ঢাকা, শনিবার, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২, ১২ জুলাই ২০২৫, ১৬ মহররম ১৪৪৭

ফিচার

হালদাপাড়ের চিত্র

ডিমের ভিতর জীবন

রমেন দাশগুপ্ত, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, চট্টগ্রাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:৫৩, এপ্রিল ২১, ২০১১
ডিমের ভিতর জীবন

পরবর্তী অমাবস্যা আর পূর্ণিমার জন্য অপেক্ষা করছেন দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীপাড়ের মাছের ডিম আহরণকারীরা। প্রান্তিক এবং মৌসুমী আহরণকারী সবার আশা, অমাবস্যা-পূর্ণিমায় ভরা জোয়ার উঠলে আবারও হালদায় ফিরবে মা মাছ, ছাড়বে ডিম।



আর এ অনিশ্চিত স্বপ্নকে আশ্রয় করেই ডিম থেকে পোনা ফোটানোর ম্লান উৎসবে মেতেছেন আহরণকারী জেলেরা। ২০ এপ্রিল বুধবার দিনভর হাটহাজারী ও রাউজানের হালদা নদীপাড়ে ঘুরে জেলেদের সঙ্গে বাংলানিউজের পক্ষ থেকে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

হালদা নদীর উত্তর পাড়ে হাটহাজারীর গড়দুয়ারায় ডিম সংগ্রহের জন্য পাঁচটি মাটির কুয়া বানিয়েছিলেন স্থানীয় আহরণকারী নূরুল হুদা। সংগ্রহ কম হওয়ায় মাত্র দুটি কুয়ায় তিনি ডিম রাখেন। বাংলানিউজকে তিনি জানান, ১২টি নৌকা ও ১২টি জাল নদীতে নামিয়ে তিনি মাত্র চার বালতি ডিম সংগ্রহ করতে পেরেছেন। সংগ্রহের পর ১৯ এপ্রিল মঙ্গলবার রাত ১টার দিকে ডিম ফুটে পোনা বের হয়েছে। এসব পোনার মধ্যে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাইশ আছে বলে জানান তিনি।

হালদার দক্ষিণ পাড়ের মৌসুমী আহরণকারী মুক্তিযোদ্ধা মোঃ সেকান্দার বাংলানিউজকে জানান, প্রতি বালতি ডিমে আড়াইশ গ্রাম থেকে পৌনে এক কেজি পর্যন্ত পোনা হবে। আড়াইশ গ্রাম ডিমে পোনা হয় সোয়া লাখ থেকে দেড় লাখ পর্যন্ত।

সেকান্দার জানান, গত বছর প্রতি কেজি পোনা তারা ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলেন। এ বছর যেহেতু ডিম কম পাওয়া গেছে, তাই প্রতি কেজি পোনা ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি হবে বলে তার  আশা।
পাঁচ বছর ধরে নিজের জন্য শাড়ি কেনেননি হালদাপাড়ের নয়াহাটের বাসিন্দা জারিয়া বেগম। ভেবেছিলেন এবার পোনা বিক্রি করে তার জন্য কয়েকটি শাড়ি, স্বামী দীন মোহাম্মদের জন্য একটি লুঙ্গি কিনবেন। কিন্তু এবার মা মাছ অসময়ে ডিম ছেড়ে দেওয়ায় তার সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি।

জারিয়া বেগম বাংলানিউজকে বলেন, ‘পোইত্য বছর পোনা বেচি পাঁচ হাজার ট্যাঁ পাইতাম। অভাবর সংসারত ইয়ুন আঁরলাই পঞ্চাইশ হাজার ট্যাঁ। এইবার কি গরয্যুম ভাবি কুল গরিত ন পারির। ’ (প্রত্যেক বছর পোনা বিক্রি করে পাঁচ হাজার টাকার মতো পেতাম। অভাবের সংসারে সেগুলো আমার জন্য ৫০ হাজার টাকা। এখন কী করব ভেবে কুল পাচ্ছি না। )

পেশায় জেলে না হলেও গত ৪০ বছর ধরে হালদা থেকে পোনা সংগ্রহ করছেন গড়দুয়ারা এলাকায় ‘মরিয়মের বাপ’ হিসেবে পরিচিত প্রান্তিক চাষী সেকান্দার আলম। তার ভাষায়, পাঁচ ক্লাসে পড়–য়া মরিয়মের বিয়ের জন্য তিনি অনেক কষ্ট করে ৪০ হাজার টাকার মতো জমা করেছেন। ভেবেছিলেন এবার পোনা বিক্রি করে আরও কিছু টাকা জমিয়ে মরিয়মের বিয়ে দেবেন।

সেকান্দার বাংলানিউজকে বলেন, ‘আইঁত ঘরত কাম গরির। ঠাডার-বিজলী কিচ্ছু নাই। মা (বড় মাছ) আইয়রে ডিম দিবুজে ইয়ান কেনে বুইজ্যুম। দুঁড়ত যাইয়েনে জাল মারজি, আজ্জের আন্দাজ পাই। ইয়ুন নৌহা আর জাল ভাড়া দ্যনত যাইবুগোই। ’ (আমি তো ঘরে কাজ করছি। মা মাছগুলো এসে যে ডিম ছাড়বে সেটা বুঝতে পারিনি। দৌড়ে গিয়ে জাল মেরে আধ কেজির মতো ডিম পেয়েছি। এগুলো জাল আর নৌকা ভাড়া দিতেই চলে যাবে। )

মাছের ডিম সংগ্রহের জন্য নৌকা মেরামত করে রঙ লাগিয়ে হালদা পাড়ে শুকাতে দিয়েছিলেন রাউজানের জামিরহাট জেলেপাড়ার সুবাস জলদাস। কিন্তু নৌকার রঙ না শুকোতেই তার মনের রঙ শুকিয়ে গেছে।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘৩৫ হাজার টাকায় একটি নৌকা বানিয়েছিলাম। সাড়ে ৬ হাজার টাকায় নৌকা মেরামত করেছি। আবার ডিম না দিলে একেবারে পথে বসে যাব। ’

তবে হতাশ নন স্থানীয় প্রবীণ আহরণকারী সোলায়মান সরকার (৭৮)। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলানিউজকে সোলায়মান সরকার বলেন, সামনের অমাবস্যা অথবা পূর্ণিমায় অবশ্যই জোয়ার আসবে। তখন আবারও ডিম ছাড়বে মা মাছ।

তবে প্রান্তিক ও মৌসুমী আহরণকারীদের এ দাবির সঙ্গে একমত নন হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘আর ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ আবার জোয়ার হলে আবারও নদী থেকে লবণাক্ত পানি আসবে। সেই পানি সহ্য করে নিকটতম সময়ের মধ্যে মা মাছ আবারও হালদায় আসবে এমন মনে হয় না। ’

উল্লেখ্য, হালদা নদীতে ১৯ এপ্রিল মঙ্গলবার ভোরে ডিম ছাড়ে মা মাছ। এরপর নদীপাড়ে আজিমের ঘাট, নাপিতের ঘাটা, আমতুয়া, মদুনাঘাট, মইশকরম, সিপাহির ঘাট, মাছুয়া ঘোনা, মাদারি কুল, মগদাই, অঙ্কুরীঘাট, জামিরহাট, গড়দুয়ারাসহ আরও কয়েকটি এলাকায় মা মাছের ডিম সংগ্রহ করেন কয়েক শ জেলে ও ডিম সংগ্রহকারী।

স্থানীয়রা জানান, বর্তমানে প্রায় আড়াই হাজার প্রান্তিক ও মৌসুমী আহরণকারী আছে যারা হালদা থেকে মাছের পোনা সংগ্রহ করেন। কিন্তু অসময়ে মা মাছ ডিম ছেড়ে দেওয়ায় ফলে পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় স্থানীয় আহরণকারীদের অধিকাংশই ডিম সংগ্রহে ব্যর্থ হন। খবর পেয়ে মাত্র চার থেকে পাঁচশ আহরণকারী গড়ে এক থেকে দেড় কেজি বা সর্বোচ্চ দু কেজি পর্যন্ত ডিম সংগ্রহ করতে সক্ষম হন।  
 
হালদা নদীতে প্রতি বছর এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে জুনের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ডিম ছাড়ে মিঠা পানির বিভিন্ন মা মাছ। আর এই মাছের ডিমের ওপর নির্ভর করেই জীবিকা চালান হালদা-তীরবর্তী বহু মানুষ।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৬৪৫, এপ্রিল ২১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।