সাহারবিল, চকরিয়া, কক্সবাজার ঘুরে এসে: পাহাড় থেকে নেমে আসা নদী মাতামুহুরী দু’তীরের মানুষদের কাঁদায়, আবার নিজেও কাঁদে। বর্ষায় পাহাড়ি ঢলে এ নদীর দু’কুল ছাপিয়ে গ্রামের পর গ্রাম ভাসে।
এ নদী এখন আশীর্বাদের বদলে অভিশাপে পরিণত হয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।
কক্সবাজারের চকরিয়া সদরে গেলেই দেখা যায় মাতামুহুরীর বর্তমান অবস্থা। সদর থেকে খানিক দূরে সাহারবিল ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নের মাইজগোনা ছোট্ট বাজারের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে এ নদী। এখানকার মানুষেরা বর্ষা মৌসুম সামনে রেখে মাতামুহুরীর ভাঙন রোধে আগাম ব্যবস্থা নিয়েছেন। তবে নাপিতপাড়ায় বেশ কিছু ঘর এরই মধ্যে মাতামুহুরী গিলেছে।
এাইজগোনা বাজারের ব্যবসায়ী নিজাম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, বর্ষায় মাতামুহুরী তীরের মাইজগোনা, সাহারবিল, বেহুলা, রামপুর, সওদাগরগোসা, কেয়ারবিলসহ বেশ কিছু গ্রাম প্লাবিত হয়। নদীর বিক্ষুব্ধতা ঠেকাতে রামপুরে একটি ক্রসড্যাম নির্মাণ করা হলেও এলাকাবাসীকে প্রত্যেক বর্ষায় পানিতে ভাসতে হয়।

সূত্র বলছে, অবৈধভাবে পাহাড় খনন করে পাথর আহরণ, নির্বিচারে বনজ সম্পদ উজাড় ও পাহাড়ে আগুন দিয়ে জুম চাষের কারণে প্রতি বছর বর্ষায় বৃষ্টির পানির সঙ্গে মাটি ও বালি এসে মাতামুহুরী নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে বর্ষা মৌসুমেও প্রমত্তা মাতামুহুরী নদীর বুকে জেগে উঠছে চর। এর ফলে এক সময়ের খরস্রোতা মাতামুহুরী ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় বয়সী ব্যক্তিরা বলেছেন, মাতামুহুরী নদীর উৎপত্তিস্থল আলীকদম থেকে চকরিয়া পর্যন্ত প্রায় ৩০টিরও বেশি কুম (গভীর পানি স্থল) ছিল। এগুলোর মধ্যে আলীকদমের চেলার কুম, বুজির কুম, গোলকুম, মাছকুম, তুলা সিকদার কুম, ছোট বমুর কুম, চতরমল্লার কুম, কুরইল্যার কুম, কলইঙ্গার কুম, সাবেক বিলছড়ির কুম, তেইল্যার কুম, রেপার ফাঁড়ির কুম, উনাছড়ির কুম, তাঞ্জার কুম, মল্লাইয়া পাড়ার কুম, চৈক্ষ্যং এর মুখের কুম, পাইল্লা পাড়ার কুম, মিজ্জিরির কুম, লামার হলইঙ্গার কুম, দুইখ্যা-সুইখ্যার কুম, সীতার কুম, ইয়াংছার কুম, ফাইতংয়ের কুম, চকরিয়ার ঘুইন্যার কুম, মোস্তাক মিয়ার কুম উল্লেখযোগ্য। এসব কুমে সব সময়ই ৪০ থেকে ৬০ হাত পানি থাকতো। অথচ এখন এসব কুম দিয়ে অনায়াসে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিচ্ছেন মানুষ।
স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, মাতামুহুরীতে অপরিকল্পিতভাবে বেশ কয়েকটি ব্রিজ নির্মাণের ফলে নদী নাব্যতা হারাচ্ছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যাতায়াতের সুবিধার্থে মাতামুহুরী নদীর চিরিংগা পয়েন্টে আগে থেকেই একটি বড় ব্রিজ রয়েছে। পরবর্তীতে এ নদীর ওপরে আলীকদমের নোয়াপাড়া, রেপারপাড়া, লামা উপজেলার লামার মুখ, চকরিয়ার বমুর মুখ, লামা পুরাতন থানার ঘাট, কাকারা মাঝের ফাঁড়ি বেতুয়া বাজার, সাহারবিল ও পেকুয়ার বাঘগুজারা বাজার পয়েন্টে ৯টি ব্রিজ নির্মিত হয়েছে।
এসব ব্রিজের কোনো কোনোটি নিয়ে আবার জটিলতাও রয়েছে। যাতায়াত চলছে পুরোনো লোহার ব্রিজ দিয়ে। অথচ বেইলি ব্রিজও অর্ধেক করে ফেলে রাখা হয়েছে। তার মানে একই স্থানে রয়েছে দু’টি ব্রিজ।

সাহারবিলে এমনই একটি ব্রিজ চোখে পড়ে বাংলানিউজের। মানুষজন প্রতিনিয়ত ঝুঁকি নিয়ে পুরোনো ব্রিজ দিয়ে যাতায়াত করছেন, অথচ নতুন ব্রিজের কাজ বন্ধ রয়েছে প্রায় চার বছর ধরে। এখানে মাতামুহুরী একেবারেই মরে গেছে। ব্রিজের আশপাশে চোখে পড়লো হাঁটুজল পেরিয়ে মানুষজন এপার থেকে ওপারে যাচ্ছেন।
চকরিয়ার বদরখালীর চাষি নূরুল ইসলাম জানান, বর্ষায় পাহাড়ি ঢল এসে চাষাবাদ তছনছ করে দেয়। জমিতে ফসল ফলানো তো দূরের কথা, বাড়ি-ঘরে থাকাও কঠিন হয়ে পড়ে। এককালে পাহাড়ি ঢল মাতামুহুরী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চকরিয়া সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সমুদ্রে চলে যেতো। এখন সে সুযোগ নেই। নদী মরে যাওয়ায় ঢলের পানি সরতে না পেরে ভাসায় সব কিছু।
সরেজমিনে ঘুরে মাতামুহুরী তীরের বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, কক্সবাজার ও বান্দরবানের ৪ উপজেলার অন্তত ১৫ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত এ নদীর সঙ্গে। এ নদীর মিঠা পানিতে বান্দরবানের লামা ও আলীকদম এবং কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়ার উপজেলার প্রায় ১ লাখ একর জমিতে বোরোসহ বিভিন্ন ফসলাদি উৎপাদন হয়। কিন্তু দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে পাহাড়, ছড়া, ঝিরি ও শাখা খাল থেকে পাথর আহরণের মাত্রা অস্বাভাবিক বেড়েছে। সেইসঙ্গে সংরক্ষিত বনভূমি থেকে নির্বিচারে গাছ কেটে উজাড় করার ফলে পাহাড়গুলো গাছপালাশূন্য হয়ে পড়েছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির সঙ্গে পাহাড় ধসে মাটি ও বালু এসে জমা হচ্ছে মাতামুহুরীর তলায়।
এলাকার সাধারণ মানুষ ও জনপ্রতিনিধিরা বলেছেন, এ নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় প্রতি বছর বছর সামান্য বর্ষণেও নদীতে প্রবল বন্যা ও পাহাড়ি ঢল নেমে আসে। তলিয়ে যায় লোকালয়। তীব্র আকার ধারণ করে নদী ভাঙন। নদী খনন করা না হলে ভাঙন রোধ করা কঠিন হবে, মাতামুহুরী এক সময় পরিণত হবে মরা নদীতে।
মিয়ানমার সীমান্ত থেকে উৎপত্তি হয়ে প্রায় ১১৮ কিলোমিটার এই মাতামুহুরী নদী বান্দরবানের আলীকদম-লামা হয়ে চকরিয়ার বুক চিরে পেকুয়া হয়ে মহেশখালী ও কুতুবদিয়া চ্যানেলের সঙ্গে মিলেছে। যুগ যুগ ধরে এই এলাকা জেলে-চাষিদের জীবিকার পথের সন্ধান দিয়েছে এ নদী। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেছেন বহু মানুষ।
মরা মাতামুহুরী এখন তাদের বুকে দীর্ঘশ্বাস জাগায়।
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়:mailto:ri_montu@yahoo.com]
বাংলাদেশ সময়: ০৫৩০ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৪