ঢাকা, রবিবার, ১৯ শ্রাবণ ১৪৩২, ০৩ আগস্ট ২০২৫, ০৮ সফর ১৪৪৭

ফিচার

ভুল স্মৃতি, ম্যান্ডেলা ইফেক্টের নতুন সঙ্গী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা?

ফিচার ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৩৩, আগস্ট ২, ২০২৫
ভুল স্মৃতি, ম্যান্ডেলা ইফেক্টের নতুন সঙ্গী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা? প্রতীকী ছবি

আমেরিকায় কতটি রাজ্য? অনেকেই বলেন ৫১ বা ৫২টি। অথচ প্রকৃত সংখ্যা ৫০।

মোনালিসার হাসি কি আগে বেশি স্পষ্ট ছিল? অনেকের এমন ধারণা, যদিও এর কোনো প্রমাণ নেই। আবার ‘স্টার ওয়ারস’ সিনেমায় ডার্থ ভেডার আসলে বলেছিলেন, ‘না, আমি তোমার বাবা। ’ কিন্তু বহু মানুষ এখনও ভুলভাবে মনে করেন, তিনি বলেছিলেন, ‘লুক, আমি তোমার বাবা। ’ নিউজিল্যান্ডের অবস্থান নিয়ে অনেকেই ভুল ধারণা রাখেন; তারা মনে করেন নিউজিল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার উত্তরে বা উত্তর-পূর্বে, যেখানে বাস্তবে এটি দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত।

এসবই ‘ম্যান্ডেলা ইফেক্ট’বা ‘ম্যান্ডেলা প্রভাব’ নামে পরিচিত একটি ঘটনার উদাহরণ, যেখানে অনেক মানুষ একসঙ্গে একই ভুল স্মৃতি মনে রাখেন। আজকের যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের মাধ্যমে তৈরি বিভ্রান্তিকর ছবি ও তথ্য এই ভুল স্মৃতিকে আরও প্রকট করে তুলছে। আমাদের স্মৃতি গঠনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কেমন ভূমিকা রাখতে পারে, বিশেষজ্ঞরা তা জানতে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ম্যান্ডেলা ইফেক্ট কী?

ম্যান্ডেলা ইফেক্ট হলো এমন একটি ঘটনা, যেখানে অনেক মানুষ একইসঙ্গে একই ভুল তথ্য, ঘটনা বা ছবি তাদের স্মৃতিতে ধারণ করেন।

এই ইফেক্ট নিয়ে গবেষণা করেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক উইলমা বেইনব্রিজ। তিনি বলেন, আমরা যখন ভুল স্মৃতির কথা ভাবি, তখন সাধারণভাবেই মনে করি এটি শুধু নিজস্ব বিষয়। যেমন আমি মনে করতে পারি আমার দ্বিতীয় জন্মদিন কেমন ছিল। কিন্তু যখন সেই সময়ের ছবি দেখি, তখন দেখি আমার মনে করা বিষয়টি আসলে ঠিক নয়। ম্যান্ডেলা ইফেক্টের সবচেয়ে চমকপ্রদ দিক হলো, এটি একটি ভুল স্মৃতির রূপ, যা অনেক মানুষের মধ্যে দেখা যায়।

২০০৯ সালে প্যারানরম্যাল গবেষক ফিওনা ব্রুম এই নামকরণ করেন। তিনি লক্ষ্য করেন অনেক মানুষ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুর বিষয়ে একই ভুল তথ্য মনে রাখছেন। ম্যান্ডেলা ২০১৩ সালে ফুসফুসের সংক্রমণে মারা যান, কিন্তু অনেকেই ভুলে মনে করেন তিনি আশির দশকে জেলখানায় মারা গিয়েছিলেন।

এরপর থেকে সামাজিক মাধ্যমে এই ধরনের ভুল স্মৃতির আরও উদাহরণ সামনে এসেছে, যেখানে অনেক মানুষ একসঙ্গে তাদের মিলিত অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।

বেইনব্রিজ বলেন, মিলেনিয়াল প্রজন্মের লোকেদের ছোটবেলায় এই ভুল স্মৃতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, কারণ তারা ইনস্টাগ্রাম আর রেডিটের মতো সোশ্যাল মিডিয়া সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে। এসব জায়গায় ম্যান্ডেলা ইফেক্ট প্রায়ই দেখা যায়। তিনি বলেন, যদিও বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে এই প্রভাব দেখা যায়, তবুও কিছু পুরনো চিহ্ন বা আইকনোগ্রাফিতেও এ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

সাধারণত এসব পরিবর্তিত স্মৃতি ক্ষতিকর নয়। কিন্তু ম্যান্ডেলা ইফেক্ট আমাদের নিজের স্মৃতি এবং বাস্তবতাবোধ নিয়ে সন্দেহ করতে শেখায়।

ম্যান্ডেলা ইফেক্ট নিয়ে গবেষণা

ম্যান্ডেলা ইফেক্ট নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার শুরু খুব বেশি পুরনো নয়, তবে ভুল স্মৃতি কীভাবে তৈরি হয়, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক দিন ধরেই কাজ করে আসছেন। এই বিষয়ে কাজ করছেন জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব পটসডামের সামাজিক মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক আইলিন ওয়েবারস্ট।

তিনি ব্যাখ্যা করেন, আমাদের মস্তিষ্কে হিপোক্যাম্পাস নামের যে অংশটি কল্পনার কাজ করে, সেটিই আবার স্মৃতি সংরক্ষণের কাজও করে। ফলে কল্পনা ও স্মৃতি একে অপরের সঙ্গে গুলিয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে।

ওয়েবারস্ট বলেন, ভুল স্মৃতি তৈরি হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ একটি মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, কেউ যদি কোনো ঘটনা বারবার কল্পনা করেন, তাহলে এক সময় তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, ঘটনাটি সত্যিই ঘটেছিল এবং সেটি তার স্মৃতিরই অংশ।

আমরা যখন কোনো ঘটনা মনে করার চেষ্টা করি, তখন মস্তিষ্ক সেটিকে হুবহু ভিডিওর মতো চালিয়ে দেয় না, বরং টুকরো টুকরো স্মৃতি থেকে ছবিটি নতুন করে বানায়। এই পুনর্গঠনের সময় অনেক সময় ভুল কিছু ঢুকে পড়ে। যেমন, কেউ তার স্মৃতির ফাঁক পূরণ করতে পারে সামাজিক স্টেরিওটাইপ বা সাধারণ ধারণার ভিত্তিতে। আবার কারও আবেগ জড়িত থাকলে, স্মৃতিটিকে বাস্তবের তুলনায় বেশি ভালো বা খারাপ বলে মনে হতে পারে।

ওয়েবারস্ট বলেন, যেসব স্মৃতি নতুন, আবেগপূর্ণ এবং নিজের জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত— সেগুলোতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, কারণ আমরা সেগুলোই বেশি মনে রাখি, এবং অন্যদের বলি।

তবে মজার বিষয় হলো, এসব ব্যাখ্যা পুরোপুরি ম্যান্ডেলা ইফেক্টের ক্ষেত্রে খাটে না— বলছিলেন মনোবিজ্ঞানী উইলমা বেইনব্রিজ। ২০২২ সালের গবেষণায় তিনি এবং সহ-গবেষক দীপাশ্রী প্রসাদ দেখান, কখনো কখনো ম্যান্ডেলা ইফেক্ট এমন ভুল স্মৃতি তৈরি করে, যা প্রচলিত সামাজিক ধারণার পুরো বিপরীত হতে পারে।

ম্যান্ডেলা ইফেক্টের উদাহরণ

ম্যান্ডেলা ইফেক্ট কীভাবে তৈরি হয়, তা আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য গবেষক বেইনব্রিজ ও প্রসাদ বিভিন্ন পরিচিত আইকন বা প্রতীকী চিত্রের বিপরীতে মানুষের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করেন।  

বেইনব্রিজ একটি উদাহরণ দেন ‘ফ্রুট অব দ্য লুম’ নামক পোশাক ব্র্যান্ডের লোগো দিয়ে। এই লোগোতে আঙুরের থোকা, মাঝখানে একটি আপেল এবং সব কিছু একটি সাদা পটভূমিতে দেখা যায়। কিন্তু অনেক মানুষের সাধারণ ভুল স্মৃতি হলো, এই ফলগুলো ঝুড়ির মতো দেখতে এক ধরনের পাত্রে রয়েছে। বেইনব্রিজ বলেন, আমরা প্রতিদিন অনেকবার ফল দেখি, কিন্তু কখনোই তো ঝুড়ি দেখি না। তাহলে মানুষ এটা কীভাবে মনে রাখল?

এই গবেষণায় এটা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব হয়নি, কোন ধরনের ছবি বা ঘটনা ম্যান্ডেলা ইফেক্টে বেশি ভূমিকা রাখে। তবে বেইনব্রিজ বলেন, সাধারণ এবং সামান্য ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যযুক্ত ছবিগুলো বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকে। গবেষকেরা আরও দেখেছেন, মানুষ যে ভুলগুলো করে, তা অনেক সময় একই রকম হয় এবং সময়ের সঙ্গে তা আরও বেশি দৃঢ় হয়।

ভবিষ্যতে বেইনব্রিজ এই গবেষণার পরিসর বাড়িয়ে খতিয়ে দেখতে চান কোন কোন উপাদান একটি ছবি বা ঘটনাকে স্মরণীয় করে তোলে এবং তা উল্টোভাবে প্রয়োগ করে নতুন ম্যান্ডেলা ইফেক্ট ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা যায় কি না।

এই ভুল স্মৃতি তৈরি হওয়ার পেছনে একটি বড় ভূমিকা রাখে একই ভুল তথ্য বারবার দেখানো বা উপস্থাপন করা। ডার্টমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব ও স্নায়ুবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী প্রসাদ বলেন, আমি মনে করি, যদি কোনো ভুল তথ্য বারবার সত্যের মতো করে উপস্থাপন করা হয়, তাহলে তা ভুল স্মৃতি তৈরি করতে পারে। এমনকি মানুষ নিজের আসল স্মৃতি নিয়েও সন্দেহ করতে শুরু করতে পারে।

ভুল স্মৃতি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

বর্তমানে এআই-জনিত ভুল তথ্য কীভাবে স্মৃতিকে প্রভাবিত করছে, তা নিয়েও গবেষণা চলছে। পোপ ফ্রান্সিসের বালেনসিয়াগা জ্যাকেট পরার ভাইরাল ছবির কথা ধরা যাক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ছবিটি তৈরি। অথচ অনেকে বুঝতেই পারেন না এটি প্রকৃত ছবি নয় বরং নকল একটি ছবি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন বিশ্বাস নিয়ে গবেষণা করা ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক জেন গোলবেক বলেন, হয়তো অনেকেই সেই ছবি দেখে বুঝতেই পারেননি যে, এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় তৈরি। আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে মানুষ জানে তারা প্রতারণার শিকার হতে পারে, তবুও অনেকে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় না।

গোলবেক বলেন, এমন ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার জন্য একাধিক অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যেমন- ভুয়া খবরের নানা ওয়েবসাইটের উত্থান, কোভিড-১৯ মহামারির সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থার অবক্ষয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় তৈরি অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য কনটেন্টের বর্ধন।

তার কথা হলো, এআই-এর ফাঁদে পড়ার ঝুঁকি শুধুমাত্র মানুষের তৈরি ভুল তথ্য থেকেই আসে না, বরং এআই নিজেই এমন কিছু তথ্য তৈরি করতে পারে যা সম্পূর্ণ মিথ্যা বা কাল্পনিক—যাকে বলা হয় এআই হ্যালুসিনেশন।

যারা নিজেদের এআইয়ের তৈরি ছবি শনাক্ত করতে দক্ষ মনে করেন, তারাও এখন বিভ্রান্ত হচ্ছেন। গবেষক ওবারস্ট বলেন, আমাদের মস্তিষ্ক সাধারণত কোনো কনটেন্টের উৎসের তথ্য দ্রুত ভুলে যায়। অর্থাৎ, আমরা হয়তো ভুল এআই ছবিটি মনে রাখতে পারি, কিন্তু ভুলে যেতে পারি যে সেটি অবিশ্বাসযোগ্য ছিল।

এখনও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নতুন ও দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি হওয়ায় এর ভবিষ্যৎ ঝুঁকি সম্পর্কে গবেষকরা নিশ্চিত নন। তবে তারা জানতে আগ্রহী, এআই কীভাবে ব্যক্তিগত ভুল স্মৃতি এবং ম্যান্ডেলা ইফেক্টের মতো ঘটনার সৃষ্টি করতে পারে।

গবেষক ওবারস্ট ও প্রসাদ—দুজনই জানতে চান, ভুল এআই ছবি যদি কারও বিশ্বাস বা মতাদর্শকে তুলে ধরে, তবে সেটি আরও সহজে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে কি না। অন্যদিকে গোলবেক জানতে চান, এআই কি ভুল স্মৃতিকে আরও প্রকট করতে পারে?

সব গবেষক একমত, মস্তিষ্ক, ছবি ও এআইইয়ের মধ্যে সম্পর্ক কতটা গভীর তা বোঝার জন্য দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা দরকার। তবে এখনই আমাদের কী করা উচিত—এই প্রশ্নে গোলবেক বলেন, নিজেকে রক্ষা করতে হলে বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিদের ওপর নির্ভর করতে হবে।

তার মতে, আশেপাশে এমন একটি নির্ভরযোগ্য জনগোষ্ঠী তৈরি করা জরুরি, যাদের আপনি বিশ্বাস করেন। যেমন— সাংবাদিক, বিজ্ঞানী বা রাজনীতিক, যারা তথ্য যাচাই করে করে প্রচার করেন। যাচাই করা তথ্য অনেকের পছন্দ নাও হতে পারে। তবে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক অবলম্বনে লিখেছেন বাংলানিউজের সিনিয়র নিউজরুম এডিটর রকিবুল সুলভ।

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।