ঢাকা, রবিবার, ২১ বৈশাখ ১৪৩২, ০৪ মে ২০২৫, ০৬ জিলকদ ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

টেসলার অবস্থা ধারণার চেয়েও খারাপ!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:০১, মে ৪, ২০২৫
টেসলার অবস্থা ধারণার চেয়েও খারাপ!

টেসলার অবস্থা ভালো না। প্রতিষ্ঠানটির বিক্রি কমছে।

মুনাফা ও শেয়ারের দামও দ্রুত কমছে। শোরুমের বাইরে নিয়মিত বিক্ষোভ হচ্ছে। সাইবারট্রাক বাজারে চলেনি। কোনো না কোনো কারণে পরিস্থিতি তার চেয়েও অনেক বেশি খারাপ।

সম্প্রতি প্রকাশিত ৭১ শতাংশ নিট আয় কমে যাওয়ার খবরটি সম্ভবত সিইও ইলন মাস্কের বিতর্কিত সরকারি দক্ষতা বিভাগ (DOGE) থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণার কারণে চাপা পড়ে গেছে। কিন্তু আয় কমে যাওয়ার এই ব্যাপারটি ইলেকট্রিক গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটির গুরুতর আর্থিক দুরাবস্থার একটি ইঙ্গিত মাত্র। কোম্পানিটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিক্রি হ্রাস এবং ইলেকট্রিক গাড়ির দাম কমার কারণে এমনটি ঘটেছে।

টেসলার মূল সমস্যা হলো - এর ক্রমশ বিলুপ্ত হওয়া নিট লাভ। এর প্রথম ত্রৈমাসিকের রিপোর্টের বিস্তারিত বিশ্লেষণে দেখা যায়, গাড়ি বিক্রি করাই যেখানে প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, সেই কাজটি করতে গিয়ে এখন কোম্পানিটি লোকসান গুনছে। অন্যান্য গাড়ি প্রস্তুতকারকদের কাছে ৫৯৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের রেগুলেটরি ক্রেডিট বিক্রি করার কারণে কোম্পানিটি চলমান ত্রৈমাসিকে মাত্র ৪০৯ মিলিয়ন ডলার লাভ দেখাতে সক্ষম হয়। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন যদি সফল হয়, তবে কোম্পানিটি সেই রেগুলেটরি ক্রেডিটও হারাতে বসবে, যা এটিকে লাভের ধারায় টিকিয়ে রেখেছে।

আমদানি করা অটো যন্ত্রাংশের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিতব্য আমদানি শুল্কের কারণে টেসলাকে বাড়তে থাকা ব্যয় মোকাবিলা করতে হতে পারে। মাস্ক নিজেও স্বীকার করেছেন যে, তার কিছু প্রতিযোগীর তুলনায় কম হলেও তা চোখে পড়ার মতো হতে পারে।

অন্যান্য গাড়ি প্রস্তুতকারকদের ইলেকট্রিক গাড়ির ওপর ছাড়ের কারণে টেসলার বিক্রি কমছে, বিশেষ করে চীনে। ইউরোপেও টেসলার বিক্রি কমছে। যখন এসব গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলোতে সামগ্রিকভাবে ইলেকট্রিক গাড়ির বিক্রি বাড়ছে, তখনো কমছে। কোম্পানিটি দ্রুতই চীনা গাড়ি প্রস্তুতকারক বিওয়াইডির কাছে বিশ্বের বৃহত্তম ইলেকট্রিক গাড়ি বিক্রেতার দীর্ঘদিনের খেতাব হারাতে চলেছে।

মাস্কের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণেও টেসলা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সেসবের মধ্যে আছে ফেডারেল সরকারকে মারাত্মকভাবে সংকুচিত করার চেষ্টা চালানো। আরও আছে জার্মানির এএফডির মতো বিশ্বজুড়ে অতি-ডানপন্থি দলগুলোকে সমর্থন করা। এমনকি কোম্পানিটির ওয়াল স্ট্রিটের কিছু ভক্তও বিশ্বাস করেন, কোম্পানিটির ব্র্যান্ডের এই ক্ষতি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। যদিও মাস্ক DOGE থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।

টেসলা ‘মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে’ নেই: মাস্ক

তবে টেসলা কোনো গুরুতর আর্থিক সংকটে রয়েছে, এমন ধারণা বাতিল করেছেন ইলম মাস্ক। গত ২৯ এপ্রিল বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে এক কনফারেন্স কলে তিনি বলেন, ‘আমরা বছরের পর বছর ধরে অনেক সংকট পার করেছি। অন্তত ডজনখানেকবার ধসের কাছাকাছি ছিলাম। বর্তমান সময়টি সেই সময়গুলোর একটি নয়। আমরা মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে নেই, এমনকি কাছাকাছিও নই। কিছু চ্যালেঞ্জ আছে এবং আমি আশা করি এই বছর কিছু অপ্রত্যাশিত ধাক্কা আসবে। তবে আমি কোম্পানির ভবিষ্যৎ নিয়ে অত্যন্ত আশাবাদী। ’

তবে কনফারেন্স কলে যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়নি তা হলো, ট্রাম্প প্রশাসন ফেডারেল নির্গমন বিধি বাতিল করতে চায়। এটা ইলেকট্রিক গাড়ি বিক্রি করা কোম্পানিগুলোকে সুবিধা দেয়। একইসঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়া এবং আরও আটটি মার্কিন অঙ্গরাজ্যের ফেডারেল মানদণ্ডের চেয়ে কঠোর নির্গমন বিধি দাবি করার অধিকারও শেষ করতে চায়, যা ২০৩৫ সালের মধ্যে গ্যাসোলিনচালিত গাড়ির বিক্রি নিষিদ্ধ করবে। ফেডারেল ও রাজ্য পর্যায়ে কঠোর নির্গমন বিধি না থাকলে, রেগুলেটরি ক্রেডিট বিক্রিও বন্ধ হয়ে যাবে।

ফেডারেল ও স্টেট ক্রেডিট বিক্রি টেসলার জন্য বেশ লাভজনক ছিল। এটা ২০২১ সালের শুরু থেকে একাই ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার আয় এনেছে। এই অর্থ মূলত সরাসরি কোম্পানির নিট লাভে যোগ হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে টেসলা ওইসব ক্রেডিট বিক্রির ওপর নির্ভরশীল ছিল। কারণ, কোম্পানিটি তার গাড়ি ও সৌর শক্তির পণ্য বিক্রিতে লোকসান গুনছিল। তবে ২০২১ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক থেকে, ক্রেডিট বিক্রি ছাড়াই প্রতি ত্রৈমাসিকে কোম্পানিটি সাম্প্রতিক ত্রৈমাসিক পর্যন্ত লাভজনক অবস্থায় ছিল।

মুনাফার হার সংকুচিত হচ্ছে

টেসলার একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের লাভের হারও কমছে। প্রথম ত্রৈমাসিকে, সেই পরিমাপ, গ্রস অটোমোটিভ লাভের হার ও রেগুলেটরি ক্রেডিট বিক্রি বাদ দিয়ে আরও অনেক খরচ যোগ করে না। সাম্প্রতিক ত্রৈমাসিকে এই হার ছিল ১২.৫ শতাংশ, যা ২০২২ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে ৩০ শতাংশ থেকে কমেছে।

মর্গান স্ট্যানলির গবেষণা অনুসারে, টেসলার লাভের হার এর আগে ২০১২ সালের শুরুতে এমন কম ছিল। তখন কোম্পানিটি মাত্র শুরু করেছিল। তখন বছরে মাত্র পাঁচ হাজার ৬০০টি গাড়ি বিক্রি করত। এটা গত বছর গড়ে প্রতিদিনের বিক্রির প্রায় সমান। ২০২২ সালে ৩০ শতাংশ লাভের মার্জিন কোম্পানিটিকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে লাভজনক গাড়ি প্রস্তুতকারক করে তুলেছিল। যদিও জেনারেল মোটরস, ফোর্ড বা স্টেলান্টিসের তুলনায় কোম্পানিটি খুবই কম সংখ্যক গাড়ি বিক্রি করত। পর্যাপ্ত মুনাফা এবং বছরে ৩৭ থেকে ৮৭ শতাংশ পর্যন্ত টেসলার বিক্রয় বৃদ্ধির সংমিশ্রণে, শেয়ারের দাম সরাসরি চাঁদে পৌঁছেছিল, এমনটি মাস্ক প্রায়ই বলেন। এটি কোম্পানিটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান গাড়ি প্রস্তুতকারক করে তোলে। আর মাস্ককে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি বানায়।

তবে গত বছর টেসলার বিক্রি হঠাৎ করে কমে যায়। এটা ছিল কোম্পানিটির ইতিহাসে প্রথম বার্ষিক পতন। এর একটি কারণ ছিল, ইলেকট্রিক গাড়ির বাজারে অন্যান্য গাড়ি প্রস্তুতকারকদের বাড়তে থাকা প্রতিযোগিতা, বিশেষ করে চীনে। মাস্কের বাড়তে থাকা রক্ষণশীল ও বিতর্কিত রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে কিছু ক্রেতার বিরূপ প্রতিক্রিয়া আরেকটি আংশিক কারণ।

এমনকি টেসলার শেয়ারের প্রতি এখনো আশাবাদী থাকা কিছু মানুষও বিশ্বাস করে, কোম্পানিটির ব্র্যান্ডের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হয়েছে। তবে তারা বিশ্বাস করে, কোম্পানিটি ‘রোবোট্যাক্সি’ চালু করার মাধ্যমে উপকৃত হবে। এটা অস্টিন ও টেক্সাসে টেসলার দ্রুতই চালু করার একটি নতুন পরিবহন পরিষেবা। এটা ব্যবহার করে চালকবিহীন পরিবহন সরবরাহ করা হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের পরিবহন বিভাগ টেসলার ওই স্বচালিত পরিবহন সেবাকে বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) একটি সুবিধা দিয়েছে বলে মনে হয়। কারণ এটি একটি স্বয়ংক্রিয় পরিবহন কাঠামো ঘোষণা করেছে। তার মধ্যে অপ্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রক বাধা অপসারণ এবং স্বয়ংক্রিয় যানবাহনের বাণিজ্যিক মোতায়েন সক্ষম করার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বিনিয়োগকারীরা এটিকে টেসলাকে সাহায্য করতে ট্রাম্প প্রশাসনের পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছে। তার ফলে শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) কোম্পানিটির শেয়ার ১০ শতাংশ বেড়েছে। তবে দীর্ঘ-প্রতিশ্রুত স্বচালিত পরিবহন সেবাটি সফল হবে কিনা, ওই পরিবহন কাঠামো তার নিশ্চয়তা দেয় না।

রোবোট্যাক্সির সম্ভাবনা ও সমস্যা

মাস্ক জানান, এই বছরের শেষের দিকে হিউম্যানয়েড রোবট টেসলার কারখানায় কাজ করবে। তিনি দাবি করেন, রোবোট্যাক্সি পরিষেবা এবং হিউম্যানয়েড রোবট প্রবর্তন টেসলাকে বিশ্বের পরবর্তী পাঁচটি সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানির সম্মিলিত মূল্যের চেয়েও বেশি মূল্যবান করে তুলবে।

টেসলার শেয়ারের ভক্তরা এখনো মাস্কের ভবিষ্যদ্বাণীর ওপর বিশ্বাস রাখেন। যদিও তাদের কেউ কেউ সময়সীমা নিয়ে ততটা আশাবাদী নন। ডিপওয়াটার অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ম্যানেজিং পার্টনার জিন মুনস্টার বিক্রয় হ্রাস এবং গবেষণা ও উন্নয়নে ২৫০ মিলিয়ন ডলার বৃদ্ধিকে অল্প লাভের হারের জন্য আংশিকভাবে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘বছরটি ভালো যাচ্ছে না। তবে তারা আগামী বছর উন্নতির জন্য একটি ভিত্তি স্থাপন করছে। ’ তিনি মাস্কের ধারণার সঙ্গে একমত যে, টেসলার পরিবহন পরিষেবা বাজারের একটি বড় অংশ দখল করে লাভবান হওয়ার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত।

তবে জেনারেল মোটরস সম্প্রতি তার নিজস্ব রোবোট্যাক্সি পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছে। কোম্পানিটির উপলব্ধি হল, ব্যবসাটিকে সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় যথেষ্ট সময় ও সম্পদ, সেইসঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক রোবোট্যাক্সি বাজার বড় হতে থাকা তাদের ব্যবসার জন্য অনুকূল না। ফোর্ডও তার নিজস্ব স্বচালিত পরিবহনের উন্নয়ন প্রচেষ্টা থেকে ব্যাপকভাবে সরে এসেছে। কোম্পানিটির উপলব্ধি, এমন উদ্যোগ দ্রুতই লাভজনক হবে না। ফোর্ডের সিইও জিম ফার্লি বলেছেন, লাভজনক ও পুরোপুরি স্বচালিত যানবাহন ব্যাপক আকারে তৈরি হতে অনেক দেরি আছে।

টেসলার রোবোট্যাক্সি প্রকল্প আসতে মাত্র এক বছর বাকি, এমন কথা মাস্ক অন্তত ছয় বছর ধরে বলে আসছেন। এমনকি, তিনি স্বীকার করেছেন, টেসলা তার ‘ফুল সেল্ফ ড্রাইভিং’ বা এফএসডি-র ক্ষমতার সময়সীমা সম্পর্কে আগের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি।

২০২৩ সালের জুলাই মাসে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে এক আলোচনায় তিনি বলেন, এফএসডি নিয়ে তিনি মিথ্যা বলেছিলেন এবং এমনকি তখন অক্টোবরে তার সর্বশেষ রোবোট্যাক্সি পরিকল্পনা চালু করার সময়ও তিনি স্বীকার করেছিলেন, তিনি সময়সীমা নিয়ে একটু বেশিই আশাবাদী হন।

এসএএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তথ্যপ্রযুক্তি এর সর্বশেষ