মহানবী (সা.) পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন আল্লাহর দ্বিন কায়েমের মাধ্যমে নতুন জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য। একটি উম্মাহ বা জাতির রূপকার হিসেবে মুহাম্মদ (সা.)-এর অন্যতম প্রধান কাজ ছিল এমন একদল সহচর ও অনুসারী গড়ে তোলা, যারা আল্লাহর বিধানের সামনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকবে।
মক্কায় দ্বিনি দাওয়াতের চার নীতি
মক্কায় মহানবী (সা.)-এর দাওয়াতি কার্যক্রম প্রধানত চারটি মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। তা হলো—
১. প্রজ্ঞার সঙ্গে দাওয়াত : মক্কিজীবনে মহানবী (সা.) দাওয়াতি কার্যক্রমে সর্বোচ্চ প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। তিনি এমন একটি কৌশল অবলম্বন করেন, যেন ইসলামের দাওয়াত অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে না যায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আপনি আপনার প্রভুর পথে প্রজ্ঞা ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে আহবান করুন। তাদের সঙ্গে সর্বোত্তম পন্থায় বিতর্ক করুন। ’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১২৫)
২. ক্ষমা ও উপেক্ষা : সব বাধা উপেক্ষা করা এবং সব অবিচার ক্ষমা করে দেওয়ার নীতি অবলম্বন করেই মহানবী (সা.) ও সাহাবিরা মক্কায় দ্বিনি দাওয়াত দেন। যেমনটি আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা ক্ষমা করো এবং উপেক্ষা করো যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর বিধান দান করেন। ’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১০৯)
৩. ধৈর্য ও উত্তম প্রতিবিধান : মক্কিজীবনে রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কিরাম (রা.) সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দেন এবং তাঁরা মন্দের প্রতিদান ভালো দ্বারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
আল্লাহ তাঁদের প্রশংসা করে বলেন, ‘তাদেরকে দুইবার পারিশ্রমিক প্রদান করা হবে, যেহেতু তারা ধৈর্যশীল এবং তারা ভালোর দ্বারা মন্দের মোকাবেলা করে ও আমি তাদেরকে যে জীবিকা দিয়েছি তা থেকে তারা ব্যয় করে। ’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৫৪)
৪. বিরোধ না করে ইসলামে অবিচল থাকা : শত বাধা-বিপত্তির পরও মুশরিকদের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত না হওয়া, কিন্তু ঈমান ও ইসলামের ওপর অবিচল থাকা। আল্লাহ বলেন, ‘তারা যখন অসার বাক্য শোনে তখন তারা তা উপেক্ষা করে চলে এবং বলে, আমাদের কাজের ফল আমাদের জন্য এবং তোমাদের কাজের ফল তোমাদের জন্য; তোমাদের প্রতি সালাম। আমরা অজ্ঞদের সঙ্গ চাই না। ’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৫৫)
মক্কিজীবনে নবীজি (সা.)-এর কর্মকৌশল
ইতিহাসে রাসুলুল্লাহ (সা.) নবুয়ত লাভের পর মক্কায় যেভাবে দ্বিনের দাওয়াত দিয়েছেন, তা শুধু তাত্ত্বিক শিক্ষাই নয়, বরং বাস্তব জীবনে প্রয়োগযোগ্য এক সুস্পষ্ট কর্মপন্থা। কঠিন প্রতিকূলতা, সীমাহীন বিরোধিতা এবং সামাজিক বয়কটের মধ্যেও তিনি যে ধৈর্য, কৌশল ও বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ করেছেন, তা আজও মুসলিম উম্মাহর জন্য পথনির্দেশক। তাঁর কর্মপন্থার কয়েকটি দিক তুলে ধরা হলো—
১. গোপন দাওয়াতে ভিত্তি গড়া : নবুয়তের সূচনায় রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রথম তিন বছর দাওয়াত দেন গোপনে। এ পর্যায়ে তিনি সর্বপ্রথম তাঁর নিকটাত্মীয়, বন্ধু ও বিশ্বাসযোগ্য মানুষদের ইসলামের দিকে আহবান করেন। এতে একটি শক্ত ভিত্তি গড়ে ওঠে এবং প্রথম দিকের সাহাবিরা ছিলেন এই ভিত্তির স্তম্ভস্বরূপ। এই গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র কাফেলা প্রস্তুত করেন, যারা পরবর্তী সময়ে ইসলামের দাওয়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ড. আলী মুহাম্মদ সাল্লাবির বর্ণনা মতে, খাদিজা (রা.)-এর পর ইসলাম গ্রহণের ধারাক্রমটি নিম্নরূপ—২. আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)—কিশোরদের মধ্যে তিনিই প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন, ৩. রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পালকপুত্র জায়িদ বিন সাবিত (রা.), ৪. রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চার কন্যা তথা জয়নব, উম্মে কুলসুম, ফাতিমা ও রুকাইয়া (রা.), ৫. আবু বকর (রা.)। আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর প্রচেষ্টায় আরো পাঁচজন পুরুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁরা হলেন উসমান ইবনে আফফান, আবদুর রহমান ইবনে আউফ, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, জুবায়ের ইবনে আউয়াম তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রা.)। (আস-সিরাতুন-নাবাবিয়্যা, পৃষ্ঠা-৮৬-৯০)
২. নিজ পরিবার ও গোত্রে দাওয়াতি কার্যক্রম : তিন বছর পর রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রকাশ্য দাওয়াত শুরু করেন। আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে তিনি দাওয়াতে নিজের পরিবার ও গোত্র কুরাইশকে বেছে নেন। আল্লাহ বলেন, ‘আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করুন। ’ (সুরা : শুআরা, আয়াত : ২১৪-১৫)
কেননা গোত্রের লোকেরাই তাঁর সততা, বিশ্বস্ততা ও নৈতিক গুণাবলি সম্পর্কে অধিক অবগত ছিল। এ ছাড়া তিনিও তাদের কাছ থেকে অধিক সহনশীল আচরণ আশা করেন।
৩. ধৈর্য ও সংযমের অনুশীলন : মক্কার কুরাইশরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর নানা রকম নির্যাতন চালায়। তাঁকে ও সাহাবিদের গালাগাল, শারীরিক আক্রমণ, সামাজিক বয়কট ও প্রাণনাশের হুমকির মুখে পড়তে হয়। কিন্তু তিনি কখনো পাল্টা আক্রমণ করেননি বা প্রতিশোধের পথে যাননি, বরং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে ধৈর্য ধারণ করতেন এবং সাহাবিদেরও সংযত থাকতে বলতেন। সবর ও তাওয়াক্কুলের শিক্ষা ছিল তাঁর এই মক্কিজীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
৪. ছোট পরিসরে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা কার্যক্রম : মক্কিজীবনে রাসুল (সা.) গোপনে ছোট ছোট দলে সাহাবিদের ইসলামী শিক্ষা ও আখলাক গঠনের কাজ করেন। এর জন্য তিনি সাহাবি আরকাম ইবনে আবিল আকরাম (রা.)-কে বেছে নেন। যা ইতিহাসে ‘দারুল আরকাম’ পরিচিত। এই শিক্ষাকেন্দ্রে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা, কোরআন শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের কাজ চলত। এই গোপন প্রশিক্ষণকেন্দ্রটি ছিল পরবর্তীকালের বৃহৎ ইসলামী রাষ্ট্রের প্রাথমিক ‘লিডারশিপ ট্রেনিং সেন্টার’। এর দ্বারা বোঝা যায়, কোনো আন্দোলনের সফলতার জন্য শুধু সংখ্যাগত বৃদ্ধি নয়, বরং আদর্শবান, শিক্ষিত ও পরিশীলিত কর্মী প্রস্তুত করা গুরুত্বপূর্ণ।
৫. ধারাবাহিক অগ্রগতি : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কর্মপন্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল তাদাররুজ ধাপে ধাপে কাজ করা। প্রথমে তিনি তাওহিদ (একত্ববাদ) প্রচারে মনোনিবেশ করেন। এরপর রিসালাত ও আখিরাতের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময়ে মহানবী (সা.)-এর ওপর ধীরে ধীরে বিধানগুলো অবতীর্ণ হতে থাকে এবং তিনি সাহাবিদের শেখাতে থাকেন।
৬. উত্তম পন্থায় অন্যায়ের প্রতিবাদ : যখন মুসলমানের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেল এবং ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলো শেখানো হয়ে গেল, তখন নবীজি (সা.) উত্তম পন্থায় সামাজিক জুলুম, কুসংস্কার ও অপবিশ্বাসের সমালোচনা শুরু করেন। যেমন—তিনি সামাজিক বৈষম্য, নারীর প্রতি জুলুম, মূর্তিপূজার অসারতা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেন।
৭. বিকল্প জনগোষ্ঠীর সন্ধান : কুরাইশরা যখন অবিরাম নবীজি (সা.)-এর বিরোধিতা করতে থাকল, তখন তিনি বিকল্প জনগোষ্ঠীর সন্ধান করেন। তিনি তাঁর দাওয়াতি মিশনকে মক্কার বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এর অংশ হিসেবে তিনি মক্কার পার্শ্ববর্তী বাজার ও মেলায় দ্বিনের দাওয়াত দেন, হজের সময় আগত অতিথিদের দাওয়াত দেন, পার্শ্ববর্তী গোত্র ও জনপথগুলোতে যান। যেমন—তায়েফ।
৮. অনুসারীদের জীবন রক্ষার প্রচেষ্টা : মক্কিজীবনে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর অনুসারীদের জীবন রক্ষায় নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেন। যেমন—ক. মনোবল ধরে রাখতে উৎসাহ দান। আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.)-এর পরিবারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘হে ইয়াসির পরিবার! ধৈর্যধারণ করো, তোমাদের ঠিকানা হচ্ছে জান্নাত। ’
খ. দাসদের মুক্তি : বেলাল (রা.) ছিলেন উমাইয়া ইবনে খালফের ক্রীতদাস। ইসলাম গ্রহণের অপরাধে বেলাল (রা.)-এর গলায় দড়ি বেঁধে উচ্ছৃঙ্খল বালকদের হাতে তুলে দিত, তাকে নির্মমভাবে প্রহার করত, উত্তপ্ত বালুর ওপর শুইয়ে বুকের ওপর ভারী পাথর চাপা দিয়ে রাখত। এমন কঠিন সময়েও তিনি ‘আহাদ’, ‘আহাদ’ (আল্লাহ এক, আল্লাহ এক) বলে চিৎকার করতেন। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আবু বকর (রা.) তাঁকে কিনে স্বাধীন করে দেন।
গ. নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার পরামর্শ : মহানবী (সা.) নবুয়তের পঞ্চম বছর সাহাবিদের হাবশায় হিজরত করার পরামর্শ দেন।
৯. বিকল্প ভিত্তি প্রস্তুত : রাসুলুল্লাহ (সা.) বুঝতে পেরেছিলেন, দ্বিনি দাওয়াতের জন্য বিকল্প স্থান ও পরিবেশ প্রয়োজন। মক্কায় ইসলাম প্রসারের সম্ভাবনা কম, তখন তিনি হাজিদের ভেতর দাওয়াতি কার্যক্রম জোরদার করেন। সেই ধারাবাহিকতায় মদিনায় ইসলামের সুবাতাস বইতে শুরু করে। বাইআতে আকাবার মাধ্যমে মদিনায় ইসলামের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল গড়ে ওঠে এবং পরবর্তী সময়ে হিজরতের পথ সুগম হয়।
১০. অনুসারীদের সঙ্গ দান : মহানবী (সা.) মক্কিজীবনের পুরো সময়ে সাহাবি ও অনুসারীদের সঙ্গে ছিলেন। কখনো তিনি তাঁদের ছেড়ে নিরাপদ জীবনের সন্ধান করেননি। এমনকি কুরাইশরা নবীপরিবার ও তাঁর গোত্রকে অবরুদ্ধ করলে স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে তিনি তাঁদের সঙ্গে অবরুদ্ধ দিন কাটান।
হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মদ (সা.), পরিবার ও অনুসারীদের ওপর শান্তি বর্ষণ করুন। আমিন।
এনডি/