ঢাকা, শনিবার, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২, ০২ আগস্ট ২০২৫, ০৭ সফর ১৪৪৭

ফিচার

কেন মৃত্যুচিন্তা আমাদের ভাবনায় পরিবর্তন আনে?

মূল লেখা: জনাথন জং। ভাষান্তর: রকিবুল সুলভ  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০:১০, আগস্ট ১, ২০২৫
কেন মৃত্যুচিন্তা আমাদের ভাবনায় পরিবর্তন আনে?

লেখাটি পড়তে গিয়ে আপনার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ-অপছন্দ বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ধরনে সাময়িক পরিবর্তন আসতে পারে। ভেতরে হঠাৎ করে হয়তো খ্যাতির আকাঙ্ক্ষাও জেগে উঠতে পারে।

কেন? কারণ মৃত্যুর চিন্তা মানুষের ভাবনায় একধরনের মৌলিক আলোড়ন তোলে।

মানুষ যখন মৃত্যুর কথা ভাবে, তখন মনে ক্ষণস্থায়ী জীবনের অনুভূতি জাগে। তা বাড়তি নিরাপত্তা খোঁজার, অর্থপূর্ণ কিছু করার বা সমাজে নিজের ছাপ রেখে যাওয়ার দিকে ঠেলে দেয়। রাজনীতি, বিশ্বাস, পছন্দ কিংবা লক্ষ্য পরিবর্তন হওয়া তাই তখন অস্বাভাবিক নয়।  

মৃত্যু নিয়ে আলোচনা অনেক সময় সমাজে ট্যাবু হিসেবে দেখা হয়। তবে এখন এই ভাবনা বদলাতে শুরু করেছে। গত কয়েক বছরে মানুষ চেষ্টা করছে ঘরে-বাইরে মৃত্যু নিয়ে খোলামেলা কথা বলার ।

এই চিন্তারই একটা দারুণ উদাহরণ দেওয়া যাক ‘ডেথ ক্যাফে’ দিয়ে। ২০০৪ সালে সুইজারল্যান্ডে শুরু হওয়া উদ্যোগটি পরবর্তীতে অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে মানুষ কেক আর কফি খেতে খেতে মৃত্যুর ভয় আর ভাবনা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে। এতে ভয় খানিকটা কমে আসে, আর মৃত্যুকে বোঝা সহজ হয়ে ওঠে।

আমরা মৃত্যুর কথা বলতে চাইলেও অনেক সময় সরে আসি। ধরে নেওয়া হয় আমরা তা নিয়ে ভয়ে আছি আর চিন্তাকে চাপা দিচ্ছি। কিন্তু এমন ধারণার সরাসরি প্রমাণ খুব কমই আছে। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, মৃত্যুভীতির স্বাভাবিক মাত্রা কতটা? কীভাবে আমাদের মধ্যে তা প্রকাশ পায়?

গবেষণায় দেখা গেছে, আমরা নিজের মৃত্যু নিয়ে ভাবার চেয়ে প্রিয়জনকে হারানোর ভয়ে বেশি উদ্বিগ্ন থাকি। মৃত্যুর সময়কার যন্ত্রণার ব্যথা ও একাকিত্বের চিন্তাই আমাদের বেশি কষ্ট দেয়।  

যখন মানুষকে সরাসরি জিজ্ঞেস করা হয় ‘আপনি কি মরার ভয় পান?’ অধিকাংশ মানুষ সেটা অস্বীকার করেন এবং বলেন তাদের ভয় খুব কম। কিন্তু যারা বেশি মাত্রায় মৃত্যুভয় প্রকাশ করেন,  তাদের মানসিকভাবে অস্বাভাবিক বা ‘থানাটোফোবিক’ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

মৃত্যু নিয়ে ভয়ে থাকলেও আমরা সেটা স্বীকার করতে চাই না। না নিজের কাছে, না অন্যদের সামনে। এজন্য অনেকে নিজেদের মৃত্যুভীতি কম বলে জানায়। ধারণাটি নিয়ে সামাজিক মনোবিজ্ঞানীরা গত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে গবেষণা চালাচ্ছেন। তারা ২০০টির বেশি পরীক্ষায় মানুষকে নিজেদের মৃত্যুর কথা কল্পনা করতে বলেছেন, যেন বুঝতে পারেন মৃত্যুর ভয় মন ও আচরণে কী প্রভাব ফেলে।

এই ধরনের প্রথম পরীক্ষা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বিচারকের ওপর করা হয়। তাদের এক কল্পনাপ্রসূত ঘটনায় একজন নারীকে জামিন দিতে বলা হয়। যারা আগে নিজেদের মৃত্যুর কথা ভেবেছিলেন, তারা অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি জামিনের অর্থ নির্ধারণ করেন, যা গড়ে ৪৫৫ ডলার। আর যারা ভাবেননি তারা মাত্র ৫০ ডলার নির্ধারণ করেন। এরপর আরও অনেক দেশের মানুষের ওপর এমন আরও পরীক্ষাও করা হয়েছে।

মৃত্যুর চিন্তা শুধু আমাদের শাস্তিমূলক মনোভাব বাড়ায় না, বরং আমাদের জাতীয়তাবাদী প্রবণতাও জোরদার করে। এটা আমাদের অন্য জাতি, ধর্ম ও বয়সের মানুষের প্রতি পক্ষপাতমূলক মনোভাব বাড়ায় এবং আরও অনেক সীমাবদ্ধ চিন্তার জন্ম দেয়। গবেষণায় দেখা যায়, মৃত্যুর চিন্তা আমাদের নিজেদের গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করে, কিন্তু এর ফলে গোষ্ঠী-ভিন্নদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি সংকীর্ণ হয়ে যায়।

মৃত্যুর চিন্তা আমাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসেও গভীর প্রভাব ফেলে। একদিকে এটি আমাদের মতাদর্শকে আরও ধারালো করে তোলে। রাজনীতিতে উদারপন্থীরা আরও উদার হয়ে ওঠে, আর রক্ষণশীলরা আরও কঠোর। তেমনি, ধর্মে বিশ্বাস করা লোকেরা তাদের বিশ্বাস আরও শক্তভাবে প্রকাশ করে, আর ধর্মনিরপেক্ষরা তাদের বিশ্বাস থেকে দূরে সরে যায়।

গবেষণায় দেখা গেছে, মৃত্যু নিয়ে ভাবনা ধর্মীয় হোক বা না হোক, অনেক সময় অজান্তেই আমাদের ধর্মবিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করে। যখন মৃত্যুর চিন্তা বেশ তীব্র হয় এবং মানুষ তাদের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে সচেতন থাকে না, তখন উদারপন্থী এবং রক্ষণশীল উভয়েই বেশি করে রক্ষণশীল মতাদর্শ ও প্রার্থীদের সমর্থন করে। কিছু গবেষক মনে করেন, এ কারণেই ৯/১১ পরবর্তী সময়ে আমেরিকার রাজনৈতিক দিক ডানপন্থায় সরে গিয়েছিল।

এই ব্যাখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গবেষকরা আরও দেখেছেন, মৃত্যুর চিন্তা মানুষের মধ্যে খ্যাতি অর্জনের ইচ্ছা এবং সন্তানের প্রতি আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে দেয়। কারণ এই দুইয়ের মাধ্যমেই মানুষ প্রতীকী অর্থে অমরত্ব লাভ করতে চায়। মানুষ কাজ, সফলতা বা সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজে নিজের ছাপ রেখে যেতে চায়, আর সন্তানের মাধ্যমে নিজের জিন ভবিষ্যৎ প্রজন্মে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। তাই মৃত্যুর স্মৃতি মানুষের এমন অন্তর্নিহিত চাহিদাকে জাগ্রত করে, যা আসলে চিরস্থায়িত্বের তাগিদ বহন করে।

যখন কেউ আমাদের জিজ্ঞেস করে, আমরা প্রায়ই নিজেরাই বিশ্বাস করি না যে আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই। আমরা কল্পনাও করতে পারি না যে মৃত্যুর কথা ভাবা আমাদের সামাজিক মনোভাবের ওপর এত বিস্তৃত প্রভাব ফেলতে পারে। আমাদের নিজের অন্তর্দৃষ্টির ক্ষমতায় সীমাবদ্ধতা আছে।  আমরা সাধারণত খুবই খারাপভাবে ভবিষ্যতের কোনো পরিস্থিতিতে কেমন অনুভব করব বা আচরণ করব তা আন্দাজ করতে পারি না, ঠিক তেমনি নিজের অনুভূতির কারণ বা কোনো নির্দিষ্ট আচরণের পেছনের কারণ বুঝতেও আমরা কম সক্ষম। তাই, আমরা চাই বা না চাই, মনে হয় মৃত্যুর কথা মনে আনা মানে একপ্রকার প্যান্ডোরার বাক্স খোলা, যা নতুন নতুন ভাবনা, ভয় এবং পরিবর্তনের জন্ম দেয়।

তাহলে আমরা সেসব নতুন উদ্যোগগুলোকে কীভাবে নেব, যেগুলো মৃত্যু নিয়ে আলাপকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে? এই প্রশ্নের উত্তর জটিল। গবেষণায় দেখা গেছে, যখন আমরা ব্যক্তিগত বা সামাজিক জীবনে মৃত্যুর কথা বেশি ভাবতে থাকি, তখন আমরা একটু বেশি কঠোর এবং অন্যদের নিয়ে পক্ষপাতী হয়ে যেতে পারি। কিন্তু হয়তো এসব নেতিবাচক দিক ফুটে ওঠার কারণ আমরা এতদিন মৃত্যুর কথা ভাবতে বা কথা বলতে অভ্যস্ত ছিলাম না।  

‘এক্সপোজার থেরাপি’তে রোগীদের ভয়ের উৎস—যা হতে পারে কোনো বস্তু, প্রাণী বা স্মৃতি সামনে এনে ভয় কমানো হয়। একইভাবে মৃত্যু নিয়ে কথাবার্তা বা আলোচনার নতুন প্রবণতাও হয়তো আমাদের মানসিকভাবে শক্ত করে তুলবে এবং মৃত্যুর মুখোমুখি হতে সাহায্য করবে।

আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।