ঢাকা, শুক্রবার, ১ কার্তিক ১৪৩২, ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ২৪ রবিউস সানি ১৪৪৭

ফিচার

খ্যাতিমানদের জেলজীবন

আহ্সান কবীর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৫৫, সেপ্টেম্বর ৯, ২০১০
খ্যাতিমানদের জেলজীবন

দেনার দায়ে ছয় মাস মেয়াদ খাটার পর সদ্য কারামুক্ত গালিব তখন বন্ধুর বাড়িতে জম্পেশ আড্ডায় মগ্ন। একইসঙ্গে গোগ্রাসে গিলছেন আমজনতার প্রিয় ফল আম।

বলা বাহুল্য, আম গালিবেরও খুবই প্রিয় ছিল। ওদিকে বন্ধুরা হাজারও প্রশ্ন আর কথকতায় প্রিয় বান্ধব গালিবের মন থেকে কারাবাসের কষ্ট-কেদ সব মুছিয়ে দিতে তৎপর। বন্ধুসভার মধ্যমণি, উর্দু সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি গালিব হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘তবে ভয় হচ্ছিল আমি জেলে থাকতে থাকতে না আবার আমের মৌসুম শেষ হয়ে যায়!’

অবমাননা আর কষ্টকর বন্দিজীবন গালিবকে বাস্তবে কতটা আহত বা পীড়িত করতে পেরেছিল তা এ ঘটনায় সহজেই অনুমেয়। তার ছ মাসের সশ্রম কারাদ- হয়েছিল। তবে ম্যাজিস্ট্রেটের বিশেষ মেহেরবানিতে পরে তা বিনাশ্রম দন্ড করা হয় (প্রায় মতাহীন সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সুপারিশও হয়তো কিছুটা কাজ করে থাকতে পারে ক্ষেত্রে)।

এ বিষয়টা উল্লেখ করে বন্ধুদের একজন হাকিমের প্রশংসা করতেই গালিব বাধা দিয়ে বললেন, ‘প্রথম একমাস ছাড়া। ওই সময়টা প্রতিদিন যে পাঁচটা করে বেত্রাঘাত করা হতো তা ছিল অসহনীয়। ’

আড্ডার সবাই বেশ বড় রকমের ধাক্কা খেলেন। তাদের চোখ ছানাবড়া। বলে কী? দিল্লির শ্রেষ্ঠ কবি, অহংবোধের শিরোমণি, ওস্তাদোকা ওস্তাদ আসাদুল্লাহ খান গালিবকে বেত মারার দুর্মতি কোন কোতোয়ালের হতে পারে? সবাই হায় হায় করে উঠলেন।

ওদিকে নির্বিকারচিত্তে আম খেতে থাকা গালিব বন্ধুদের শান্ত করতে তার ‘বেত খাওয়ার’ কাহিনী যা বয়ান করলেন তা এরকম: কারাগারে তার দেখভালের দায়িত্ব পড়েছিল এক সংস্কৃতিমনা পুলিশ অফিসারের ওপর (হাজার হোক, তিনি সেই জমানার শ্রেষ্ঠ কবি, যাকে তাকে তো আর এমন দায়িত্ব দেওয়া যায় না! আমরা আমাদের কবি এরশাদের জেলজীবনে সেরকম কোনও ব্যবস্থা করেছিলাম কী না কে জানে, কিন্তু ব্রিটিশ প্রশাসন অত কাঁচা কাজ করে না)। তো যা হোক, ‘সঙ্গদোষে (বা গুণে) লোহা ভাসে’ কথার বাস্তবতা প্রমাণেই হয়তো বা ওই পুলিশ ভদ্রলোকের মধ্যে সে সময়ে প্রচন্ড কবিভাব জেগে উঠে।

এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় বন্দি কবি-সাহিত্যকরাই পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে অমর কাব্য বা সাহিত্যের জন্ম দেন। কিন্তু এখানে ঘটনা ঘটে উল্টো। গালিবের কেয়ারটেকার ওই পুলিশ সাহেব শুরু করলেন একের পর এক শের রচনা। এরপর গালিবের জবানিতে শুনুন বাকিটা: বেটা প্রতিদিন অন্তত ৫টা করে বয়েত লিখে আমাকে এনে শোনাতে শুরু করলো প্রশংসা পাওয়ার জন্য। তার সেই কবিতাগুলোর প্রতিটি আমার কাছে একটি করে বেত্রাঘাতের মত লাগতো (হাজার হলেও পুলিশি শের তো)। এভাবে ব্যাটা একমাসে আমার (মনের) পিঠের ছাল তুলে ছেড়েছে। শেষ পর্যন্ত দারোগার কাছে আর্জি জানিয়ে তাকে বদলির ব্যবস্থা করে জান বাঁচাতে হয়েছে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কারাবরণ বা বন্দি হওয়ার ঘটনা খ্যাতিমানদের করেছে আরো মহিমান্বিত, তাদের মুকুটে পরিয়েছে একের পর এক মর্যাদার পালক। গণমানুষের অধিকার আদায়ে বা স্রেফ সত্য আর ন্যায় প্রতিষ্ঠার খাতিরে, রাষ্ট্রমতার পালাবদল কিংবা শুধুই ব্যক্তিগত কারণেও যুগে যুগে কারাবরণ বা বন্দিত্ববরণ করতে হয়েছে শ্রেষ্ঠ এবং ঐতিহাসিক অনেক চরিত্রকে। এ তালিকায় আছেন শাসক-রাজনীতিক, ব্যবসায়ী-রাজনীতিক, রাজনীতি-ব্যবসায়ী, ধর্ম-ব্যবসায়ী, দার্শনিক, কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী আর বৈজ্ঞানিকরা। নবী ইউসুফ (যোশেফ), যীশু (ঈসা নবী), সক্রেটিস, নেপোলিয়ন, জোয়ান অব আর্ক, সম্রাট শাহজাহান (ছেলে আওরঙ্গজেব তাকে গৃহবন্দি করেছিলেন), কবি ও শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, খুদিরাম, ফিদেল কাস্ত্রো, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, চারণ কবি মুকুন্দ দাস, লিবিয়ার ওমর মুখতার, হালের নেলসন ম্যান্ডেলা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জুলফিকার আলী ভুট্টো, সাদ্দাম হোসেন, অং সান সু চি ছাড়াও আরও হাজারও খ্যাতিমান চরিত্র। এমনকি জেল খেটেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াও। এখানে বন্দিজীবনে খ্যাতিমানদের বিভিন্ন আচরণ বা কথকতার কয়েকটি বিবরণ দেওয়া হলো। এর কোনওটিতে ফুটে উঠেছে অতি উচ্চমানের রসবোধ, কোথাও আছে অসাধারণ সৌজন্যবোধ, কোনওটিতে আছে চরম আপে কিংবা পরম উদারতা। একই সঙ্গে এসব ঘটনার আরশিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেরও কিছুটা ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়।
 
যা হোক, মুশকিল-পসন্দ বা কাঠিন্যপ্রিয় কবি আসাদুল্লাহ গালিবের পর এবার সাবেক স্বৈরশাসক রাষ্ট্রপতি এবং কবি এরশাদের (তার কবিত্ব নিয়ে বিতর্ক আপাতত বাদ দিচ্ছি) একটি ঘটনা। সবাই তো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এরশাদ সাহেবের ‘টয়লেটে ক্যামেরা ফিট করা’ প্রসঙ্গে বিব্রতকর নানা কাহিনীর বয়ানই শুনে এসেছি এ যাবত। এ নিয়ে রসিক বা ‘আদি-রসিক’ রাজনীতিক শাহ মোয়াজ্জেমের বিটকেলে উক্তি নিয়েও বিস্তর চর্চা হয়েছে। তবে আমি জেলজীবনে এরশাদের প্রায়ই করা একটি আক্ষেপের কথা জানি। ঘটনাটি আমাকে বলেছিলেন পিলখানার পৈশাচিক হত্যাকান্ডে নিহত মেজর শাহনেওয়াজ।

এরশাদ যখন জেলে তখন শাহনেওয়াজ সাহেব ছিলেন ক্যাপ্টেন এবং তার দায়িত্ব পড়েছিল সাবেক রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা বিধানে। তো এ সূত্রে এরশাদ সাহেব প্রায়ই নিজ বাহিনীর এই জুনিয়র অফিসারের সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথাবার্তা বলে কিছুটা হালকা হওয়ার প্রয়াস পেতেন (উল্লেখ্য, মেজর শাহনেওয়াজ শের-শায়েরি বা অনুকাব্যের ভক্ত ছিলেন)।

এর মধ্যে এরশাদ আফসোস করে প্রায়ই যে কথাটা বলতেন তা ছিল- ‘বুঝলে শাহনেওয়াজ, জীবনে আমি দুটি মারাত্মক ভুল করেছি। এর একটি হল নূরউদ্দিনকে সেনাপ্রধান বানানো। ’ অপর ‘ভুল’টির কথা এরশাদ বলেছিলেন কী না কিংবা বলে থাকলেও আমাকে  শাহনেওয়াজ সাহেব জানিয়েছিলেন কী না মনে করতে পারছি না।

শাসকদের অনুগত আদালতের রায়ে হেমলক পানে মৃত্যুবরণ করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মহাজ্ঞানী সক্রেটিসও ছিলেন জেলবন্দি। এ সময়ে গুরুর প্রাণ বাঁচাতে শিষ্যদের কেউ কেউ বিশেষ করে প্লেটো পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে চাইলেও রাজি হননি জ্ঞানী-গুণীদের অহংকার এই শ্রেষ্ঠ মানুষটি। চরম মুহূর্তের আগ দিয়ে তিনি এক শিষ্যকে নির্দেশ দেন কোনও একজনের কাছ থেকে একটি মুরগি ধার নিয়েছিলেন তিনি, শিষ্য যেন তা শোধ করে দেয়। আমাদের ঋণ-খেলাপি সংস্কৃতির এ যুগে অন্যায় বন্দিত্ব আর মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও কর্তব্যজ্ঞান ও দায়শোধে সক্রেটিসের এমন গর্বিত আচার কারও কারও কাছে ভিনগ্রহে বুদ্ধিমান জীবের অস্তিত্ব পাওয়ার মতই ব্রেকিং নিউজ মনে হতে পারে। আর বর্তমান দার্শনিক-রাজনীতিকদের অনেকেই তাকে নিরেট গর্দভও ঠাওরাতে পারেন। বেটা কোথায় শেষ মুহূর্তে নাতির মুখটা দেখা, ছেলের সিএনজি স্টেশনের জমিটার (তখনকার হিসেবে কোনও জমিদারি বা রাজপদে চাকরি) কিংবা উর্বশী-সুন্দরীদের সঙ্গে সময় কাটানোর ইচ্ছা করবে- তা না, কমবখত বলে কী না ‘মুরগিটা ফেরত দিও’! এহেন নাদান-নাবুঝকে তো বিষ খাইয়েই মারা উচিত। সমাজের জঞ্জাল কোথাকার!
 
গণমানুষের কবি নজরুল জেলজীবনের অভিজ্ঞতায় দ্রোহে আর বিপ্লবের মন্ত্রে আরও উজ্জীবিত হয়ে লিখেছিলেন, ‘শিকল পড়া ছল এ মোদের শিকল পড়া ছল, এ শিকল পড়েই শিকল তোদের করবো রে বিকল’ কিংবা ‘কারার ওই লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট, রক্তজমাট শিকল পুজোর পাষাণ বেদী’।

গ্রিক পুরাণে আছে দেবরাজ জিউসের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মানুষকে সভ্যতা আর জ্ঞানের চালিকাশক্তি আগুনের সন্ধান দেওয়ার অপরাধে (!) প্রমিথিউসকে অলিম্পাস পর্বতে শিকলবন্দি করে রাখা হয় যেখানে প্রতিদিন একটি শিকারী ঈগল এসে তার পেট চিড়ে নাড়িভুঁড়ি খেত এবং পরদিন আবার তা স্বাভাবিক হয়ে যেত। এই নির্মম নির্যাতন আর বন্দিত্বের ভয়াবহতা সয়েও প্রমিথিউস মাথা নত করেননি পিতা দেবরাজ জিউসের কাছে। মানুষকে আগুনের সন্ধান দেওয়ার আনন্দময় গৌরবে তিনি নির্যাতন আর বন্দিত্বকে তুচ্ছজ্ঞান করেছেন।

আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা (দণি আফ্রিকায় তাকে ‘মাডিবা’ নামে ডাকা হয়) ১৯৬২ সালের ৫ আগস্ট গ্রেফতার হন। তখন তিনি এএনসির সামরিক শাখার নেতা ছিলেন। দণি আফিকার বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ শাসনের বিরুদ্ধে নাশকতাসহ অন্যান্য অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। এখানে উল্লেখ্য প্রথমদিকে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আদর্শে অনুপ্রাণিত ম্যান্ডেলা বাস্তবতার প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে ধাবিত হন। টানা ১৭ মাস ছদ্মবেশে-আত্মগোপনে থাকার পর সিআইএর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে জোহানেসবার্গ দুর্গে বন্দি করে। প্রথম রায়ে তাকে ৫ বছরের দ- দেওয়া হয়। এরপর একে একে বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে দীর্ঘ ২৭ বছর কারাবন্দি থাকতে হয়। ম্যান্ডেলার কারাজীবনের সিংহভাগ কাটে রোবেন দ্বীপের কারাগারে।

১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পান এবং পরে দণি আফ্রিকার প্রথম অবাধ এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে দেশটির প্রেসিডেন্ট হন। ম্যান্ডেলা ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পদে থাকেন। গণমানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার পে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তার জন্মদিন ১৮ জুলাইকে ‘ম্যান্ডেলা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। ১৯৯৩ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার ছাড়াও বিগত চার দশকে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে আড়াই শরও বেশি পুরস্কার ও পদক লাভ করেন। লণীয় যে বন্দি অবস্থায় বিচারের সময়ে ম্যান্ডেলা তার বিরুদ্ধে আনিত নাশকতামূলক কর্মকা-ের সত্যতা স্বীকার করেন। তবে দণি আফ্রিকায় বিদেশি শক্তির আগ্রাসনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ অস্বীকার করেন। আদালতে দেওয়া তার জবানবন্দির একটি অংশ ছিল এরকম: ‘আফ্রিকান জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আমি আমার জীবনকে উৎসর্গ করেছি। আমি শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি এবং একইভাবে কৃষ্ণাঙ্গ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধেও লড়াই করেছি। আমি এমন একটি গণতান্ত্রিক এবং মুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখি যেখানে সবাই মিলেমিশে নিরূপদ্রপে বসবাস করবে এবং সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। এটা এমন এক আদর্শ যা অর্জনে আমি বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পাই। কিন্তু প্রয়োজন দেখা দিলে এই আদর্শের জন্যই আমি জীবন উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত। ’
 
এই ঐতিহাসিক বক্তব্যে দেখা যায় আফ্রিকার কালোদের প্রাণপ্রিয় নেতা ম্যান্ডেলার মন শুধু কালোদের জন্য নয় সাদাদের জন্যও পুড়তো এবং পরবর্তীকালে দণি আফিকায় সব জাত-পাতের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা আর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন।

ফরাসি বিপ্লবের পর সাবেক রাজশক্তির কুশীলবদের একের পর এক গিলোটিনে প্রাণদন্ড কার্যকর করার সময়ের ঘটনা। সম্রাজ্ঞী মেরি অ্যাঁতোনেতকে গিলোটিনে নেওয়া হচ্ছিল। এ সময়ে তিনি অসাবধানতাবশত এক কারারীর পা মাড়িয়ে দেন। সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে ঘুরে বললেন, ‘মঁশিয়ে! ভুল হয়ে গেছে। মা করবেন!’


রাজমতায় থাকতে তার স্বামী চতুর্দশ লুইসহ অন্য রাজপুরুষ ও নারীদের মতার দাপট আর অনাচারের ঘটনা ইতিহাসের পাতায় তাদের স্থান দিয়েছে গণধিকৃত চরিত্র হিসেবে। তবে গিলোটিনে যাওয়ার পথেও মেরি অ্যাঁতোনেতের এই অসাধারণ সৌজন্য আর ভদ্রতাবোধ বিশ্বজুড়ে খ্যাত ফরাসি সৌজন্যবোধকে মর্যাদার আরও ওপরের স্তরে নিয়ে গেছে নিঃসন্দেহে।

আঠার শতকের বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক দ্যানিশ দিদেরো। তিনি ছিলেন বিশ্বের প্রথম এনসাইকোপিডিয়ার সম্পাদকম-লীর অধ্য এবং রূপকার। এই তেজী এবং দাপুটে পন্ডিত তার সময়ের অপর দুই ফরাসি মহীরূহ রুশো ও ভলতেয়ারকে ওই সম্পাদকম-লীতে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও অন্তর্ভুক্ত থাকতে বাধ্য করেছিলেন। পুরোহিতদের সঙ্গে দিদেরোর সম্পর্ক ছিল দা-কুমড়োর। পাদ্রীদের কটা করেননি, দিদরোর এমন রচনা খুব কমই আছে। তার বিশ্বাস ছিল পুরোহিত সম্প্রদায় তা সে পৃথিবীর যে কোনও ধর্মেরই হোক না কেন; ঈশ্বরের নামে সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম করে, তারা ভ-, উচ্ছৃঙ্খল ও লম্পট। যাজকদের সঙ্গে এ ধরনের জাত-শত্রুতার কারণে দিদরোকে জেলে যেতে হয়েছিল। তবে সে সময়ের মহামতাধর ধর্ম-ব্যবসায়ীরা মৃত্যুর পরও দিদরোকে ছাড়েনি। মৃত্যুর পর থেকে গত বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত তাঁর রচনা স্কুল-কলেজে পড়ানো হতো না। তাঁর রচিত উপন্যাস ‘অদৃষ্টবাদী জাক ও তার মনিব’ ফরাসি ভাষার প্রথম উপন্যাস যার নায়ক কোনও অভিজাত বংশের সন্তান নয়। এর নায়ক জাক একজন দার্শনিক এবং তার মনিব একজন জমিদার। এই জমিদারের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে যাত্রাপথের নানান ঘটনার সমাহার হচ্ছে উপন্যাসের প্রতিপাদ্য। অসাধারণ এই উপন্যাসের একটি ছোট্ট ঘটনা এখানে তুলে ধরছি।

যাত্রাপথে এক জনপদে বিশ্রামরত মনিব চাকর জাককে বললেন, নদীর ঘাটে লোকজন কেমন তা দেখে আসতে। উদ্দেশ্য ভিড় পাতলা হলেই তিনি গোসলটা সেরে আসবেন। পথে রাজার সৈন্যদের সঙ্গে জাকের দেখা। বেপরোয়া সৈন্যরা জাককে প্রশ্ন করলো, কোথায় যাচ্ছো? রসিক স্বভাবের দার্শনিক জাকের উত্তর, আমি কি জানি আমি কোথায় যাচ্ছি! এ ধরনের মাথা ধরানো জবাব শুনে এমনিতেই মাথাগরম সৈনিকদের মাথা আরো গরম হয়ে গেল। ব্যাটা তো আচ্ছা ত্যাদর। ধর শালাকে! জাককে গারদে পোরা হলো। এবার জাক ওই সৈন্যদের উদ্দেশ্য করে বললো, দেখ ভাইসব। আমি কিন্তু ঠিক কথাটাই বলেছিলাম। যাচ্ছিলাম নদীর পারে, এসে পৌঁছালাম হাজতে।
 
তার মানে আমরা আসলেও জানি না কে কখন কোথায় যাচ্ছি। অতি সাধারণ এ বিষয়টি নিয়ে ভাবলে সত্যি সত্যি সবকিছু জটিল-জটিল লাগে। আমাদের দেশের নেতা-আমলা-ব্যবসায়ীদের কথাই ধরুন না। অনেকেরই যার যার ক্ষেত্রে যাওয়ার কথা ছিল শীর্ষপদ বা আসনে। কিন্তু ১/১১-এর জরুরি অবস্থার পর এদের অনেককেই যেতে হয়েছে লালদালানে বা আত্মগোপনে। যাক, এ প্রসঙ্গ আপাতত বাদ দিই।  
 
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে। এ সময়ে মৃত্যুভয়ে ভীত করে তাঁর মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য সেলের পাশেই (তাঁর দৃষ্টিগ্রাহ্যতার সীমানায়) কবর খুঁড়ে বোঝানো হতো, এটা তোমার কবর। ফাঁসিকাষ্ঠও নাকি সাজানো হতো। এ সময়ে বাঙালির প্রাণের স্বজন এই অমর আত্মা পাকিস্তানিদের বলতেন, তোমরা আমাকে হত্যা করো আপত্তি নেই। কিন্তু আমার মৃতদেহটা পাঠিয়ে দিও আমার বাংলার মাটিতে।

বাঙলার মাটি আর মানুষের প্রতি এত গভীর মমতা আর ভালোবাসা যেই মানুষটির মনে-মস্তিষ্কে জাগরূক ছিল সারাণ, তার বুককেই তপ্ত সিসায় ঝাঁঝড়া করেছে বাঙালি। বর্বর-নিষ্ঠুর পাকিরা (পাকিস্তানিরা) যা করার সাহস বা কল্পনাও করেনি, আমাদের বিপথগামী সেনা কর্মকর্তারা তাই করে দেখিয়েছে। বলতেই হয়, কী বিচিত্র এসব মানুষ (কিংবা সৈনিক)!

মনটা একটু কেমন কেমন হয়ে গেল! ঠিক আছে, এবার একটু হালকা করে নিন। জেলবন্দি গালিবেরই আরেকটি ঘটনা দিয়ে শেষ করছি। গালিব তার প্রকোষ্ঠে বসে একটি বইয়ে মগ্ন ছিলেন। কিন্তু কিছুতেই মনোসংযোগ করতে পারছিলেন না। সকাল থেকেই কার যেন কান্নার শব্দ ভেসে আসছিল আশপাশের কোথাও থেকে। প্রহরীকে জিজ্ঞেস করতেই সে বললো, ‘হুজুর, অল্পবয়সী একটি ছেলে। তার তিন মাসের কয়েদ হয়েছে। ’

ওদিকে কান্নার শব্দ থামছিলই না। একপর্যায়ে গালিব ছড়ি হাতে উঠে দাঁড়ালেন। নিজ প্রকোষ্ঠ থেকে বেড়িয়ে ছেলেটির প্রকোষ্ঠের সামনে এসে দাঁড়ালেন।

‘কি হয়েছে?’

কাঁদতে কাঁদতেই ছেলেটি বলল, আমার তিন মাসের জেল হয়েছে।

তাতে এত কান্নাকাটির কী আছে? আশ্চর্য হয়ে গালিব জানতে চাইলেন।

আজ আমার বিয়ের দিন ছিল।

হো হো করে হেসে উঠলেন মুশকিল পসন্দ শায়ের। ছেলেটি চমকে উঠলো।

‘নিজেকে ভাগ্যবান মনে করা উচিত তোমার! কারণ পুরো জীবন কয়েদি হিসেবে কাটানো থেকে বেঁচে গেছ। আল্লাহ অত্যন্ত দয়াশীল। তোমার উচিত এই নেক কাজের জন্য পুলিশদের ধন্যবাদ জানানো যে, যথাসময়ে তারা তোমাকে গ্রেফতার করেছে। এই বন্দিত্ব তো সময় ফুরুলেই শেষ হবে। কিন্তু বিয়ের কয়েদবাস সারাজীবনে তোমার শেষ হবে না। ’

বিয়ে না করতে পারার শোক ভুলে তরুণ বিস্ময়াভিভূত নেত্রে চেয়ে রইল গালিবের দিকে। তিনি তখন উল্টোঘুরে হাঁটা দিয়েছেন নিজের প্রকোষ্ঠের উদ্দেশে।

ahsan.akraza@gmail.com    

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৫০০, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।