ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ ভাদ্র ১৪৩২, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

নির্বাচন ও ইসি

খুলনা-৪ আসনে বিএনপির তিন হেভিওয়েট নেতা, অন্যান্য দলে একক প্রার্থী

মাহবুবুর রহমান মুন্না, ব্যুরো এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৪৯, সেপ্টেম্বর ৩, ২০২৫
খুলনা-৪ আসনে বিএনপির তিন হেভিওয়েট নেতা, অন্যান্য দলে একক প্রার্থী

খুলনা: ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগেই অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে সরকার। যে কারণে দেশের অন্যান্য আসনের মতো খুলনা-৪ আসনেও নির্বাচনী উত্তাপ বাড়তে শুরু করেছে।

নির্বাচনী সমীকরণ ঘিরে প্রধান দলগুলোর মনোনয়ন প্রত্যাশীরা এরই মধ্যে মাঠে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।

এ আসনে বিএনপির ৩ হেভিওয়েট নেতা মনোনয়ন পাওয়ার আশার দৌড়ঝাঁপ করছেন। অপরদিকে আসনটিতে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিসের একক প্রার্থী নির্দিষ্ট হয়েই আছে। এই নেতারা নির্বাচনী এলাকায় ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার লাগানো শুরু করেছেন। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সক্রিয়ভাবে প্রচারণা চালাচ্ছেন তাদের অনুসারীরা। সাধারণ ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কুশল বিনিময় ও শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি নিজ অবস্থান তুলে ধরছেন কেউ কেউ। তবে এ আসনে ভোটের মাঠে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জাতীয় পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন ও সিপিবির কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

খুলনা-৪ আসন:
খুলনা-৪ আসন রূপসা, তেরখাদা ও দিঘলিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত। এটি জাতীয় সংসদের ১০২ নম্বর আসন।  

খুলনা জেলা নির্বাচন অফিসের চলতি বছরের মার্চ মাসের তথ্য মতে, এ আসনটিতে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৬৬ হাজার ১৯৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৪৮, নারী ভোটার ১ লাখ ৮২ হাজার ৬৪৮ ও হিজড়া ভোটার ২ জন।

খুলনা-৪ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী যারা:
বিএনপির একাধিক নেতা মনোনয়নের প্রত্যাশায় তৎপর হয়ে উঠেছেন। তারা হলেন– ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও কেন্দ্রীয় বিএনপির তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, যুক্তরাজ্য বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ পারভেজ মল্লিক ও কেন্দ্রীয় বিএনপির সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক শরীফ শাহ কামাল তাজ।

এ আসনে জামায়াতের একক প্রার্থী খুলনা জেলা নায়েবে আমির অধ্যক্ষ মাওলানা কবিরুল ইসলাম। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের একক প্রার্থী রয়েছেন কেন্দ্রীয় মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ। আর খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন এবারও প্রার্থী হবেন।

সম্ভাব্য প্রার্থীরা যা বলছেন:
ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি আজিজুল বারী হেলালের নামে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে শতাধিক মামলা ছিল। এসব মামলায় তিনি জেল খেটেছেন ও নির্যাাতিত হয়েছেন। ২০০৮ সালে আজিজুল বারী হেলাল ঢাকা-১৮ থেকে নির্বাচন করে হেরে যান।

কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল বাংলানিউজকে বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ২০৪টি মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলা দিয়েছিল আমার বিরুদ্ধে। ৫ আগস্টের পর অনেক মামলা থেকে নিষ্পত্তি পেয়েছি। এখনো অনেক মামলা রয়েছে।

নির্বাচনের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে হেলাল বলেন, আমরা আমাদের দলের সাংগঠনিক অবস্থা মজবুত করার চেষ্টা করছি। দলকে আরো বেশি সুসংগঠিত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি । সাথে সাথে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা ও চালাচ্ছি।

২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে কেন্দ্রীয় বিএনপির সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক শরীফ শাহ কামাল তাজ বিএনপির প্রার্থী হয়ে হেরে যান। পরাজয়ের পর বেশ কয়েক বছর এলাকায় সাংগঠনিক কাজে অংশ নিলেও গত কয়েক বছর খুলনায় তার কোনো তৎপরতা নেই। আবার আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী এলাকায় বেশ তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

কেন্দ্রীয় বিএনপির সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক শরীফ শাহ কামাল তাজ বাংলানিউজকে বলেন, বিগত দিনে রূপসা, তেরখাদা ও দিঘলিয়া উপজেলার মানুষের সুখে দুঃখে- পাশে ছিলাম। আগামী দিনগুলোতেও থাকতে চাই। দল যদি মনে করে আমাকে নমিনেশন দেয় তাহলে আমি নির্বাচন করতে প্রস্তুত। দলীয় সিদ্ধান্তই আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।

খুলনার তেরখাদা অঞ্চলের সন্তান, জিয়া পরিবারের বিশ্বস্ত, সাবেক ছাত্রনেতা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের একাধিকবার নির্বাচিত সভাপতি, সাবেক স্বেচ্ছাসেবক দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, বর্তমান যুক্তরাজ্য বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক পারভেজ মল্লিক। তিনি এ আসনে নির্বাচনে অংশ নিতে সচেষ্ট রয়েছেন।

যুক্তরাজ্য বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পারভেজ মল্লিক বাংলানিউজকে বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরপর দুই মেয়াদে ছাত্রদলের সভাপতি ছিলাম। পরে কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করি। প্রবাসে থেকেও বিগত বছরগুলোতে দেশের মানুষের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য কাজ করেছি। বিগত নির্বাচনগুলোতে বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছি। নিজের এলাকার দরিদ্র মানুষকে আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা করেছি। বিশেষ করে মহামারি করোনাকালীন সময়ে। এলাকার মানুষ যদি চায় তাহলে আমি নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুত আছি। দল যদি মনে করেন আমি যোগ্য তাহলে আমি একজন মনোনয়ন প্রত্যাশী। দল যদি বিবেচনা করে আমাকে নমিনেশন দেয় তাহলে জয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী।

খুলনা-৪ আসনে জামায়াতের একক প্রার্থী খুলনা জেলা নায়েবে আমির অধ্যক্ষ মাওলানা কবিরুল ইসলাম। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর এ আসনের জামায়াত শিবিরের নেতারা বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। নতুন করে উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে দলীয় কার্যালয় চালু করা হয়েছে। প্রতিদিন নির্বাচনী এলাকায় সভা সমাবেশ করছেন জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা কবিরুল ইসলাম।

নির্বাচনের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। প্রস্তুতি চলছে। আসনভিত্তিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে বৈঠক হচ্ছে। সমাবেশ হচ্ছে।

সাধারণ মানুষ ইসলামের সাথে আছে জামাতের সাথে আছে এমন মন্তব্য করেন তিনি।

মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমীর। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের বৃহৎ অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর এবং হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ খুলনা মহানগরীর সভাপতির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নির্বাচনের মাঠে তিনি নতুন নন। এর আগে ১৯৯১-৯৬ সালে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং সম্মানজনক ভোট পান। এবার তার দল খেলাফত মজলিসের যে কয়টি আসনে নির্বাচনের জোরালো দাবি তুলেছে তার মধ্যে খুলনা-৪ অন্যতম।

খুলনাসহ জাতীয় অঙ্গনে অত্যন্ত পরিচিত মুখ সাখাওয়াত হোসাইন। বিশেষত ইসলামী অঙ্গনে ব্যাপকভাবে পরিচিত। ফ্যাসিবাদবিরোধী সকল আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পাশাপাশি দেশে এবং বিদেশে ইসলামবিরোধী সকল কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।

তার বড় সন্তান হাফেজ মাওলানা আব্দুল্লাহ যোবায়ের গত তিনবারের রূপসা উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন।

আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন বলে বাংলানিউজের কাছে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।  

মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বারবার রোষানলের শিকার হয়ে কারাবরণ করেছি। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বর কেন্দ্রিক ঐতিহাসিক নাস্তিক বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখার দায়ে ১৬টি মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। কোন দিন হাজিরা দেওয়া লাগেনি। নিষ্পত্তিও হয়নি। ওভাবেই পড়ে আছে। ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হলেও এখন পর্যন্ত মিথ্যা মামলাগুলো নিষ্পত্তি হয়নি। এমন মামলা হেফাজতের অনেকের নামেই আছে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটির ইউনিয়ন থেকে জেলা শাখার দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা সময় থেকে যুক্ত ছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি এই দলের মহাসচিব নির্বাচিত হন। এলাকায় তার দলের একটি অনুসারীর সংখ্যা কম নয়।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বাংলানিউজকে বলেন, খুব তাড়াতাড়ি আগামী নির্বাচনের জন্য ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী ঘোষণা করা হবে। আমি আশাবাদী, আমাকে প্রার্থী করা হবে। আমার প্রস্তুতিও রয়েছে।

খুলনা-৪ আসনের বিগত নির্বাচনের ফলাফল:
এ আসনে ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের শেখ আব্দুল আজিজ, ১৯৭৯ সালে আব্দুল লতিফ খান, ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির শেখ সহিদুল ইসলাম, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির মোক্তার হোসেন নির্বাচিত হন।

১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের মোস্তফা রশিদী সুজা ৪১,৬৯৩ ভোট পেয়ে, ১৯৯৬ সালে আবারও আওয়ামী লীগের মোস্তফা রশিদী সুজা ৫৬,৫৬৬ ভোট পেয়ে, ২০০১ সালে বিএনপির এম নুরুল ইসলাম ১,০২,৯৫৭ ভোট পেয়ে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মোল্লা জালাল উদ্দিন ১,০৯,২১৬ ভোট পেয়ে নির্চাবিত হয়েছে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মোস্তফা রশিদী সুজা, ২০১৮ সালের উপ-নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচনে আব্দুস সালাম মুর্শেদী, ২০২৪ সালেও আব্দুস সালাম মুর্শেদী নির্বাচিত হন।

এমআরএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।