‘বাংলাদেশে শ্রমবাজার বৈষম্য’ শীর্ষক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে পাস এবং সমান যোগ্যতা থাকার পরও মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কারণে চাকরির বাজারে বৈষম্যের শিকার হন অনেকেই। পোশাক-পরিচ্ছদের কারণেও অনেকের চাকরি হয় না।
নারীদেরও চাকরিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়।  প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চ বেতনের চাইতে কম বেতনের চাকরিতে নারীদের বেশি করে ডাকেন।                                         
‘বাংলাদেশে শ্রমবাজার বৈষম্য’ শীর্ষক গবেষণাটি করেছেন মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক- শিব্বির আহমদ, প্রফেসর সংচিন জিন, ড. ভেরোনিক থেরিঅল এবং বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন গবেষণা বিভাগের লিড ইকোনোমিস্ট ড. ক্লাউস ডেইনিঙ্গার। 
সম্প্রতি গবেষণাটি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড ইকোনোমিকস অ্যাসোসিয়েশনের কনফারেন্সে উপস্থাপন করেন গবেষকদলের প্রতিনিধি মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক শিব্বির আহমদ। 
গবেষণা করার জন্য চারজন পুরুষ ও চারজন নারীর মোট আটটা কাল্পনিক সিভি বানিয়ে এনজিও, করপোরেট, মিডিয়া ও আইটি সেক্টরে পাঠানো হয়।  সিভিগুলো সমান রাখার জন্য সবাইকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বা কাছাকাছি ধরনের বিভাগ থেকে দেখানো হয়েছে।  এবং তাদের অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট ও অন্যান্য যোগ্যতা রাখা হয়েছে সমান। 
চারজন পুরুষের মধ্যে দুজন দাখিল-আলিম পাস করা, আর দুজন এসএসসি-এইচএসসি পাস করা।  মেয়েদের ক্ষেত্রেও তাই রাখা হয়েছে।  প্রত্যেক গ্রুপের দুটি সিভির একটিতে ধর্মীয় পোশাকসহ (দাঁড়ি-টুপি-হিজাব) ছবি দেওয়া হয়েছে।  অন্যজনকে রাখা হয়েছে জেনারেল পোশাকে।  মাদরাসা এবং স্কুল- এই দুই ব্যাকগ্রাউন্ডের ক্ষেত্রেই রাখা হয়েছে এই পোশাক। 
প্রায় ১০ মাস ধরে বিডিজবসসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত চাকরির বিজ্ঞপ্তি থেকে গবেষকরা ৪০৬টি পদের বিপরীতে ৩২৪৮টি সিভি পাঠিয়েছে। 
এর মাধ্যমে গবেষকরা দেখতে চেয়েছেন যে, একজন চাকরিদাতা প্রাথমিক বাছাইয়ের পর কাদের ইন্টারভিউ বা লিখিত পরীক্ষার জন্য ডাকে।  প্রত্যেক সিভির বিপরীতে একটা করে ফোন নম্বর ও মেইল ছিল, যা দুজন গবেষণা সহকারী মেইনটেইন করেন।  নারী কাল্পনিক সিভিগুলো মেইনটেইন করার জন্য একজন নারী এবং ছেলেদের সিভি মেইনটেইন করার জন্য একজন পুরুষ গবেষণা সহকারী কাজ করেছেন। 
গবেষণায় দেখা গেছে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা গ্র্যাজুয়েট যাদের দাখিল-আলিম ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল, অন্যান্য সব যোগ্যতা সমান থাকার পরও তারা চাকরির বাজারে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। 
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, স্কুল ব্যাকগ্রাউন্ডের চাকরিপ্রার্থীদের সমান সংখ্যক ইন্টারভিউ কল পেতে মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের চাকরিপ্রার্থীদের অন্তত ৪০ শতাংশ বেশি চাকরিতে আবেদন করতে হয়েছে।  পুরুষদের জন্য এটা আরও তীব্র। 
এছাড়া শুধু মাদ্রাসা ও স্কুল ব্যাকগ্রাউন্ডের দুজন ক্লিনশেভ করা পুরুষের সঙ্গে যদি তুলনা করা হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রার্থীকে ১৭১ শতাংশ বেশি চাকরিতে আবেদন করতে হয়েছে সমান সংখ্যক ইন্টারভিউয়ের ডাক পেতে।  চারটি সেক্টরেই এই বৈষম্য বিভিন্ন মাত্রায় বিদ্যমান। 
একইভাবে দাঁড়ি-টুপি, হিজাবের জন্যও রয়েছে বৈষম্য।  তবে হিজাবি নারীদের চেয়ে দাঁড়ি-টুপি আছে এমন পুরুষ প্রার্থীরা বেশি বৈষম্যের শিকার হন।  এনজিওতে হিজাবের কারণে বৈষম্য না থাকলেও দাঁড়ি-টুপি বা মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে পুরুষরা কম কল পান।  ধর্মীয় পোশাকের কারণে সবচেয়ে বেশি বৈষম্য হয় মিডিয়া ও করপোরেট সেক্টরে।  আইটি সেক্টরে মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য বৈষম্য থাকলেও, ধর্মীয় পোশাকে বৈষম্য দেখা যায়নি। 
অন্যদিকে জেন্ডারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো ভিন্নতা দেখা যায়নি গবেষণায়।  বরং এনজিওর চাকরিতে অনেক বেশি প্রাধান্য পান নারীরা।  গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নারীর প্রতি বৈষম্যতার বিরুদ্ধে গত দু-তিন দশকের সচেতনতার সুফল হিসেবে এটা হয়েছে। 
তবে নারীরা তুলনামূলক কম বেতন এবং যোগাযোগ করতে হয় এমন চাকরিতে বেশি কল পেয়েছেন।  সামগ্রিকভাবে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য কমলেও নারীদের কম বেতনের চাকরিতে এখনো প্রাধান্য বেশি।  আশ্চর্যজনকভাবে মিডিয়া জবে নারীরা তুলনামূলক কম কল পেয়েছেন।  সমান যোগ্যতার নারী-পুরুষ আবেদন করলে মিডিয়া পুরুষ প্রার্থীকে তুলনামূলক বেশি প্রাধান্য দেয়। 
গবেষকদল আশা করেন, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা এ গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে চাকরির বাজারে বৈষম্য দূরে ভূমিকা রাখবেন। 
এ ক্ষেত্রে গবেষকরা মনে করেন, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট চাকরি প্রার্থীদের সিভিতে ছবি ও এসএসসি-এইচএসসি বা সমমানের পর্যায়ের ডিগ্রি সম্পর্কিত তথ্য উল্লেখ করার প্রথা বাতিল করলে কমে আসবে বৈষম্য। 
বাংলাদেশ সময়: ১০৫২ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০২৩
এসআই
 


 
                                             
                 
                 
                 
                 
                 
                 
                 
                 
                