ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ ভাদ্র ১৪৩২, ২৬ আগস্ট ২০২৫, ০২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

ফিচার

হাঁস দিয়ে ভাগ্যবদল

শাহীন রহমান, পাবনা জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩:১৩, ডিসেম্বর ২, ২০১০
হাঁস দিয়ে ভাগ্যবদল

লেখাপড়ায় ভালো না করতে পেরে হতাশায় ভবিষ্যত যেনো অন্ধকার দেখছিল তিন বন্ধু গুলজার, আওয়াল আর ফিরোজ। সমাজ-পরিবারের কাছে বোঝা না হয়ে একটা কিছু করতে হবে, এমন দৃঢ় মনোবল নিয়েই তারা শুরু করে হাঁস পালন।

আর সেই হাঁস আজ তাদের শুধু নয়, হাসি ফুটিয়েছে তাদের পরিবারসহ অন্যদের মুখে। উচ্চশিতি না হয়ে, চাকরি বা বিদেশে না গিয়েও নিজেদের মেধা, ধৈর্য আর শ্রমকে পুঁজি করে যে স্বাবলম্বী হওয়া যায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত  পাবনার গাজনার বিলপাড়ের এই তিন বন্ধু। প্রত্যন্ত বিলপাড়ের স্বাবলম্বী এই তিন যুবকের সাফল্যগাথা এখন ছড়িয়ে পড়েছে পাবনা ও পার্শ¦বর্তী এলাকায়।
 
সম্প্রতি পাবনা শহর থেকে প্রায় ৩৭ কিলোমিটার দূরে সুজানগর উপজেলার দুলাই ইউনিয়নের গাজনার বিলপাড়ে চর গোবিন্দপুর গ্রামের তিন বন্ধু গুলজার হোসেন লাল (২৫), আব্দুল আওয়াল (২৫) এবং ফিরোজ হোসেনের (২৭) সাথে কথা হয় তাদের সাফল্যগাথা নিয়ে। আলাপকালে গুলজার হোসেন জানান, ‘২০০১ সালে দুলাই উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে তিনজনই ইংরেজিতে ফেল করার পর হতাশা আর লজ্জায় আমরা তিন বন্ধু পড়ালেখা বাদ দিয়ে বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নেই। কিন্তু সেখানেও আমাদের বাধ সাধে দারিদ্র্য। পড়ালেখাহীন, কর্মহীন আমরা যেনো বোঝা হয়ে দাঁড়াই পরিবার আর সমাজের কাছে। সবার তিরস্কার আর বাঁকা দৃষ্টিতে অল্প দিনেই হতাশা ভর করে জীবনে। এভাবেই কেটে যায় বেশ কয়েকটি বছর। ’ কথা বলতে বলতে আবেগাপ্লুত গুলজার হোসেন অতীতে ফিরে যান।

পাশ থেকে আব্দুল আওয়াল জানান, ‘২০০৭ সালে তিন বন্ধু পরিবারের মানুষদের বুঝিয়ে ছোটখাট ব্যবসা করা জন্য ১৫ হাজার টাকা জোগাড় করি। কিন্তু ব্যবসার কোনো পথ জানা না থাকায় সে টাকা কোনো কাজে লাগাতে ব্যর্থ হই। অবশেষে একদিন হঠাৎ করেই নিজেদের বুদ্ধিতে কিনে ফেলি ২০০ হাঁস’। বাড়ির পাশে বিশাল গাজনার বিল থাকায় তিনজন পালাক্রমে বিলে চড়াতে থাকেন ক্যাম্পবেল, বেলজিয়াম, ক্রস আর খাঁকি ক্যাম্পবেল প্রজাতির হাঁসগুলো। কিছুদিনের মধ্যেই হাঁসগুলো ডিম দেওয়া শুরু করলে তাদের অবস্থা পরিবর্তনের প্রথম ধাপ অর্জিত হয়।

আওয়াল জানান, মাত্র ছ মাসের ব্যবধানেই সব খরচ বাদ দিয়ে আমাদের আয় হয় ৮০ হাজার টাকা। এই টাকায় আমরা আরো ৮০০ হাঁসের ছানা কিনি। খামার সম্প্রসারণ হওয়ার পর এর নাম দেওয়া হয় ‘রাজলক্ষ্মী হ্যাচার’। মাত্র এক বছরের মাথায় ২০০৮ সালের শেষের দিকে এক হাজার হাঁস থেকে তাদের আয় হয় ৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে থেকে ৩ লাখ টাকা ব্যয় করে নির্মাণ করা হয় বিশাল হাঁস হ্যাচারি। বাকি টাকায় কেনা হয় আরো ২ হাজার হাঁসের ছানা। ৩ হাজার হাঁস নিয়ে চলা রাজলক্ষ্মী হ্যাচারির সুনাম এখন পাবনা ছাড়িয়ে অন্য এলাকার মানুষের কাছেও সাফল্যের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। বর্তমানে হ্যাচারি থেকে প্রতিদিন ২৮০০ করে ডিম পাওয়া যাচ্ছে। এই ডিম বিক্রি করে বছর শেষে তাদের লাভ আসছে প্রায় অর্ধকোটি টাকা। মহামারি বা বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় না এলে মাত্র দু বছরের মাথায় কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখছে ফিরোজ, গুলজার, আওয়াল।

আলাপকালে নিজের খামারে দাঁড়িয়ে তৃপ্তির হাসি মুখে নিয়ে হ্যাচারির অন্যতম স্বত্বাধিকারী ফিরোজ হোসেন জানান, ‘তাদের খামারে এখন বেতনভুক্ত ৮ জনসহ কাজ করেন ১৫ জন। এরই মধ্যে খামারে শুরু হয়েছে হাঁসের ছানা উৎপাদন। ফলে হাঁসের ছানা, ডিম আর পূর্ণবয়স্ক হাঁস বিক্রি করে তাদের আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। এছাড়া পাবনার বাইরে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় পদ্মাপাড়ে তারা খামার সম্প্রসারণ করেছেন। সেখানে দেড় হাজার হাঁস নিয়ে মধ্য আগস্ট থেকে যাত্রা শুরু করেছে তিন বন্ধুর ‘রাজলক্ষ্মী খামার’। খামার সম্প্রসারণ, ডিম সংগ্রহ, ছানা ফোটানোসহ নানা কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন এখন এই খামারের উদ্যোক্তা আর কর্মচারীরা।

অপর দুই বন্ধু গুলজার হোসেন ও আবদুল আওয়াল জানান, কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণ নয় বরং নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই তারা এখন পর্যন্ত খামার পরিচালনা করে আসছেন। হাঁস প্রতিপালনে কোনো বাড়তি খাবার দিতে হয় না। বিলের শামুক, জমির পোকা আর ধানের কুটা খেয়ে তারা বেঁচে থাকে। তবে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা, বিজ্ঞানসম্মত প্রশিক্ষণ, খামার ব্যবস্থাপনাসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেলে এই হ্যাচারি দেশের অন্যতম সেরা হ্যাচারি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে এবং বহু মানুষের কর্মস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে মনে করেন এই তিন উদ্যোক্তা।
 
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২২৪০, ডিসেম্বর ২, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।