বন্ধু বা সঙ্গী বানানোর পেছনের কারণ অনেক সময় জটিল হয়। আর সেটা সবসময় খুব ভালো বা নিঃস্বার্থ কারণে হয় না।
ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক সি এস লুইস লিখেছিলেন, বন্ধুত্বের শুরুটা হয় তখনই, যখন একজন আরেকজনকে বলে: ‘তুমিও? আমি ভেবেছিলাম, শুধু আমিই এমন!’ অর্থাৎ যখন কেউ আরেকজনকে চিনে নেয় নিজের মতো, কিংবা দুজনের অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি হঠাৎ মিলে যায় তখনই এক ধরনের সংযোগ তৈরি হয়, আর সেই সংযোগ থেকেই বন্ধুত্বের জন্ম।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৬০ সালে ‘ফেইড্রাস’ নামে একটি সংলাপে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো লিখেছিলেন, ‘সাদৃশ্যই বন্ধুত্বের জন্ম দেয়। ’ অ্যারিস্টোটলও একই রকম কথা বলেছিলেন, ‘কেউ কেউ বলে, বন্ধুত্ব মানে সাদৃশ্য; আমরা তাদেরই ভালোবাসি, যারা আমাদের মতো। ’
সাদৃশ্যপূর্ণ মতামত, চিন্তাধারা বা রুচির ভিত্তিতে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে— এমনটি স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। কিন্তু এই ধারণা সবসময় ঠিক নয়। বেশিরভাগ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এমন মানুষের সঙ্গে, যারা আত্মীয় কিংবা যৌনসঙ্গীও নন। তাই বন্ধুত্বকে শুধু জেনেটিক (বংশগত বৈশিষ্ট্য) বা প্রজননের স্বার্থ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।
এর পরিবর্তে, বিবর্তনবিজ্ঞানীরা বন্ধুত্ব বোঝাতে সাধারণত একটি আদান-প্রদানের নিয়ম ব্যবহার করেন, যাকে বলে রেসিপ্রোক্যাল অ্যালট্রইজম বা পারস্পরিক সহযোগিতার আদান-প্রদান। এর সহজ মানে হলো— তুমি যদি আমার উপকার করো, আমিও তোমার করব। তুমি যদি আমার পিঠ চুলকে দাও, আমিও দেব।
তবে সমস্যা হলো, সামাজিক মনোবিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মানুষ বন্ধুদের সঙ্গে দেওয়া-নেওয়ার হিসাব মাথায় রাখে না। প্রাইমেট (বানরজাতীয় প্রাণী) বিশেষজ্ঞ জোয়ান সিল্ক খুব সুন্দরভাবে এই বন্ধুত্বের ধাঁধাটাকে ব্যাখ্যা করেছেন। ‘বন্ধুত্বে পারস্পরিকতা ও ন্যায্যতা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু প্রতি-প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে (যেমন: তুমি আমার উপকার করলে, আমিও তোমার করব) সম্পর্ক গড়া ও টিকিয়ে রাখা, এমনটা প্রকৃতপক্ষে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্কের পরিপন্থী। যদি এই দুই বিপরীত দাবিই ঠিক হয়, তাহলে বন্ধুত্বের ব্যাখ্যা করা সত্যিই বিবর্তনমূলক দৃষ্টিকোণ থেকে কঠিন। ’
যেকোনো বিবর্তনমূলক ধাঁধার মতো এর উত্তর খুঁজতে হলে পশু জগতে তাকানোই যুক্তিসঙ্গত। কয়েক বছর আগে ফরাসি হাঙর গবেষক খতিয়ে দেখেছেন, হাঙরের দলবদ্ধ হওয়া সামাজিক কারণে হয় কি না— অর্থাৎ, তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে কি না, নাকি শুধু এক জায়গায় একসঙ্গে থাকার পেছনে অন্য কারণ আছে, যেমন এক এলাকা ভাগ করে বসবাস বা এক জায়গায় খাবার পাওয়া।
গবেষকরা ১৩৩টি ব্ল্যাকটিপ রিফ প্রজাতির হাঙর (কার্কারাইনাস মেলানোপ্টেরাস) নিয়ে গবেষণা করেছেন, যেগুলো ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের প্রবালপ্রাচীর এলাকায় বিচরণ করে। তারা দেখতে পান, কিছু হাঙর নির্দিষ্ট কয়েকটি হাঙরের সঙ্গ পছন্দ করে এবং সেই সম্পর্ক সময়ের সঙ্গে স্থায়ী হয়। আবার কিছু হাঙর একে অন্যকে এড়িয়ে চলে, এমনকি তারা একই এলাকায় বসবাস করলেও। অর্থাৎ, শুধু একই স্থানে বা একই এলাকায় অবস্থান করলেই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে না— হাঙরদের এই আচরণ থেকে সেটিই বোঝা যায়।
হয়তো ডলফিনের মতো বড় মস্তিষ্কের প্রাণীদের দিকে তাকালে বন্ধুত্বের বিষয়টি আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে। ডলফিনদের সমাজ মানুষের মতো নয়, বরং এদের সঙ্গে বানরের মতো প্রাইমেট বর্গের প্রাণী সমাজের সঙ্গে অনেক মিল রয়েছে। সেখানে দুটি ধরনের দলবদ্ধতা বা সম্পর্ক দেখা যায়।
ডলফিনদের সমাজে পুরুষ ডলফিনরা সাধারণত নিজেদের মধ্যে দল তৈরি করে স্ত্রী ডলফিনদের দখলে রাখার বা অন্যদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য। এদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট দলগুলোকে বলা হয় ‘প্রথম স্তরের জোট’।
এই জোটে দুই থেকে তিনজন পুরুষ ডলফিন থাকে, যারা মিলে স্ত্রী ডলফিনকে পাহারা দেয় এবং অন্য পুরুষদের থেকে রক্ষা করে। এরপর একাধিক প্রথম স্তরের জোট মিলে তৈরি করে আরও বড় একটি দল, যাকে বলা হয় ‘দ্বিতীয় স্তরের জোট’। এই বড় জোটগুলো একসঙ্গে কাজ করে অন্য দল থেকে স্ত্রী ডলফিন ছিনিয়ে আনার চেষ্টা করে।
সাধারণভাবে দেখা যায়, একই জোটের ডলফিনরা আত্মীয় হয়ে থাকে। তাই তাদের এই সহযোগিতা বা দলবদ্ধ আচরণকে ব্যাখ্যা করা যায় রক্তের সম্পর্ক বা জিনগত ঘনিষ্ঠতা দিয়ে, যেটাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় কিন সিলেকশন বা আত্মীয় বেছে নেওয়ার প্রবণতা।
রাজনৈতিক স্বভাবের প্রাণী
অস্ট্রেলিয়ার শার্ক বে-তে একটি গবেষণা দল ডলফিনদের মধ্যে তৃতীয় স্তরের একটি সামাজিক স্তর খুঁজে পেয়েছে। এ জোট গঠিত হয় একাধিক দ্বিতীয় স্তরের জোট নিয়ে, যারা একে অন্যের রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয় নয়। তবুও তারা একসঙ্গে একটি বড় জোট তৈরি করে।
মানুষের বন্ধুত্বের মতোই এ বড় জোটগুলোর সম্পর্কও কেবল বিনিময় বা পারস্পরিক সাহায্যের ভিত্তিতে তৈরি হয় না। উদাহরণস্বরূপ, গবেষকেরা দুটি ডলফিন দলের কথা বলেন। একটি দলের নাম ধরা যাক ‘পিডি’, অন্যটির নাম ‘কেএস’। দুইবারের ঘটনাতেই দেখা গেছে, পিডি দল কেএস দলের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে। যদি বন্ধুত্ব কেবল বিনিময়ের ভিত্তিতে গড়ে উঠত, তাহলে এ দুটি দল কখনোই একসঙ্গে প্রতিযোগিতা করত না। কিন্তু তৃতীয় একটি দল, যাকে বলা হচ্ছে ‘ডব্লিউসি’, যখন কেএস দলকে আক্রমণ করে, তখন আশ্চর্যজনকভাবে পিডি দল এগিয়ে আসে প্রতিযোগী কেএস দলকে সাহায্য করতে।
এই ঘটনা প্রমাণ করে, ডলফিনদের বন্ধুত্ব আগের অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে না, বরং তা অনেকটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত। কে পাশে আছে, তার ওপর ভিত্তি করেই তারা সিদ্ধান্ত নেয় কাকে সহায়তা করবে। এমনকি যদি কোনো দলের সঙ্গে শত্রুতা থেকেও থাকে, যদি তৃতীয় পক্ষকে ঠেকানোয় তাদের পারস্পরিক স্বার্থ থাকে, তবে তারা সাময়িকভাবে একজোট হয়ে যেতে পারে। এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে ডলফিনদের অনেক উন্নত মানসিক সক্ষমতা থাকতে হয়।
এই রকম রাজনৈতিক চিন্তাধারার বন্ধুত্ব মানুষের বাইরেও দেখা যায়। যেমন থাইল্যান্ডে ম্যাকাকা অ্যাসামেনসিস প্রজাতির বানরে এমনটি দেখা যায়। এদের সমাজে আধিপত্যই নির্ধারণ করে কে স্ত্রী বানরদের সঙ্গে মিলনের সুযোগ পাবে। এক গবেষণায় দেখা যায়, একটি পুরুষ বানর শুরুতে দলে তৃতীয় অবস্থানে থাকলেও সে অন্য পুরুষদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়তে পারেনি। ফলে তার সামাজিক অবস্থান নেমে গিয়ে প্রথমে ছয়ে এবং পরে আটে চলে যায়। ফলে সে স্ত্রী বানরদের কাছে আগের মতো প্রাধান্য পায়নি।
নিজের সুনাম রক্ষা করাই কি বন্ধুত্বের রহস্যের সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা হতে পারে? প্লেটো বা অ্যারিস্টটলের মতো সাদৃশ্য (মিল) বা বিবর্তনবিদদের মতো পারস্পরিক প্রতিদানের ধারণার চেয়ে এটি কি ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারে?
২০০৯ সালে মনোবিজ্ঞানী পিটার ডিসিওলি ও রবার্ট কার্জবান একটি পরীক্ষা করেন। এতে অংশগ্রহণকারীরা তাদের দশজন সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ কিন্তু পরিবারের সদস্য নয় এমন বন্ধুর একটি তালিকা তৈরি করেন এবং তাদের কাছাকাছি থাকার ক্রম অনুযায়ী সাজান। তারপর তাদের কল্পনা করতে বলা হয়, তাদের হাতে ১০০ পয়েন্ট আছে, যা তারা এই দশ বন্ধুর মধ্যে ভাগ করে দেবেন।
যখন বলা হয়, এই বণ্টনের তথ্য প্রকাশ করা হবে, তখন অংশগ্রহণকারীরা সবাই সমানভাবে পয়েন্ট দেন। প্রত্যেকে গড়ে ১০ পয়েন্ট করে দেন। কিন্তু যখন বলা হয়, এই বণ্টনের তথ্য গোপন থাকবে, তখন প্রিয় বন্ধুকে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট দেন, এরপর দ্বিতীয়, তৃতীয়… এভাবে ধীরে ধীরে কমে।
মানুষ সামাজিক প্রাণী হিসেবে নিজেদের সুনাম রক্ষায় খুবই সচেতন। তারা বুঝতে পারে তাদের আচরণ অন্যরা কীভাবে দেখবে। তাই যখন তারা জানে কেউ দেখছে না, তখন তারা নিজের প্রিয় বন্ধুদের বেশি পয়েন্ট দিয়ে পুরস্কৃত করে। আর যখন জানে সবাই দেখছে, তখন ন্যায়পরায়ণ বা সবার জন্য সমান আচরণের ছাপ রাখার চেষ্টা করে।
ডিসিওলি ও কার্জবান বন্ধুত্বের জটিলতা বোঝাতে রাজনৈতিক উদাহরণ ব্যবহার করেছেন, যেখানে অর্থনৈতিক বা ভৌগোলিক কারণগুলোর চেয়ে সামাজিক এবং কৌশলগত কারণগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তারা দেখিয়েছেন, ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের চেয়ে তিন গুণ বেশি বাণিজ্য করে। তবুও যুক্তরাজ্যকে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ ‘বন্ধু’ হিসেবে বেশি বিবেচনা করা হয়। তাদের মতে, যদি বন্ধুত্বকে আন্তর্জাতিক জোটের মতো ধরা হয়, তাহলে এটি কেবল সুবিধার আদান-প্রদান দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
বন্ধুত্ব হয়তো একটি কৌশলগত ব্যবস্থা, যা ভবিষ্যতে সম্ভাব্য দ্বন্দ্বের সময় সমর্থন পেতে সাহায্য করে। তারা বলেন, মানুষের সংঘাত সাধারণত নির্ভর করে যে প্রতিটি পক্ষে কতজন সমর্থক রয়েছে তার ওপর, শক্তি বা ফিটনেসের ওপর নয়। তাই বন্ধুত্বকে রহস্য বলে মনে হতে পারে, কারণ যদি আমরা আমাদের সম্পর্কের লেনদেনের স্বচ্ছ সত্য স্বীকার করি, তাহলে সেই সম্পর্কের দৃঢ়তা কমে যেতে পারে। সহজ কথায়, আমরা চাই বন্ধুত্ব যেন নিঃস্বার্থ হয়। তবে এর মানে এই নয় যে তা সত্যিই এমনই।
আরএইচ/এমজেএফ