দিল্লি লাগোয়া উত্তরপ্রদেশে ভুয়া দূতাবাসের পরে এবারে ভুয়া ‘পুলিশ অফিসে’র সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। ওই মামলায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে নয়ডা পুলিশ।
তারা সবাই পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা এবং এদের প্রধান বলে যার কথা জানিয়েছে পুলিশ, তিনি একসময়ে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা ছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার আদি বাসিন্দা, বিভাস অধিকারী নামে ওই ব্যক্তির নাম এর আগে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতেও সামনে এসেছিল।
ওই ভুয়া থানা থেকে জাল করা পুলিশের প্রতীক, পরিচয় পত্র, সিল, প্যাড ইত্যাদি উদ্ধার করা হয়েছে।
নয়ডা পুলিশ জানিয়েছে যে ওই ভুয়া সংস্থার নাম দেওয়া হয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অ্যান্ড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো। সংস্থাটির একটি ওয়েবসাইট আছে।
ভারতের পুলিশ যে লাল আর নীল রঙ ব্যবহার করে তাদের থানা ও বিভিন্ন অফিসে, এই ভুয়া সংস্থাটিও ঠিক সেরকমই রঙ ব্যবহার করে সাইনবোর্ড বানিয়েছিল।
সংস্থার রেজিস্ট্রেশন হিসেবে তারা সাধারণ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নিবন্ধনের যে প্রক্রিয়া, সেই অনুযায়ী ২০২৫ সালেই উত্তরপ্রদেশে নিজেদের সংস্থাটিকে রেজিস্ট্রি করিয়েছিল।
নিজেদের ওয়েবসাইটে তারা পরিচয় হিসেবে লিখেছে একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ তদন্ত সংস্থা।
আবার তাদের ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরেশিয়া পোলসহ নানা দেশের রেজিস্ট্রেশনের উল্লেখ আছে। ভারত সরকারের তিনটি মন্ত্রণালয়েরও রেজিস্ট্রেশন আছে বলে উল্লেখ আছে ওই ওয়েবসাইটের মূল পৃষ্ঠায়।
এ ছাড়া নানা মানবাধিকার সংগঠন, সংবাদমাধ্যমের পরিচয়পত্র ইত্যাদিও পাওয়া গেছে। তবে এসব রেজিস্ট্রেশনের বেশিরভাগই আসলে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হিসাবে কাজের প্রশংসাপত্র। এসবের কোনোটাই কোনো ধরনের অপরাধের তদন্তের কাজ নয়।
যুক্তরাজ্যের রেজিস্ট্রেশনটি আবার বাণিজ্যিক কোম্পানি হিসেবে করা।
নয়ডার সেন্ট্রাল জোনের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার শক্তিমোহন অবস্থী সংবাদ সংস্থা এএনআইকে জানিয়েছেন, গ্রেপ্তার ছয়জনই ভুয়া পরিচয় দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা সেজে একটা সমান্তরাল ব্যবস্থা গড়ার চেষ্টা করছিলেন।
গ্রেপ্তারদের বিষয়ে তিনি বলেছে, প্রত্যেকেই পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। বিভাস অধিকারীর ছেলেও রয়েছেন গ্রেপ্তারদের মধ্যে।
কীভাবে ধরা পড়ল ভুয়া 'পুলিশ'?
পুলিশ বলছে গোপন সূত্রে তারা এই ভুয়া সংস্থাটির ব্যাপারে খবর পায়। নয়ডার সেক্টর ৭০-এ ১০-১৫ দিন আগে এরকম একটা সংস্থা বোর্ড লাগিয়ে অফিস খুলেছে বলে জানতে পারে পুলিশ। তবে ওই বাড়িটি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল জুন মাসের শুরুতে।
অবস্থী জানান, তথ্য পেয়েই জালিয়াতি, সরকারি নথির অপব্যবহার সংক্রান্ত একটি মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু হয়। ভিজিটিং কার্ড, পরিচয় পত্র, চেক বইসহ নানা নথি আমরা উদ্ধার করি, কিন্তু আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থার কর্মী বলে যে দাবি গ্রেপ্তাররা করছিলেন, তার সমর্থনে কোনো প্রমাণ তারা দিতে পারেননি।
নিজেদের পুলিশ কর্মী হিসাবে পরিচয় দিয়ে অনুদান সংগ্রহ করত, যা আসলে চাঁদাবাজি। তল্লাশি চালিয়ে ১৭টি স্ট্যাম্প সিল, নয়টি বিভিন্ন পরিচয় পত্র, ছয়টি এটিএম কার্ড, নয়টি মোবাইল ফোন এবং নগদ অর্থ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
অফিস খোলার দিন দশেকের মধ্যেই এই ভুয়া পুলিশ কর্মীরা বেশ কয়েকজনকে টার্গেট করেছিল।
মূল অভিযুক্ত বিভাস অধিকারীর বাড়ি বীরভূম জেলার নলহাটিতে। বীরভূমের স্থানীয় সাংবাদিকরা জানাচ্ছেন যে তিনি প্রায় ১৫ বছর আগে নলহাটি – দুই নম্বর ব্লকের সভাপতি ছিলেন। তাকে অবশ্য ২০২১ সালের ভোটের আগে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
তখন তিনি নিজেই একটি দল গঠন করেন এবং সে বছরের বিধানসভার ভোটে সাতজন প্রার্থীও দিয়েছিল তার দল। বীরভূমে তার মালিকানাধীন একটি শিক্ষক-শিক্ষণ কলেজ আছে।
পশ্চিমবঙ্গজুড়ে যে ব্যাপক শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি হয়েছিল, সেই তদন্তেও অধিকারীর নাম জড়িয়েছিল বলে জানাচ্ছেন সেখানকার স্থানীয় সাংবাদিকরা।
ওই নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় বর্তমানে জেলে আছেন যে অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত – সাবেক শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি, তার ঘনিষ্ঠ ছিলেন বিভাস অধিকারী, এমনটাই জানাচ্ছেন বীরভূমের সাংবাদিকরা।
ওই নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে নেমে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো বা সিবিআই এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বিভাস অধিকারীর বাড়ি ও অফিসে তল্লাশি চালিয়েছিল। তিনি আবার বেঙ্গল টিচার্স ট্রেনিং কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিও ছিলেন।
কয়েক সপ্তাহ আগে দিল্লির আরেক উপনগরী গাজিয়াবাদে সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল ভুয়া দূতাবাসের।
পুলিশ জানিয়েছিল যে হর্ষবর্ধন জৈন নামে বছর ৪৮-এর এক ব্যক্তি গাজিয়াবাদে একটা বাড়ি ভাড়া করে সেখান থেকেই ভুয়া দূতাবাস পরিচালনা করছিলেন। সেই ভুয়া দূতাবাসের পরে এবার সামনে এল ভুয়া পুলিশ অফিসের ঘটনা।
বিবিসি বাংলা অবলম্বনে
আরএইচ