ঢাকা, সোমবার, ২০ শ্রাবণ ১৪৩২, ০৪ আগস্ট ২০২৫, ০৯ সফর ১৪৪৭

আইন ও আদালত

হাসিনা ছিলেন পুলিশের বাপ-মা: গুলিতে চোখ হারানো পারভীনের সাক্ষ্য

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:০৪, আগস্ট ৪, ২০২৫
হাসিনা ছিলেন পুলিশের বাপ-মা: গুলিতে চোখ হারানো পারভীনের সাক্ষ্য শেখ হাসিনা

জুলাই অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশনের তৃতীয় সাক্ষী পুলিশের গুলিতে চোখ হারানো পারভীন বলেছেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন পুলিশের বাপ-মা, তার নির্দেশ ছাড়া পুলিশ গুলি করতে পারে না।

সোমবার (৪ আগস্ট) বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্য দেন ২৭ বছর বয়সী পারভীন।

এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ৬ আগস্ট দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।  

এর আগে সোমবার দ্বিতীয় সাক্ষী দেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ২৫ বছর বয়সী আবদুল্লাহ আল ইমরান।  

আদালতে প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী এমএইচ তামীম, বিএম সুলতান মাহমুদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান প্রমুখ।  

এই দুই সাক্ষীর জবানবন্দি শেষে তাদের জেরা করেন রাষ্ট্র-নিযুক্ত পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের আইনজীবী মো. আমির হোসেন।  

দিনের শুরুতে জবানবন্দি দেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ২৫ বছর বয়সী আবদুল্লাহ আল ইমরান।  

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘গত বছরের ১৯ জুলাই রাজধানীর বিজয়নগর পানির ট্যাংক এলাকায় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তার বাঁ হাঁটুর নিচে গুলি লাগে। ’
আবদুল্লাহ আল ইমরান বলেন, ‘পঙ্গু হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছিল। গত বছরের ২৬ অথবা ২৭ জুলাই সকাল ৯টা-১০টার দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। একপর্যায়ে শেখ হাসিনা তার কাছে যান। শেখ হাসিনাকে তিনি ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করেন। শেখ হাসিনা তাকে ‘আপা’ বলে ডাকতে বলেন। ’

আবদুল্লাহ আল ইমরান আরও বলেন, তিনি কোথায় পড়াশোনা করেন, হলে থাকেন কি না, কেন থাকেন না, সে সম্পর্কে শেখ হাসিনা জানতে চান। তিনি বলেন, ‘একপর্যায়ে শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন, আমি আন্দোলনকারী। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, পুলিশ তোমাকে গুলি করেছে? আমি বলি, পুলিশ আমাকে সরাসরি গুলি করে। পুলিশের পোশাকে কারা ছিল, সেটা আমি জানি না। আমার পর আরও চার থেকে পাঁচজনের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। পরে শেখ হাসিনা যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখন হেল্প ডেস্কের কাছে গিয়ে ‘নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্ট’ অর্ডার দিয়ে যান, যা আমি শুনতে পাই। ’

তবে ‘নো রিলিজ নো ট্রিটমেন্ট ’ মানে কী, তখন বুঝতে পারেননি বলেও জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন আবদুল্লাহ আল ইমরান। তিনি বলেন, ‘একপর্যায়ে তিনি দেখেন, যথাসময়ে তার অস্ত্রোপচার হচ্ছে না। বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে পারছেন না। তার বাবা হাসপাতাল থেকে নিয়ে যেতে চাইলেও নিতে পারছিলেন না। তখন তিনি বুঝতে পারেন ‘নো রিলিজ নো ট্রিটমেন্ট’র মানে। তার পা কেটে তাকে কারাগারে নিতে চেয়েছিল। ’

এ ঘটনার জন্য শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দায়ী করেন আবদুল্লাহ আল ইমরান।

পরে সাক্ষ্য দেন পারভীন। তিনি বলেন, ঘটনার সময় থাকতেন রাজধানীর কুতুবখালী। কাজ করতেন দিনমজুর হিসেবে। গত বছরের ১৮ জুলাই বিকেলে নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জবানবন্দিতে পারভীন বলেন,কাজ থেকে পায়ে হেঁটে বাসা যাচ্ছিলাম। আমি যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত আসার পর দেখতে পাই রাস্তার ওপরে অনেক মানুষ পড়ে আছে, কারো হাত নেই, কারো পা নেই। ফ্লাইওভারের নিচে দেখি একটি ছেলে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিল। ছেলেটার সারা শরীরে রক্তাক্ত। তার দুই চোখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। দেখে আমার মায়া হয়, আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি ছেলেটির বয়স ১৮-১৯ হবে। আমি তাকে টেনে তুলে রিকশা খুঁজছিলাম।

তিনি বলেন, এমন সময় ১৪-১৫ জন সশস্ত্র পুলিশ মারমুখী ছেলেটিকে লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে। এমনভাবে গুলি করছিল যেন খই ফুটছিল। গুলিগুলো ছেলেটির পিঠে লাগে। আমি বাম হাত তুলে গুলি না করার অনুরোধ করলে একজন পুলিশ আমার বাম চোখে গুলি করে। আরও দুই-তিনজন পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি করার ফলে আমার তলপেটসহ কয়েক জায়গায় গুলি লাগে। এ সময় আমার চোখ দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। আমি ব্যথায় কাতরাচ্ছিলাম। আমি রাস্তায় পড়ে যাই। এ সময় ছেলেটি আমাকে এমন ভাবে চেপে ধরে এবং জোরে নিশ্বাস নেয়, মনে হলো ছেলেটি তখন মারা যায়। তারপর ছেলেটি আমাকে ছেড়ে দেয়।

জবানবন্দিতে পারভীন আরও বলেন, পরে লোকজন এসে আমাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠায়। শুরুতে পুলিশ কেইস বলে আমার চিকিৎসা করকে চায়নি ডাক্তাররা। আমার স্বামী খবর পেয়ে বরিশাল থেকে আসলে আমার চোখের অপারেশনের ব্যবস্থা করেন। অনেক কষ্টে আমাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে চোখের অপারেশন করে চোখ থেকে তিনটা গুলি বের করা হয় বলে আমাকে জানানো হয়। তিন-চারদিন পর আমাকে ঢাকা মেডিকেল থেকে আমাকে চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখা যায় আমার শরীর ও চোখে আরও গুলি রয়েছে। ভর্তি হতে হবে, অপারেশন করা হবে। ওই সময় ভর্তি করা হলেও অপারেশন করা হয়নি।  

‘আমার অপারেশন করা হয়েছে ৫ আগস্টের পর। এই অপারেশনে চোখ থেকে একটি বড় গুলি বের করা হয়। তলপেটের গুলিগুলো বের করা হয়নি। বর্তমানে আমি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা, এরপরেও ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য আদালতে এসেছি। আমি এক চোখ নষ্ট। আরেক চোখে ঝাপসা দেখি। আমার এই অন্ধত্বের জন্য একমাত্র শেখ হাসিনা দায়ী। শেখ হাসিনা ছিল পুলিশের বাপ-মা, তার নির্দেশে পুলিশ গুলি করেছে। তার নির্দেশ ছাড়া এভাবে গুলি করতে পারে না। হাজারো মানুষ আহত ও নিহত হয়েছে।

৩ আগস্ট প্রথম সাক্ষ্য দিয়েছেন যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে মুখের আকৃতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া খোকন চন্দ্র বর্মন। এ মামলার অপর দুই আসামি হলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।  

এর আগে গত ১০ জুলাই এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে সাবেক আইজিপি মামুন নিজেকে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হিসাবে যে আবেদন করেছেন, তা মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল।

এ মামলায় মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের রাজাকারের বাচ্চা ও রাজাকারের নাতিপুতি উল্লেখ করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করে। গুলি করে দেড় হাজারর ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। আহত হন প্রায় ২৫ হাজার।

দ্বিতীয় অভিযোগ, হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইজিপি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ও অধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে সেই নির্দেশ কার্যকর করেন।

গত বছরের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল এবং ১৮ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে কথা বলেন শেখ হাসিনা। দুইজনের সঙ্গে কথোপকথনের পৃথক অডিও রেকর্ড থেকে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোকে মারণাস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।

শেখ হাসিনার সেই নির্দেশ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির মাধ্যমে সব বাহিনীর কাছে দেওয়া হয়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তার অন্যান্য অঙ্গসংগঠন এবং ১৪-দলীয় জোটের কাছেও এই নির্দেশ চলে যায়। সেই নির্দেশের আলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এর দায়ে তাদের (হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুন) বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (সর্বোচ্চ দায়) আওতায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।

তৃতীয় অভিযোগ, রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি আসাদুজ্জামান ও মামুনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। চতুর্থ অভিযোগ, রাজধানীর চানখাঁরপুলে আন্দোলনরত নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায়ও শেখ হাসিনার পাশাপাশি ওই দুজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। পঞ্চম অভিযোগ, শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুনের বিরুদ্ধে আশুলিয়ায় নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনায়ও অভিযুক্ত করা হয়েছে।

ইএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আইন ও আদালত এর সর্বশেষ