যায়। আর এই ঘটনা মে মাসের ৫ তারিখের।

কেটে ফেলা বটগাছটি নিয়ে যা বলছেন স্থানীয়রা
জানা যায়, ওই বটগাছের গোড়ায় অনেকে মোমবাতি জ্বালিয়ে মানত করতেন। সেখানে ঐতিহ্যবাহী ‘বান্নি মেলা’ বসতো প্রতিবছর। তবে এবার মাইকিং করে মেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এসব বিষয়ে জানতে স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলানিউজের এই প্রতিবেদক।

স্থানীয় অনেকে জানান, কেউ কেউ ওই বটগাছের নিচে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখতেন, কেউ কেউ আবার নতুন কাপড় বেঁধে দিতেন। আবার কেউ মিষ্টি জাতীয় খাবার গাছের সামনে দিয়ে রাখতেন।

স্থানীয় বাসিন্দা হেনা আক্তার বলেন, আমিও মানত করেছিলাম— আমার স্বামী যদি ঠিকমতো ইতালি পৌঁছাতে পারেন, তবে আমি গাছের গোঁড়ায় নতুন কাপড় দেব। পরে আমার স্বামী ইতালি পৌঁছানোর পর টাকা পাঠালে, আমি নতুন কাপড় কিনে দিই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পার্শ্ববর্তী নিলখী ইউনিয়নের এক নারী বলেন, একবার মানত করে গোপনে দুধ-শিন্নি দিয়েছিলাম। তবে কাজ হয়নি! তিনি মনে করেন, গাছটি নিয়ে যে বিশ্বাস রয়েছে, সেটি আসলে কুসংস্কার।

গাছ কাটায় অংশ নেওয়া আব্দুল কুদ্দুস বলেন, আমিও গাছ কাটায় অংশ নিই। এই গাছকে ঘিরে শিরক চলত। গাছের গোঁড়ায় মোমবাতি, নতুন কাপড়, মিষ্টি দেওয়া হতো, যা পাপ, শিরক। আল্লাহ এগুলো মেনে নেবেন না। যেহেতু একজন কিনে নিয়ে গাছটি মাদরাসায় দান করেছেন এবং যেহেতু বাড়ি করার জন্য গাছটি কাটতেই হবে, সে কারণে তা আমরা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য কেটে ফেলেছি।

প্রকৃতির ওপর অন্যায়, আছে আক্ষেপ আর ক্ষোভ
বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ন্যায়-অন্যায়ের বাইরে বিশাল বটগাছটি কেটে ফেলা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে আছে আক্ষেপ আর ক্ষোভ। শিরখাড়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বাবুল হোসেন বলেন, যারা এসব করতেন, তারা তাদের বিশ্বাসবোধ থেকেই এমনটা করতেন। গাছটি কেটে ফেলে প্রকৃতির ওপর অন্যায় করা হয়েছে। তবে এ ছাড়া গাছের মালিকের কোনো উপায়ও ছিল না।

স্থানীয় কৃষক মালেক আক্ষেপের সঙ্গে ক্ষোভ নিয়েই বলেন, দুপুরে আমরা যখন কাঠপোড়া রোদে ক্লান্ত হতাম, তখন এই গাছের নিচে বসতাম, প্রাণ জুড়ানো বাতাস তখন আমাদের ক্লান্তি দূর করে দিতো। আমরা এই গাছ কাটার বিরুদ্ধে ছিলাম। কিন্তু বাধা দেওয়ার উপায় তো নেই।

স্থানীয় কয়েকজন কিশোর জানায়, তারা এই গাছের ডালে উঠে খেলা করতো। স্কুল শেষে শিক্ষার্থীরা এই গাছতলায় গিয়ে আনন্দ করতো। বিভিন্ন সময়ে জমতো তাদের আড্ডা।

পরিবেশ-প্রকৃতি নিয়ে কাজ করা স্থানীয় আইনজীবী মাসুদ পারভেজ বাংলানিউজকে জানান, গাছের নিচে বান্নি মেলা হতো। এই মেলা গ্রামবাসীর বন্ধন আরও দৃঢ় করত। গাছটি ছিল স্থানীয়দের আড্ডাস্থল, যেখানে ছেলে-বুড়ো সবাই এক হতো। এতে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বজায় থাকত।

আছে গাছের বয়স নিয়ে বিভ্রান্তি
বিভিন্ন গণমাধ্যমে কেটে ফেলা ওই বটগাছটিকে শতবর্ষী বলা হয়েছে। আবার কেউ কেউ গাছটি ২০০ বছর বয়সী ছিল বলেও দাবি করেছেন। তবে গাছের মালিক সাত্তার হাওলাদার বলছেন, গাছটির বয়স ছিল মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ বছর। সেটি খেজুর গাছের ওপর জন্মায় বলেও জানান তিনি।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক জসিম উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ নানা ঋতুর দেশ হওয়ায় গাছের বয়স নির্ধারণ করা সহজ নয়। এটি শীত প্রধান দেশে সম্ভব।

বেঁচে থাকার তাগিদেই প্রকৃতির ওপর চড়াও
অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, নদী ভাঙনে জমি হারিয়ে আবার বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতির ওপরই চড়াও হতে হচ্ছে মানুষকে। এটি পরিবেশের একটি বিপর্যয় চক্র। তবে শুধু লোকবিশ্বাস বা ধর্মীয় কারণে যদি গাছটি কাটা হয়ে থাকে, তবে তা মেনে নেওয়া যায় না।

গাছটি কাটা নিয়ে যেহেতু ব্যাপকবাবে আলোচনা ছড়িয়ে পড়েছে, সে কারণে গাছটি কাটার কারণ অনুসন্ধানে মাদারীপুর বন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমকে প্রধান করে এবং শিরখাড়া ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কবির হোসেন ও শিরখাড়া ইউনিয়নের ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাককে সদস্য করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করে দেওয়া হয়েছে।

পিএ/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।