মৌলভীবাজার: প্রাকৃতিক বন মানেই জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব রক্ষার আবাসন। নানা প্রজাতির বন্য প্রাণীরা যেখানে তাদের টিকে থাকার নিরাপত্তাটুকু খুঁজে পায়।
বনের প্রাণ-ই হলো বৃক্ষরাজি। নানা প্রজাতির গাছগাছালিতে ঠাসা যে বন সেটাই জানান দেয় বনের সুস্বাস্থ্যের দিকটি। এ আসন্ন বর্ষা মৌসুমে বন ভ্রমণে গেলে যদি জোঁকের আক্রমণ পর্যটকদের পায়ে রক্তান্ত করে তবেই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, বন টিকে আছে ঠিক তার মতো করে। নানা কারণে কোনো বনের যদি বৃক্ষ ধ্বংস হয় তবে তার সহজে পূরণ হয় না। এ ক্ষেত্রে পাঁচ, দশ কিংবা আরো বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়। একটি প্রাকৃতিক বনের বৃক্ষ তার পূর্ণতা নিয়ে চির সবুজ বনের মাঝে মাথা তুলে দাঁড়াতে বেশ কয়েকটা বছর লেগে যায়।
কিন্তু একদিকে সংরক্ষিত বনের ঘোষণা অন্যদিকে টিকেটের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যাক পর্যটকদের বনভ্রমণে সুযোগ করে দেওয়া এই দুইটি সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্ত। এ যেন দু’ কদম এগিয়ে গিয়ে আবার চার কদম পিছিয়ে পড়ার সামিল! লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানসহ অন্যান্য বনের চিত্র এমনই!
লাউয়াছড়ার সবচেয়ে মূল্যবান বন্যপ্রাণী উল্লুক (Hoolock Gibbons)। আইইউসিএন, বাংলাদেশ এর গবেষণা অনুযায়ী এটি রেডলিস্টভুক্ত ‘মহাবিপন্ন প্রাণী’। অর্থাৎ ওরা খুব বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে আমাদের দেশে। বৃহত্তর সিলেট বিভাগের অন্যতম প্রাকৃতিক বন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে উল্লুকের কয়েকটি পরিবার এখনো মোটামুটিভাবে টিকে আছে।
উল্লুক মানুষের মতোই পরিবারভুক্ত বা পরিবারকেন্দ্রীয় বন্যপ্রাণী। একটি পরিবারে মা ও বাবা উল্লুকসহ তিন-চারটি বা এর বেশিও উল্লুক থাকতে পারে। এরা উঁচু গাছের মাথায় থাকতে পছন্দ করে। পুরুষ উল্লুকের শরীরের রং কালো এবং স্ত্রী উল্লুকের শরীরের রং ধূসর-বাদামি। লম্বা হাত ও পায়ের সাহায্যে এরা এক গাছ থেকে আরেক গাছে যাওয়া-আসা করে। নিজেদের আপন আপন এলাকা থেকে উচ্চস্বরে শব্দ করে এরা পরিবারের সদস্যদের অবস্থান জানান দিয়ে থাকে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. হাবিবুন নাহার বাংলানিউজকে বলেন, পৃথিবীব্যাপী ‘বিপন্ন’ এবং বাংলাদেশে ‘মহাবিপন্ন’ এক প্রাণী উল্লুক। নানা বৈশিষ্ট্যের কারণে এরা বানরের থেকে অধিকতর উন্নত এবং পুরোপুরিভাবে বৃক্ষচারী প্রাণী। আবাসস্থল ধ্বংস, বনের উঁচু বৃক্ষের অভাব, প্রয়োজনীয় বুনো ফল-লতাপাতা সহ প্রাকৃতিক খাদ্য সংকট প্রভৃতি নানা কারণে বাংলাদেশ থেকে এরা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে উল্লুকের সংখ্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উল্লুকের বসবাসের জন্য ঘন ও উপযুক্ত বনের প্রয়োজন যা একমাত্র দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলেই আছে। বাংলাদেশের সমস্ত বনভূমি অত্যন্ত ধ্বংসের মুখে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বাংলাদেশের বনভূমিতে উল্লুখের সংখ্যা এবং অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। ২০০৬ থেকে ২০২০ এর মধ্যে যেহেতু বাংলাদেশের বনভূমি অনেক হ্রাস পেয়েছে তাই আমরা স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করছি উল্লুকের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।
সর্বশেষ তথ্য এ অধ্যাপক বলেন, ২০০৩ সালে দাস ও তার দল বাংলাদেশে উল্লুকের অবস্থানের বিষয়ে দেশে ১৪টি স্থানের কথা উল্লেখ করেছেন। ২০০৮ সালে ইসলাম ও তার দল দেশে ৩৫টি স্থান নির্বাচন করে ২৫টি স্থানে উল্লুকের অবস্থান নিশ্চিত করেছেন। ২০০৯-২০১০ সালে দেশের ২২টি স্থান পরিমার্জন করা হয় এবং বাকি ৩টি বনভূমি অত্যন্ত হ্রাস পাওয়ায় উল্লুকের অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
২০১৯ সালে ওই দেশে ২২টি স্থানের ওপর জরিপ করে ১৩৫টি পরিবারের প্রায় মোট ৪৬৮টি উল্লুক রেকর্ডভুক্ত করা হয়েছে বলে জানান ড. হাবিবুন।
বিবিবি/জেএইচ