ঢাকা, বুধবার, ১২ আষাঢ় ১৪৩২, ২৫ জুন ২০২৫, ২৮ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

কবি ও যোদ্ধার দেশ ইরান

ফেরদৌস হাসান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:০৫, জুন ২৪, ২০২৫
কবি ও যোদ্ধার দেশ ইরান হাফিজের সমাধি। ছবি: সংগৃহীত

ইরান এমন এক দেশ, যেখানে গজলের সুর, কবিতা ছন্দ আর যুদ্ধের দামামা যুগপৎভাবে ধ্বনিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যের এই প্রাচীন ভূখণ্ড শুধু যুদ্ধবিগ্রহ কিংবা রাজনৈতিক উত্তেজনার জন্য পরিচিত নয়।

বরং এটি একটি সমৃদ্ধ সভ্যতার ধারক, সাহিত্যের পীঠস্থান এবং আত্মমর্যাদায় বলীয়ান জাতির প্রতিচ্ছবি।

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গড়ে ওঠা পার্সিয়ান সাম্রাজ্য ছিল পৃথিবীর প্রথম বৃহৎ সাম্রাজ্যগুলোর একটি। ‘সাইরাস দ্য গ্রেট’র হাত ধরে এই সাম্রাজ্য শুরু হয়, যা একসময় ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে শুরু করে গ্রিস পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

কবির দেশ, কবিতার দেশ

ইরানিদের আত্মপরিচয়ের ভিত্তি গড়ে উঠেছে তাদের সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতার ওপর। ফেরদৌসি, আল্লামা হাফিজ, ওমর খৈয়াম ও জালালুদ্দিন রুমির মতো কবিদের সৃষ্টি আজও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠ করা হয়। গজল/কবিতায় তারা প্রেম, ধর্ম, দর্শন, মরমিবাদ, ঈশ্বর, রাজনীতি এমনকি যুদ্ধও ধারণ করেছেন।

বাদাহ্ সাকি ম্যায় বাকি কে দর্ জান্নাত না খাহি য়াফত।
কানার-ই-আব-ই রুকনাবাদ ও গুলগশত-ই-মসল্লা রা। ।

মরমি কবি আল্লামা হাফিজ সিরাজীর কবিতা এতটাই জনপ্রিয় যে, ইরানের ঘরে ঘরে পবিত্র কোরআনের মতোই তার কাব্যগ্রন্থ দেখা যায়। ‘দিওয়ান-ই-হাফিজ’ (হাফিজের কাব্যগ্রন্থ) ইরানিদের সংস্কৃতি ও সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

কোন বিরহের তীব্র সুরা পান করিলে কবি?
পেয়ালা মাঝে জাগল কাহার দীপ্ত মুখের ছবি!
ছন্দেতে কার পায়ের নূপুর বাজল তালে তালে—
কণ্ঠটী কার জড়িয়ে এল তোমার সুরের জালে!

ইরানিদের নিত্যদিনের সঙ্গী গজল বা কবিতা। কেউ প্রেমে পড়লে হাফিজ পড়েন, যদি কেউ বিষাদগস্ত হন তবে তিনি ওমর খৈয়াম পড়েন। আবার সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান আয়োজনেও কবিতা/গজলের উদ্ধৃতি উচ্চারিত হয়। একজন ইরানি সন্তান শৈশব থেকেই রুমির ছন্দে গড়ে ওঠে এবং কৈশরে ইতিহাস পাঠের পাশাপাশি কাব্যের গূঢ়রস আস্বাদন করে।

কিন্তু কেবল কবিতা দিয়ে ইরানকে চেনা অসম্পূর্ণ। কারণ এই জাতি বীরের জাতি, তারা যুদ্ধেও পারদর্শী, প্রতিরোধে অনমনীয় এবং আত্মমর্যাদার প্রশ্নে আপসহীন।

আত্মরক্ষার দীর্ঘ ইতিহাস

যুদ্ধ আর প্রতিরোধের এক দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েছে ইরান। সপ্তম শতাব্দীতে আরবদের ইসলামি বিজয়ের পর পারস্যের ধর্মীয় পরিচয় বদলালেও, তাদের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বৈশিষ্ট্য অটুট থাকে। ইরানিরা তাদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সমুন্নত রাখে।

আরেক বড় দৃষ্টান্ত ইরান-ইরাক যুদ্ধ (১৯৮০-১৯৮৮)। আট বছরব্যাপী এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ইরান বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়লেও আত্মসমর্পণ করেনি। ইরানের জনতা, বিশেষ করে তরুণরা শহীদ হওয়ার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন। তাদের এই প্রতিরোধ ‘দেফা এ মাক্বাদ্দাস’ বা পবিত্র প্রতিরোধ হিসেবে পরিচিত। এই যুদ্ধ ইরানিদের মানসিকতা গড়ে দিয়েছে, প্রতিটি নাগরিককে গড়ে তুলেছে একেকজন সম্ভাব্য যোদ্ধা হিসেবে।

আধুনিক ভূরাজনীতি ও সামরিক বাস্তবতা

ইরান বর্তমানে বিশ্ব রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তার সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ। পারমাণবিক কর্মসূচি, ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের সমর্থন দেওয়া, সিরিয়ায় ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং হিজবুল্লাহর মতো গোষ্ঠীকে সহায়তা দেওয়ায় ইরান বরাবরই প্রতিবেশী আরব দেশ ও পশ্চিমা বিশ্বের আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।

তবে ইরান বরাবরই বলেছে, তারা প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে আছে। তাদের সামরিক শক্তির মূল ভিত্তি হলো দেশপ্রেমে জাগ্রত হয়ে প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের সামর্থ্য। ইসলামি বিপ্লবী গার্ড (আইআরজিসি) এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রধান চালিকাশক্তি, যারা শুধু দেশের সীমান্ত নয়, আদর্শিক ও কৌশলগত লক্ষ্যেও কাজ করে।

কবি ও যোদ্ধা

ইরানের একজন সাধারণ নাগরিকেরও দরাজ গলায় যেমন উঠে আসে হাফিজের কবিতা, তেমনি যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অস্ত্র হাতে নিতেও সে পিছপা হয় না। এটি ইরানি জাতির বৈশিষ্ট্য, তারা তাদের সংস্কৃতি ও ভূখণ্ডের প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং দায়িত্ববোধে সদা সচেতন।

ইরান একদিকে যেমন মহাকবি ফেরদৌসির কাব্যে গর্বিত, অন্যদিকে শহীদের রক্তে উজ্জীবিত। ইরানের নাগরিকদের এই দ্বৈত পরিচয়েই গড়ে উঠেছে ইরানের জাতিসত্তা।

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।