চট্টগ্রাম: ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত নগরের কোতোয়ালী থানাধীন রহমতগঞ্জে অবিভক্ত ভারতের কংগ্রেস নেতা যতীন্দ্র মোহন সেনের পৈতৃক বাড়ি। তাঁর বাবা আইনজীবী যাত্রামোহন সেনের নাম অনুসারে এটি ‘জে এম সেন ভবন’ হিসেবে পরিচিত।
বাড়িটি পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে কাজ করছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। এরইমধ্যে শত বছরের পুরনো বাড়িটির জমির নকশা প্রণয়নের কাজ শেষ হয়েছে।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় বাকলিয়া সার্কেলের তথ্য অনুযায়ী, রহমতগঞ্জ মৌজায় বিএস জরিপের ৩৮৬ খতিয়ানের ১০৯৬ দাগে জায়গা রয়েছে ১৯ গণ্ডা এক কড়া অর্থাৎ ৩৮ শতকের চেয়ে বেশি। এর মধ্যে ২৩ শতক অর্পিত সম্পত্তি ও ১৫ শতক জায়গা শিশুবাগ স্কুলের নামে রয়েছে। ১৯৬৬ সালে জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ১১ গণ্ডা ২ কড়া জমি ইজারা নিয়ে বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয় সেখানে। ১৯৭৫ সালের পর নাম বদল করে প্রতিষ্ঠা করা হয় শিশুবাগ স্কুল।
২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি বাড়িটি দখলে নেওয়ার লক্ষ্যে বুলডোজার দিয়ে ভাঙার কার্যক্রম শুরু হলে বাধা আসে পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের কর্মীদের। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন বাড়িটি সিলগালা করে দেয়। ২৩ জানুয়ারি সেখানে সরকার ‘স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ নির্মাণ করবে বলে নোটিশ টাঙানো হয়।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, যাত্রামোহন সেনগুপ্তের বাড়ি একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন স্থাপনা। সংবিধানের ২৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বা তাৎপর্যমণ্ডিত স্মৃতি নিদর্শন, বস্তু বা স্থাপনাসমূহ বিকৃতি, বিনাশ বা অপসারণ থেকে রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এছাড়া এই বাড়ি রক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে।
আইনজীবীদের মতে, অর্পিত সম্পত্তি বিক্রির সুযোগ নেই। কেউ কিনলেও তাকে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালে আবেদন করে মালিকানা প্রমাণ করতে হবে। ট্রাইব্যুনাল আদেশ দিলেই জায়গার মালিক হতে পারবেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। অন্যথায় অর্পিত সম্পত্তির মালিক সরকার।
১৯৩৩ সালে ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাজধানী রাঁচিতে কারারুদ্ধ অবস্থায় মারা যান যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত। তাঁর মৃত্যুর পর চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জে স্বামীর পৈতৃক বাড়িতে ফিরে আসেন স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তা। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সেখানে ছিলেন তিনি। ওই বছর ইন্দিরা গান্ধীর অনুরোধে ভারতে চিকিৎসার জন্য যান। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে ফিরে এসে দেখেন, তাদের বাড়িটি দখল হয়ে গেছে। বাড়িটি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে সরকার নথিভুক্ত করেছে। এরপর তিনি ভারতে ফিরে যান।
এই পরিবারের একমাত্র উত্তরসূরী, যাত্রা মোহন সেনগুপ্ত’র নাতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মিলন কান্তি সেনগুপ্ত থাকেন চন্দনাইশের বরমা গ্রামে। অভাব-অনটনের চলে তাঁর পরিবার। চট্টগ্রাম শহর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে অনেক সম্পত্তির মালিক ছিলেন যাত্রামোহন। তাঁর উত্তরাধিকাররা দেশত্যাগ করলে বিভিন্নজন তাদের জমি দখল করে নেয়। কেউ মিলন কান্তি সেনগুপ্তকে অন্ধকারে রেখে জায়গা দখলে নিতে তার স্বাক্ষরও নেন।
সর্বশেষ স্মৃতিচিহ্ন জে এম সেন ভবন সংরক্ষণ করতে চট্টগ্রাম ইতিহাস ও সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে আবেদন করেছিল। এর প্রেক্ষিতে ভগ্নপ্রায় ভবনটি পরিদর্শন করেন অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানার নেতৃত্বে একটি দল। পরিমাপ করা হয় ভবনটির কাঠামো, কক্ষ ও জমি।
নাহিদ সুলতানা জানান, ভবনটির বয়স শত বছরের বেশি। এটির স্থাপত্য রীতি ঔপনিবেশিক আমলের। প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যের গুরুত্ব বিবেচনায় এই ভবন সংরক্ষণ করা যায়। এ বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে অবহিত করা হবে।
এসি/টিসি