ঢাকা: আদালতের রায়ের ভিত্তিতে প্রতীকসহ ‘দ্রুত’ নিবন্ধন ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এক্ষেত্রে ‘একটু সময়’ নিতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
রোববার (১ জুন) আপিল বিভাগ ২০১৩ সালে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে দেওয়া হাইকোর্টের রায়কে বাতিল করে নির্বাচন কমিশনকে নিবন্ধন ফিরিয়ে দেওয়াসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার নির্দেশনা দেন। এর প্রেক্ষিতে সোমবার (২ জুন) জামায়াতের একটি প্রতিনিধি দল ইসির সঙ্গে প্রায় দেড়ঘণ্টা বৈঠক করে।
বৈঠকের পর দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, আদালত গতকাল রায়ে ২০১৩ সালের রায়ের পূর্বে নিবন্ধন যে অবস্থায় ছিল, সে অবস্থা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আদেশ দিয়েছেন। আমরা সেজন্য ফুল কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছি৷ বৈঠকে রায় বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা করেছি৷ তারা ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। কমিশন যেন রায় দ্রুত বাস্তবায়ন করে সে আশা করি। প্রতীক ও নিবন্ধন দুটোর বিষয়েই কমিশন ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে।
এদিকে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের দিন বিকেলে ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, রায়ের কপি পেলেই আমরা সিদ্ধান্ত নেবো। কিন্তু কপি পাওয়ার পর এবং দলটির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকের পরেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি ইসি।
নিবন্ধনের ও প্রতীকের বিষয়ে তাড়াহুড়ো করার পক্ষে নয় সংস্থাটি। ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, এখনো আদালতের আদেশ কমিশনের কাছে নথি আকারে উপস্থাপন করা হয়নি। নথি উপস্থাপনের পরেই সিদ্ধান্ত আসবে। এক্ষেত্রে প্রতীক হিসেবে ‘দাঁড়িপাল্লা’ দেওয়ার বিষয়ে আইনি জটিলতা আছে কি-না সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে। আর এই কাজ সম্পন্ন করতে ঈদের আগে বিষয়টি সুরাহা হওয়ার কোনো আভাস দেখছেন না তারা।
আগামী ৭ জুন ঈদুল আজহা উদযাপন হবে। ১০ দিনের সরকারি ছুটি শুরু হবে বৃহস্পতিবার (৫ জুন) থেকে। মাঝে কর্মদিবস আছে আর দু’দিন। এই সময়ের মধ্যে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে আদালতের রায় বাস্তবায়নে গড়িমসির কোনো কারণ না থাকলেও কিছুটা সময়ের প্রয়োজন বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
ইসি সচিব আখতার আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, আজ সিদ্ধান্ত হয়নি। আমরা তাড়াতাড়ি করছি। তবে সুপারসনিক গতিতে তো হবে না। একটু সময় লাগবে। ওনারা এসে কাজগপত্র দিয়ে গেছেন। একটা ব্যবস্থা তো আমাদের নিতে হবে। কমিশন তো একটা ব্যবস্থা নেবে। এক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয় বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের মতামত যদি নিতে হয়, সেটার সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন। কমিশনে ফাইলটা যাক। মতামত নেওয়ার কথা বললে চিঠি দিয়ে দেবো।
১৯৮৬ সালে তৃতীয় সংসদ থেকে পরবর্তী প্রায় সবগুলো নির্বাচনেই দাঁড়িপাল্লা প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছিল জামায়াত। এরপর বিতর্কিত ওয়ান-ইলেভেন সরকার রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের বিধান চালু করে। ২০০৮ সালে নিবন্ধন পায় জামায়াতে ইসলামী। নিবন্ধিত দল হিসেবে ওই বছরের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে অংশ নিয়ে দু’টি আসনে জয় পায় দলটি।
তবে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির তৎকালীন মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। তাদের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে রিটে উল্লেখ করা হয়।
এরপর ২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতকে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে অবৈধ বলে রায় দেন বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন (বর্তমানে অবসর), বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম (পরে আপিল বিভাগের বিচারপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন) ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হকের (১৯ নভেম্বর পদত্যাগ করেন) সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর (লার্জার) বেঞ্চ।
সে সময় সংক্ষিপ্ত রায়ে আদালত বলেন, এ নিবন্ধন দেওয়া আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত। তবে আদালত জামায়াতে ইসলামীকে আপিল করারও অনুমোদন দিয়ে দেন। এ রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে জামায়াতের করা আবেদন একই বছরের ৫ আগস্ট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। ওই বছরের ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে। তবে জামায়াতের আইনজীবীর অনুপস্থিত থাকায় ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর জামায়াতের আপিল খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।
এর মাঝে ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টে এক প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে নির্বাচন কমিশনকে প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা বরাদ্দ না দিতে এবং কাউকে প্রতীক দিয়ে থাকলে তা বাতিল করতে চিঠি দেয়। নির্বাচন কমিশন সেই চিঠির প্রেক্ষিতে প্রথমে স্থানীয় নির্বাচন ও পরে ২০১৭ সালে জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা সংশোধন করে প্রতীকের তালিকা থেকে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকটি বাদ দিয়ে দেয়। এরপর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলটির নিবন্ধন সনদও বাতিল করে ইসি।
অন্যদিকে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের সময় আওয়ামী লীগ সরকার অঙ্গসংগঠনসহ দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে সরকার পতনের পর ২৮ আগস্ট জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণার আগের নির্বাহী আদেশ বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার।
এরপর ২০২৩ সালে খারিজ হওয়া আপিলটি পুনরুজ্জীবনের (রিস্টোর) জন্য আবেদন করে জামায়াত। গত ২২ অক্টোবর বিলম্ব মার্জনা করে আপিলটি শুনানির জন্য পুনরুজ্জীবনের আদেশ দেন আপিল বিভাগ। এরপর কয়েক দফা শুনানি শেষে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ বাতিল করেন। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ আদেশে বলেন, দলটির ক্ষেত্রে পেন্ডিং (অনিষ্পন্ন) গঠনতন্ত্র ও রেজিস্ট্রেশন ইস্যু এবং অন্য কোনো ইস্যু যদি থেকে থাকে, তা সাংবিধানিক ম্যান্ডেট পুরোপুরি প্রয়োগ করে নিষ্পত্তি করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নির্দেশ দেওয়া হলো।
সেই আদেশের বলেই জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ দাবি করেন, ২০১৩ সালের হাইকোর্টের রায়ে পূর্বের যে অবস্থা ছিল সেই অবস্থাই থাকবে। এক্ষেত্রে প্রতীকসহ নিবন্ধন পাবে তার দল।
যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, ২০০৮ সালে যেমন আমি দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছিলাম, তেমনি এখনো আমরা প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা পাবো।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনের বিধিমালা সংশোধন করে ইতিপূর্বে সংরক্ষিত প্রতীকের তালিকা থেকে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকটি বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন নিবন্ধন ফিরে পেলেও প্রতীক পেতে বিলম্ব হতে পারে। কেননা, বিধিমালা সংশোধন করে ফের দাঁড়িপাল্লা প্রতীকটি যোগ করতে হবে। এজন্য আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের প্রয়োজনও হতে পারে।
ইইউডি/এইচএ/